কেন সূরা ইউসুফ পড়বেন?

:: কানিজ ফাতেমা ::

সূরা ইউসুফ বাবা-ছেলের ভালোবাসার এক দারুন নিদর্শণ। ইয়াকুব বারো ছেলে সন্তানের পিতা ছিলেন কিন্তু এক সন্তানের নিরুদ্দেশও নিতে পারেননি। বাংলায় আমরা যেমন চোখের মনি, নয়ন মনি বলি, ইয়াকুবের জন্য ইউসুফ (আঃ)ঠিক তাই, এই নয়নের মনি হারিয়ে তিনি আক্ষরিক অর্থেই চোখের আলো হারিয়ে ফেলেন। বাবা হয়ে কলিজার টুকরোর জন্য এত কেঁদেছিলেন যে ইউসুফহীন সময়ে ইয়াকুব সাময়িক অন্ধ হয়ে পড়েন। আবার তাঁর জীবনে ইউসুফের প্রবেশের সাথে সাথে ফিরে আসে চোখের আলো, সুবাহানাল্লাহ। ইউসুফ নেই, চোখের আলোও নেই, ইউসুফ আছে, ইয়াকুবের সব আছে। সন্তানের জন্য বাবাদের ভালোবাসা এমনই, আবার সন্তানদের কাছেও পিতা-মাতা চোখের আলো, তবে সন্তানরা এই ভালোবাসা সাধারণত বাবা মায়ের মৃত্যুর পর টের পায়। যারা পিতা মাতার জীবদ্দশায় বা তাদের মৃত্যুর পর তাদের জন্য সদকায়ে জারিয়া দিতে চান, যাদের বাবা বা মায়ের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে, যারা সন্তান হারিয়ে ফেলেছেন তারা সূরা ইউসুফ পড়ুন।


আমরা যে জীবনে শুধু প্রিয়জন হারাই তাই নয়। টিভিতে নদী ভাঙ্গনের দৃশ্য দেখি, নদীর পানি একে একে গিলে ফেলে সব, জমি-জিরাত, বসত বাড়ি,উঠোন-গাছ, স্কুল-মসজিদ এমনকি কবরস্থান।গতকালকের জমিদার একদিনেই নিঃস্ব-শুণ্য। ইউসুফেরও তাই হয়েছিলো, বাপের আদরের ছেলে বড় ভাইদের সাথে খেলতে গিয়েছিলো। কে জানতো এই যাওয়া তাঁর শেষ যাওয়া,সে হারাতে যাচ্ছে তাঁর পরিবার, প্রিয়তম বাবা (কোরানে ইউসুফের তাঁর আছে, ইয়া আবিতি, হে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার বাবা), তাঁর বাড়ি, তাঁর ভাইদের এবং মানুষের প্রতি তাঁর সমস্ত বিশ্বাসের।

আল্লাহ কথা রেখেছিলেন, হয়েছিলোও তাই। রাসূল (সাঃ) সমগ্র হেজাজে অলিখিত সম্রাট হয়ে, যে মক্কায় তাঁর মুখে বালি ছুড়ে মারা হতো তা বিনা রক্তপাতে জয় করে, স্ত্রী-সন্তান পরিবেষ্টিত হয়ে মারা গিয়েছিলেন। রাসূলের কষ্টের উপশম করতে যে সূরা নাযিল হয়েছে, যে সূরা তাঁর কষ্ট দূরের কারন হয়েছে সেই বরকতে আপনার কষ্টও দূর হবে। তাই যারা দীর্ঘ বিষন্নতায় ভুগছেন, দোয়া করছেন কিন্তু কবুল হচ্ছেনা তারা সূরা ইউসুফ পড়ুন,পড়তেই থাকুন, আজ অথবা কাল কিংবা দশ বছর পর হলেও দোয়া কবুল হবেই, ইন শা আল্লাহ। দোয়া কবুল হতে ইয়াকুব-ইউসুফের ৪০/৮০ বছর আর রাসুলের দশ বছর লেগেছিলো। আল্লাহ জানেন, আমরা জানিনা।


কিভাবে পারলো তাঁর ভাইয়েরা তাদের ভাইকে নিজের হাতে অন্ধকার,পরিত্যাক্ত কূপে মৃত্যুর জন্য ফেলে দিতে। আপন মানুষদের কী নিদারুন বিশ্বাসঘাতকতা। যারা কোন কিছু হারানোর বেদনায়, স্বজনদের ব্যবহারে, নিজেকে হারিয়ে ফেলার অনিশ্চয়তায়, ভবিষ্যত নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় আছেন তারা সূরা ইউসুফ পড়ুন।

যারা ভাবছেন এইতো জীবন শেষ, তারা জানুন ইউসুফ কূপ থেকে উঠে রেহাই পেয়েছিলেন। ইউসুফ দুই পবিত্র মসিজিদের নির্মাতা ইবরাহীম (আঃ)র প্রপৌত্র, একজন নবীর নাতি ও পুত্র, আরেক দাদা ইসমাইল (আঃ)র পর দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ বংশে তাঁর জন্ম,সেই বংশের ছেলে কিনা বাজারে উঠলেন দাস বা চাকর হিসেবে, নবী পুত্র থেকে সরাসরি চাকর। অতি সুন্দর চেহারা ও ব্যবহারে চাকরসুলভ না হওয়ায় আযীয চাকর হিসেবে নয় বরং সন্তান স্নেহে রাখতে চাইলেন। তাও হলোনা, চোখে পড়লেন আযীযের স্ত্রীর। আযীযের স্ত্রী মানুষ খারাপ নন, তিনি অন্য কোন পুরুষের প্রতি আগে আসক্ত ছিলেন এমন জানা যায়না।অন্য মিশরীয় নারীরা যেখানে আঙ্গুল কেটে ফেলেছিলেন সেখানে আযীযের কমবয়সী স্ত্রীকে বিশেষ দোষ দেয়া যায়না। আমরা সকলেই সুন্দর হতে চাই কিন্তু সৌন্দর্য অনেক বড় পরীক্ষা, ফিতনা, অনেক ভালো মানুষই সৌন্দর্য দেখে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে আর দুষ্ট লোকদের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত করে ফেলে। পারতপক্ষে, অকারনে সুন্দর হতে চাওয়ার ইচ্ছা রাখাও ঠিকনা, সৌন্দর্য বিশাল পরীক্ষা,বেশীরভাগ মানুশই ই নিতে পারে না। যারা দুষ্ট,ক্ষতিকর লোকের কাছ থেকে সৌন্দর্য, সম্পদ ও সন্তানের ক্ষতির আশংকা করছেন বা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তারা সূরা ইউসুফ পড়ুন।


ইউসুফ সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন আযীযের স্নেহের মর্যাদা দিতে কিন্তু পারেননি,নিজে নিষ্পাপ থাকার পরও পারেননি, অপবাদ মাথায় নিয়ে যেতে হলো জেলখানায়। নবীপুত্র থেকে চাকর, চাকর থেকে সরাসরি জেলখানায়,যেখানে রাজ্যের অপরাধীদের আবাস।

রাজমহল এতই কঠিন হয়ে গিয়েছিলো যে ইউসুফ নিজেই জেলখানা কামনা করেছিলেন। আমাদের জীবনেও হয় এমন, যেন এই চাকরীর চেয়ে বেকার থাকাও ভালো, এই সংসারের চেয়ে বিচ্ছেদ ভালো, জীবনের চেয়ে মৃত্যু। প্রাথমিকভাবে জুলেখার দেয়া কষ্টের চেয়ে জেলখানা ভালো বোধ করলেও ইউসুফ (আঃ) জীবনের প্রতি নেতিবাচক ছিলেন না।

ইউসুফ (আঃ)র জেলখানাও আমাদের শেখার বিদ্যাপীঠ; এখান থেকে আমরা যা শিখি তা হলো
‘সবসময় আমিই কেন, why always me?’ এই প্রশ্ন না করা, অল্প বয়সে মাকে হারানো, ভাইদের হিংসা,অন্ধকার কূপ থেকে দাস বাজার,দাস থেকে অপবাদ থেকে জেলখানা এত কিছুর পর উনি একবারও ‘সবসময় আমিই কেন’ না বলে দৃঢ় প্রশ্নহীন সবর রেখেছেন।সবরের এই উত্তরাধিকার তিনি তাঁর পিতামহের বাবা ইবরাহীম (আঃ) থেকে পেয়েছিলেন, ছুরির নীচে গলা পেতে দেয়া ইসমাঈল (আঃ),দাদী হাজেরা থেকে তাঁর পুরো বংশই সবরের আদর্শ পরিবার।


তবে সবর মানে চুপচাপ বসে থাকা না, সাথে চেষ্টা করাও। যেমনি হাজেরা (আঃ) সাতবার সাফা মারওয়া দৌড়েছিলেন, যেভাবে পিতা ইয়াকুব তাঁর বাকী ছেলেদের বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেলেন, ‘যাও, ইউসুফকে খোঁজ, হাল ছেড়ে দিয়োনা, নিশ্চয়ই কাফের ছাড়া আল্লাহর রহমত থেকে কেউ নিরাশ হয়না’, ইউসুফ (আঃ)ও মুক্ত হতে চেষ্টা তদবির করে যাচ্ছিলেন। কারাগারে স্বপ্নের তাদবির বলে দেয়ার সাথে সাথে কারামুক্ত হতে যাওয়া কয়েদিদের বলতেন, আমার কথা যেয়ে বলো,বলো যে আমি ভালো স্বপ্নের তদবির করতে পারি, আমি তাদের কাজে লাগবো, আমাকে যেন মুক্তি দেয়। যারা জীবনে যা হতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি,যারা ভাবছেন তাদের এই এই গুন বা যোগ্যতা আছে কিন্তু কাজে লাগাতে পারছেন না, জীবনে-কর্মক্ষেত্রে খালি পিছিয়ে পড়ছেন, অপদস্ত হচ্ছেন, যারা আপনার উপর আশা করেছিলো তাদের হতাশ করছেন তারা সূরা ইউসুফ পড়ুন।

যারা বিষন্নতায় ভুগছেন। রাসূল (সাঃ)র বড় কষ্টের সময়ে এই সূরা নাযিল হয়, বলা হয়ে থাকে এই সূরা সম্পূর্ণ একবারে নাযিল হয়েছিলো (ইখতিলাফ আছে)। সূরা ইউসুফ কোরানের আর সব সূরা থেকে আলাদা, আলাদা এই অর্থে যে পুরো কোরানে যেখানে আর সব নবীদের কাহিনী ছাড়া ছাড়া ভাবে এসেছে সেখানে সূরা ইউসুফ একটা সম্পূর্ণ কাহিনী।

এত কিছু থাকতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইউসুফ (আঃ)কে বেছে নিলেন কেন?

খাদীজা (রাঃ)র সাথে দীর্ঘ পঁচিশ বছরের বিবাহিত জীবনে খাদীজা ছিলেন তাঁর অভিভাবক, ঠিক যেমনি এগারো তারকা ও চাঁদ সূর্যের সিজদার স্বপ্ন দেখার সাথে সাথে ইউসুফ কার কাউকে না তাঁর বাবাকে ‘ইয়া আবিতি’কে জানায়, রাসূল (সাঃ)ও জীবরাঈল (আঃ)কে দেখার সাথে সাথে মক্কার আর কাউকে না বরং খাদীজাকে জানায়, আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটলেই আমরা আমাদের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকেই জানাই। বাবা ইয়াকুব যেমন এই স্বপ্নের কথা আর কাউকে জানাতে নিষেধ করার পরামর্শ দেন,খাদীজাও দ্রুত ওয়ারাকার কাছে ছুটেন স্বপ্নের তাদবীর জানতে। তবে একটা জায়গায়, ইয়াকুব (আঃ) ও খাদীজা দুজনই নিশ্চিত ছিলেন যে স্বপ্ন আর রাসূল যা দেখেছেন কিছুই শয়তানের পক্ষ থেকে নয় বরং খোদায়ী বা divine।


তাই যারা স্বামী বা স্ত্রী হারিয়েছেন, স্মৃতির ভার আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে একাকী কষ্ট পাচ্ছেন তারা সূরা ইউসুফ পড়ুন।

ছোট্ট ইউসুফের কাছে বাবাই যেমন একমাত্র আশ্রয়, রাসূল (সাঃ)র কাছেও খাদীজা তাই, রাসূল তাঁর বাড়িতেই থাকেন, তিনিই তাঁর সমস্ত খাবার দাবার থেকে শুরু সমস্ত কিছুর জোগান ও দেখাশোনা করেন। খাদীজা যদি হন তাঁর পারিবারিক সকল কিছুর অভিভাবক, চাচা আবু তালিব তাঁর সামাজিক নিরাপত্তা দানকারী অভিভাবক। মক্কার কাফেরেরা তখন দারূন খুশী, মক্কার অবস্থা সর্বকালের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ, হাতেগোণা মুসলমানদের মধ্যে বেশীরভাগই হিজরত করে আবিসিনায়া এবং মদীনায়। রাসূলকে মেরে ফেলার সিদ্বান্ত আসা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র কিন্তু, সেই বিশেষ সিদ্ধান্ত আসার আগে চলছে নিত্য অপমান আর অপদস্তের ঘটনা। কেউ সিজদায় দাঁড়ালে উটের নাড়ি ভুড়ি গায়ে ঢেলে দেয়, কেউ মুখে বালু ছুড়ে মারে, রাস্তায়, বাড়ির উঠোনে হাসাহাসি থেকে তীব্র ভৎসনা চলে। আর এ সবই চলছে তাঁর চাচা আবু লাহাব, দুধ ভাই আবু সুফিয়ান আর আত্নীয় আবু জেহেলের নেতৃত্বে যেমনি ইউসুফ (আঃ) সব হারিয়েছিলেন ভাইদের কারনে।


দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বংশ ইবরাহীম, ইসমাঈলের বংশধর রাসূলের মান সম্মান বোধ ছিলো অন্য সবার চেয়ে বেশী তাই তাঁর কষ্টটাও হত বেশী আর এখনতো তিনি মানসিকভাবে সর্বোচ্চ নাজুক। খাদীজাশূণ্য বাড়ীতে একাকী কষ্টের সময় আল্লাহ আযযা ওয়াজাল তাই আরেক নবী ইউসুফের সব হারিয়ে একা হয়ে যাবার কাহিনী তাঁকে শোনাচ্ছেন।

স্বপ্নের আয়াতের পরপরই, এই সূরার ৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলছেন যে তিনি ইউসুফ ও ইয়াকুবের পরিবারের উপর তাঁর রহমত পূর্ণ করবেন যেভাবে তিনি তাঁর রহমত পূর্ণ করেছেন তাঁর পিতৃপুরুষ ইবরাহীম ও ইসহাকের উপর।

‘…আর তোমার উপর ও ইয়াকূবের পরিবারের উপর তাঁর নিআমত পূর্ণ করবেন যেভাবে তিনি তা পূর্বে পূর্ণ করেছিলেন তোমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম ও ইসহাকের উপর, নিশ্চয় তোমার রব সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’

ইবরাহীম, ইসহাক, ইয়াকুব, ইউসুফ আবার রাসূল (সাঃ)রও পিতৃপুরুষ, তাঁরা যে কষ্ট পেয়েছেন তা রাসূল (সাঃ) এখন পাচ্ছেন, কিন্তু তাঁদের শেষ্টা হয়েছে আল্লাহর অনুগ্রহের পূর্ণতার মাধ্যমে,যেমন ইউসুফ (আঃ) মিশরের আযীয হয়েছিলেন,ফিরে পেয়েছিলেন তাঁর পুরো পরিবার, তাঁর প্রিয়তম বাবাকে, শয্যাশায়ী অন্ধ পিতা ফিরে পেয়েছিলেন তাঁর চোখের মনিকে ঠিক তেমনি রাসূলের শেষটাও ভালো হবে।

আল্লাহ কথা রেখেছিলেন, হয়েছিলোও তাই। রাসূল (সাঃ) সমগ্র হেজাজে অলিখিত সম্রাট হয়ে, যে মক্কায় তাঁর মুখে বালি ছুড়ে মারা হতো তা বিনা রক্তপাতে জয় করে, স্ত্রী-সন্তান পরিবেষ্টিত হয়ে মারা গিয়েছিলেন।রাসূলের কষ্টের উপশম করতে যে সূরা নাযিল হয়েছে, যে সূরা তাঁর কষ্ট দূরের কারন হয়েছে সেই বরকতে আপনার কষ্টও দূর হবে। তাই যারা দীর্ঘ বিষন্নতায় ভুগছেন, দোয়া করছেন কিন্তু কবুল হচ্ছেনা তারা সূরা ইউসুফ পড়ুন,পড়তেই থাকুন, আজ অথবা কাল কিংবা দশ বছর পর হলেও দোয়া কবুল হবেই, ইন শা আল্লাহ। দোয়া কবুল হতে ইয়াকুব-ইউসুফের ৪০/৮০ বছর আর রাসুলের দশ বছর লেগেছিলো। আল্লাহ জানেন, আমরা জানিনা।

শেয়ার করতে

২ thoughts on “কেন সূরা ইউসুফ পড়বেন?

  1. Thank you for sharing your knowledge ont this tremoundous gem. You are right, whatever problems we have, we should read this Surah and learn and ponder about every awat. As Allah (swt) says, “the best of all stories”. Personally, after all the ordeal Prophet Yusuf (Pbhu) had been through, yet at the end his small speech about the mercy of Allah (swt) shows how firm his believe in Allah was, which I think we all lack

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *