‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’

১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের একুশে ফেব্রুয়ারিতে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম সৃষ্টি প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন ভাষা আন্দোলনের একজন নিবেদিতপ্রাণ সক্রিয় সংগঠক- চট্টগ্রাম জেলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ও চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদক। একুশে ফেব্রুয়ারি রাতেই চট্টগ্রামে রচিত হয়ে যায় একুশের প্রথম কবিতা- ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’।

কবিতাটি রচনার পরপরই সেখানে উপস্থিত হন খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস- তিনি তখন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন চট্টগ্রাম জেলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং তাদের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে সহযোগিতা করার জন্যে। তখনই সিদ্ধান্ত হয় কবিতাটির দ্রুত প্রকাশ ও প্রচারের।

কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস এর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আবদুল খালেক তাঁরই সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক কোহিনূর’ এ মাহবুব -উল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি গোপনে প্রকাশ করেন। ২২ ফেব্রুয়ারি তারিখ রাতেই কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে শুরু হয়ে যায় কবিতাটি প্রকাশের কার্যক্রম- অন্যদিকে সরকারিভাবে বেআইনি এসব কার্যক্রম প্রতিরোধে তৎপর সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী গভীর রাতে কম্পোজ ও প্রুফের কাজ যখন সমাপ্ত প্রায়, তখন হঠাৎ হামলা শুরু হয় প্রেসে। কিন্তু প্রেস কর্মচারীরা অসীম সাহস আর অতীব দ্রুততায় প্রকাশনার কাজ তত্ত্বাবধানকারী খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসকে সহ সম্পূর্ণ কম্পোজ ম্যাটার এমনভাবে লুকিয়ে ফেললো যে, তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুঁজির পরও পুলিশ তা জব্দ করতে পারে নি। পুলিশের শূন্য হাতে ফিরে যাওয়ার পর তারা পূর্ণ করে নেয় ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’-র প্রকাশনার কাজ। শিরোনামপত্র ১/৮ ডিমাই আকৃতির ৮ পৃষ্ঠার এ প্রকাশনার শেষ পৃষ্ঠার শেষ প্রান্তে লেখা ছিল ‘প্রকাশক- কামালউদ্দিন আহমদ বিএ কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস হইতে মুদ্রিত’ এবং প্রথম পৃষ্ঠায় লেখকের নামতো আছেই। এইভাবেই প্রকাশনাটিতে লেখকের নামের সাথে প্রকাশক ও মূদ্রণকারী প্রেসের নাম প্রকাশ করার সময় পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে অতীব তাৎপর্যপূর্ণ এর মধ্যে দিয়ে স্বজ্ঞানে ঝুঁকি নিয়ে ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়ানোর একটা প্রবল ঘোষণা আছে- এই ঘোষণা যেমন কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর প্রকাশক কামাল উদ্দিন আহমদ বি. এ-র তেমনি কবিতাটির প্রকাশনা কাজের দায়িত্ব গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের স্বত্বাধিকারী ও সাপ্তাহিক কোহিনূর সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল খালেক, প্রেস ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরী, কম্পোজিটর নূরুজ্জামান পাটোয়ারি ও এ কাজে অংশগ্রহণকারী প্রেসের অন্যসব কর্মচারীরও। কাজেই এঁরাও হয়ে যান একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ সৃষ্ট কালজয়ী ইতিহাসের উজ্জ্বল অংশীদার।

ভীত সন্ত্রস্ত পাক-সরকার কবিতাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, প্রতিবাদ সভায় কবিতাটির পাঠক চৌধুরী হারুনর রশীদ, প্রকাশক কামাল উদ্দিন আহমদ বি.এ-র বিরুদ্ধে জারি করে গ্রেফতারি পরোয়ানা। এবং দ্রুত গ্রেফতার করা হয় চৌধুরী হারুনর রশীদ ও প্রেস ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরীকে। অবশ্য পরে তাঁদের জামিন দেয়া হয়েছিল এবং প্রায় আট মাস পর ২৩ অক্টোবর তারিখে বেকসুর খালাসও পেয়ে যান তারা।

নিষেধাজ্ঞার ফলে দীর্ঘদিন লোকলোচনের আড়ালে থাকায় এক সময় কবিতাটি হারিয়েই যায়। এই হারিয়ে যাওয়ার বেদনায় প্রথম প্রবল বেদনাক্রান্ত হন অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে তিনি কবির স্মৃতি থেকে কবিতাটি উদ্ধারের চেষ্টা করেন এবং উদ্ধারকৃত অংশটুকু তাঁর ‘ভাষা আন্দোলন ও শহীদ মিনার’ গ্রন্থ প্রকাশ করেন। অতঃপর বাংলাদেশ টেলিভিশনও সরব হন কবি ও কবিতাটি নিয়ে; সেই সূত্রে ঐ কবিতাটির এক নিবেদিত প্রাণ পাঠক ও সংরক্ষণের কাছ থেকে কবিতাটি প্রাপ্ত হয়ে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে কবি প্রকাশ করেন তাঁর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ শীর্ষক নতুন গ্রন্থ; আরও পরে বাংলা একাডেমির একুশের কবিতা সংকলনসহ অন্যত্রও মুদ্রিত হয় কবিতাটি। কিন্তু সর্বত্রই পরিব্যাপ্ত ছিল কবিতাটি সম্পর্কে নানা তথ্য ভ্রান্তি ও বহুমাত্রিক ভ্রান্ত পাঠ। এর মূল কারণ ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে প্রকাশিত কবিতাটির মূলকপি এদের কারও কাছে ছিল না। সেটা যে তলিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। অবশেষে বিস্মৃতির অতল থেকে কবিতাটির মূল পাঠ উদ্ধার করেন গবেষক অধ্যাপক চৌধুরী জহুরুল হক।

গবেষক অধ্যাপক চৌধুরী জহুরুল হক দৈনিক আজাদীতে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি ‘সদয় অবগতির জন্যে’ শীর্ষক কলামে। ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ শিরোনামাঙিক্ষত রচনা প্রকাশের মধ্য দিয়ে শুরু করেন একুশের প্রথম কবিতার সন্ধান প্রয়াসের। এক বছরের মধ্যেই তিনি লাভ করেন সফলতা উদ্ধার করেন ১/৮ ডিমাই আকৃতির শিরোনামপত্রসহ আট পৃষ্ঠার দুআনা দামের একুশের প্রথম মুদ্রিত পুস্তিকাটি- অর্থাৎ একুশের প্রথম কবিতার মুদ্রিত আদি ও অবিকল পাঠ এবং ‘প্রসঙ্গ কথা’সহ চল্লিশ বছর পরে আরেক ফাল্গুনে একুশের প্রথম কবিতার পূর্ণপাঠ’ শিরোনামে তা প্রকাশ করেন ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদীর বিশেষ সংখ্যায়। অতঃপর আরও দশ বছর যাবৎ নানা পর্যবেক্ষণ কবিতাটির বিভিন্ন পাঠের নানাবিধ ত্রুটি ও অপূর্ণতার উন্মোচন’ এ সম্পর্কিত সমূহ তথ্য ভ্রান্তির অপনোদন সহ কবিতাটি আদি ও অবিকল পাঠ এবং সম্পাদিত পূর্ণপাঠ নিয়ে ২০০২ খ্রিস্টাব্দে একুশের সুবর্ণ জয়ন্তীতে প্রকাশিত হয় এক অনন্য গবেষণা গ্রন্থ ‘প্রসঙ্গ : একুশের প্রথম কবিতা’।


কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী ১৯২৭ সালের ৭ নভেম্বর রাউজানের গহিরা আসাদ চৌধুরী বাড়িতে একুশের প্রথম কবিতার স্রষ্টার জন্ম। পিতা আহমদুর রহমান চৌধুরী, মাতা রওশন আরা বেগম। ১৯৪৭ সালে গহিরা হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। রাজনৈতিক কারণে আই এ পড়ার সময় চট্টগ্রাম কলেজ ত্যাগ করেন। ১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র কংগ্রেসে যোগদান করেন। ছাত্র কংগ্রেসের কর্মী হিসেবে ব্রিটিশবিরোধী ভারত-ছাড় আন্দোলনে অংশ নেন। বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে তিনি অগ্রভাগে ছিলেন। ১৯৫২ সালের ১০ অক্টোবর জওশন আরা রহমানের সাথে তার বিয়ে সম্পন্ন হয়। ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর একুশের প্রথম কবিতার রচয়িতা কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী ইন্তেকাল করেন

শেয়ার করতে

২ thoughts on “‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *