চলচ্চিত্রের সোনালি যুগের সেইসব খলনায়কেরা

।। ফজলে এলাহী ।।

বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে ভালো মন্দের সংঘাত আর সুপারহিরো ব্যাপারটা শুরুর দিকে বলিউড হলিউডের মতো ছিলো না। ছিলো না কোন অ্যাকশন বা মারামারির দৃশ্য।কিন্তু পার্শ্ববর্তী বাণিজ্যিক ছবির ইন্ডাস্ট্রির বলিউডের হিন্দি ছবিগুলো যখন হলিউডের অ্যাকশন ছবির আদলে দ্বন্দ্ব সংঘাত যুক্ত করে উপমহাদেশের বাণিজ্যিক ছবিতে বৈচিত্র্য আনে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকারেরাও নিজেদের ছবিতে তা যুক্ত করার চিন্তা করতে থাকেন।

কাজী হায়াতের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘খোকনসোনা’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আসা রাজীব পরবর্তীতে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে খলনায়ক চরিত্রে শক্তিশালী একটি অবস্থান তৈরি করে নেন । রাজীবের অভিনয় দক্ষতার সাথে ঝাঁঝালো ভরাট কণ্ঠ, ভয়ানক চোখ খলনায়ক হিসেবে রাজীবকে করেছিল তখন সবার থেকে আলাদা। খলনায়ক হিসেবে রাজীব দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিলেন যা ছিল রাজীবের চলচ্চিত্রের গুরু কাজী হায়াতের ‘দাঙ্গা’ ও ‘চাঁদাবাজ’ ছবি দুটো । ‘দাঙ্গা’ ছবির মূল ভিলেন কিন্তু মিজু আহমেদ কিন্তু ছবিতে রাজীবের ভয়ানক সুন্দর অভিনয়টা মিজু আহমেদকেও ছাড়িয়ে যায়। ছবিতে মিজুর ভাড়াটে খুনি কালু চরিত্রে রাজীবের অনবদ্য অভিনয় আজো দর্শকদের চোখে লেগে আছে।

১৯৭৩ সালে প্রয়াত জহিরুল হকের নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘রংবাজ’ ছবিটা মুক্তি পায় যা হলো বাংলাদেশের প্রথম কোন চলচ্চিত্র যেখানে অ্যাকশন দৃশ্য ছিল। অ্যাকশন দৃশ্যর প্রচলনের কারনেই ‘রংবাজ’ ছবিটা ঐতিহাসিক ছবি হিসাবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ঠাই করে নেয় যার পেছনে আরেকজন মানুষের অবদান ছিল যার নাম জসিম। সেই ঐতিহাসিক রংবাজ ছবির মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নায়ক বনাম খলনায়কের দ্বন্দ্ব সংঘাত বা ভালো – মন্দের সংঘাত এবং ভালো’র জয় এই ধারাটি শুরু হয় যার ফলে এরপর আমরা বাংলাদেশের ছবিতে ‘খলনায়ক’ হিসেবে আরেকটি শক্তিশালি পক্ষ পেয়ে যাই যেখানে এখন পর্যন্ত অনেক দারুন দারুন ও সফল অভিনেতাদের আমরা পেয়েছিলাম যার মধ্যে থেকে আমার দেখা সেরা কজন খলনায়কদের গল্প আজ আপনাদের বলছি শুনুন।

জহিরুল হকের ‘রংবাজ’ ছবির মধ্যে যেমন প্রথম অ্যাকশন দৃশ্যর প্রচলন শুরু হয় ঠিক তেমনি ‘খলনায়ক বা ভিলেন ’ চরিত্রটিও প্রথম পর্দায় দর্শকরা দেখতে পায় যা করেছিলেন অভিনেতা জসিম এবং সেই সুত্রে জসিম হলেন বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের প্রথম ‘খলনায়ক’। জসিম হলেন আমার দেখা সাদাকালো যুগের সবচেয়ে স্টাইলিশ , স্মার্ট খলনায়ক যিনি আতংক ছড়াতেন খুব ঠাণ্ডা মাথায় কু-পরিকল্পনা করতেন , খুব চমৎকার ভাবে প্রতিপক্ষে কাউনটার দিতেন, চ্যালেঞ্জ জানাতেন যার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ছাপ ছিল। দেওয়ান নজরুলের ‘দোস্ত দুশমন’ ছবির ডাকাত চরিত্রের জসিম আর বারুদ ছবির অপরাধ জগতের গডফাদার চরিত্রের জসিম দুটোই অসাধারন । বারুদ ছবিতে অলটাইম স্যুটেট বুটেড পরিহিত ও মুখে লম্বা চুরুট টানতে থাকা জসিমের সংলাপ বলার ধরনটা ছিল খুবই দারুন । আসামী হাজির ছবিতে ওয়াসিম ও জসিমের শেষ ২০ মিনিটের লড়াইয়ের দৃশ্যটি তো আজো দর্শকরা ভুলে নাই। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে এতো লম্বা সময় ধরে শেষ অ্যাকশন দৃশ্য আর কখনও ২য়বার দেখেছিলাম বলে মনে পড়ে না। সেই দৃশ্য ওয়াসিম ও জসিমের কাউন্তার –পাল্টা কাউন্তার মুখর সংলাপগুলো ছিল চরম । খলনায়ক হিসেবে জসিম নিজের নিজস্ব একটা ধরন প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন । শহুরে গডফাদার কিংবা গ্রামের ডাকু সব দিকেই জসিম দারুন ছিলেন যিনি চিৎকার করে সংলাপ বলতেন কম । এই জনপ্রিয় খলনায়ক জসীমই পরবর্তীতে প্রচণ্ড জনপ্রিয় নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন এবং নায়ক জসিম হিসেবেই মৃত্যুবরন করেছিলেন । জসিমের ‘খলনায়ক’ হিসেবে উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো –রংবাজ, দোস্ত দুশমন , প্রতিজ্ঞা, বারুদ, রাজদুলারি, আসামী হাজির , বাঁধনহারা, মিন্টু আমার নাম , ওস্তাদ সাগরেদ, জনি, ধর্ম আমার মা , গুনাহগার।

জসিমের সময় আরেকজন অভিনেতা খল চরিত্রে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন তিনি হলেন খলিল উল্লাহ খান যাকে আমরা খলিল নামে চিনতাম। যিনি এপার ওপার, গুনাহগার, দস্যু বনহুর, মিন্টু আমার নাম, মা ও ছেলে , নীতিবান , বীরপুরুষ, বিপ্লব, মূর্খ মানব, দুর্নাম , লৌহ মানব, সতর্ক শয়তান , ঘৃণা সহ আরও অনেক ছবিতে খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

খলনায়ক চরিত্রে বিশেষ করে ফোক ছবিতে গ্রাম্য মোড়লের চরিত্রে এটিএম শামসুজ্জামান ছিলেন অনবদ্য। তবে এটিএম শামসুজ্জামানের সংলাপ বলার ধরনটা ছিল খুবই মজার যার ফলে অনেক ছবিতে খলনায়ক চরিত্রে এটিএম শামসুজ্জামানকে ভয় পাওয়ার চেয়ে কমেডিয়ান হিসেবে মজা পেতাম বেশী । এটিএম শামসুজ্জামানের খলনায়ক চরিত্রে উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো লাঠিয়াল, মান অভিমান,শক্তিশালি, আদেশ, সুখের স্বপ্ন, রানী চৌধুরানী, আশীর্বাদ, অংশীদার, সিকান্দার, মর্যাদা,হুমকি, নীতিবান ,হিসাব চাই,দুর্নাম, অপেক্ষা,জিনের বাদশা, ঢাকা ৮৬, ভুল বিচার,পদ্মা মেঘনা যমুনা,প্রেম প্রতিজ্ঞা, অজান্তে ।

সুভাষ দত্তের হাত ধরে চলচ্চিত্রে আসা এবং খলনায়ক চরিত্রে প্রতিষ্ঠা পাওয়া আরেকজন অভিনেতা হলেন আহমেদ শরীফ ।যিনি নায়ক জসিমের বিপরীতে সবচেয়ে বেশী সফল ছিলেন । নায়ক জসিমের ছবিতে খলনায়ক মানেই আহমেদ শরীফ আর এর আগে ওয়াসিম, সোহেলরানা, আলমগিরের বিপরীতেও সফল ছিলেন । আহমেদ শরীফের অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো গাংচিল , জনি, লুটেরা,রাজদণ্ড, কুরবানী, রঙিন নবাব সিরাজউদ্দেীলা, তিন কন্যা, তুফানমেইল, প্রতিরোধ, নেপালি মেয়ে, হুঁশিয়ার, মোহাম্মদ আলী, রকি, লালু মাস্তান, লোভ লালসা, হিরো, গর্জন, টাকা পয়সা, ক্ষতিপূরণ, কাজের বেটি রহিমা , মাস্তান রাজা, শত্রুতা, সম্পর্ক, জিনের বাদশা, ঢাকা ৮৬, ভুল বিচার, ভাইজান, আখেরি মোকাবেলা, রক্ত নিশান , বাংলার নায়ক ।

কাজী হায়াতের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘খোকনসোনা’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আসা রাজীব পরবর্তীতে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে খলনায়ক চরিত্রে শক্তিশালি একটি অবস্থান তৈরি করে নেন । রাজীবের অভিনয় দক্ষতার সাথে ঝাঁঝালো ভরাট কণ্ঠ, ভয়ানক চোখ খলনায়ক হিসেবে রাজীবকে করেছিল তখন সবার থেকে আলাদা। খলনায়ক হিসেবে রাজীব দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিলেন যা ছিল রাজীবের চলচ্চিত্রের গুরু কাজী হায়াতের ‘দাঙ্গা’ ও ‘চাঁদাবাজ’ ছবি দুটো । ‘দাঙ্গা’ ছবির মূল ভিলেন কিন্তু মিজু আহমেদ কিন্তু ছবিতে রাজীবের ভয়ানক সুন্দর অভিনয়টা মিজু আহমেদকেও ছাড়িয়ে যায়। ছবিতে মিজুর ভাড়াটে খুনি কালু চরিত্রে রাজীবের অনবদ্য অভিনয় আজো দর্শকদের চোখে লেগে আছে।

রাজীবের সাথে পরবর্তীতে আরেক শক্তিমান অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদির রসায়নটাও ছিল চমৎকার। এমনও ছবি আছে শুধুমাত্র রাজীব ও হুমায়ুন ফরিদির রসায়ন দেখতে গিয়ে দর্শক সিনেমা হলে গিয়েছিলো যারমধ্যে জিদ, টাকার অহংকার, লাভ , প্রেম দিওয়ানা, ভণ্ড ছবিগুলো ছিল অন্যতম ।খলনায়ক হিসেবে রাজীবের উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো ছিল উছিলা, মিয়া ভাই, সত্য মিথ্যা, বীরাঙ্গনা সখিনা, হুমকি, মা মাটি দেশ, প্রেম প্রতিজ্ঞা, দাঙ্গা, ত্রাস, দুর্নীতিবাজ, প্রেম দিওয়ানা, টাকার অহংকার, মৃত্যুদণ্ড , বন্ধন, চাঁদাবাজ, মীরজাফর, মিথ্যার রাজা, বেনাম বাদশা, আখেরি রাস্তা, বিদ্রোহী কন্যা, ক্ষমা, জবরদখল,প্রিয় তুমি, বিক্ষোভ, খলনায়ক, দেশদ্রোহী, লুটতরাজ, ভণ্ড সহ আরও অসংখ্য ব্যবসা সফল ছবির দুর্দান্ত খলনায়ক ছিলেন রাজীব।

৯০ দশকের শুরুর দিকে (১৯৯১ সালে) শহিদুল ইসলাম খোকনের ‘সন্ত্রাস’ ছবির মাধ্যমে খলচরিত্রে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে মঞ্চ ,টেলিভিশনের দুর্দান্ত অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদির। ‘সন্ত্রাস’ ছবির মাধ্যমে সফল হওয়ার পরপরেই এরপর দিনে দিনে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের খলনায়ক হিসেবে নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য এক উচ্চতায় যার জনপ্রিয়তার কাছে অনেক নায়কও ব্যর্থ হয়ে যান । টপ রংবাজ ছবির ঢাকাইয়া ভাষার ফরিদির সংলাপগুলো তো আজো কানে বাজে ।আত্ম অহংকার ছবিতে এক হাফ প্যান্ট ও গেঞ্জি পরে পুরো ছবিতে বিশ্বস্ত চাকর ও ভিলেন ফরিদি তো আজো চোখে ভাসে। রুবেলের সাথে ফরিদির রসায়নটা ছিল চমৎকার তবে সব নায়কের সাথেই ফরিদি দারুন অভিনয় করতেন। হুমায়ুন ফরিদি ছিলেন বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের সোনালি যুগের খলনায়কদের মধ্যে সর্বশেষ ও অন্যতম সেরা একজন ডায়নামিক অভিনেতা।

শহিদুল ইসলাম খোকনের অপহরণ ও বিশ্বপ্রেমিক ছবিতে তো আলাদা ভাবে কমেডিয়ান চরিত্রের প্রয়োজন হয়নি একজন খলনায়ক ফরিদি পুরোটা সময় দুটো চরিত্রেই অনবদ্য অভিনয় করে গিয়েছিলেন। সেইসময় এমনও ছবি আছে শুধু খলনায়ক ফরিদির অভিনয় দেখতে দর্শকরা সিনেমা হলে ছুঁটে যেতেন। বলতে পারেন খলনায়ক জসিমকে দিয়ে যে ধারার সুচনা ফরিদিকে দিয়ে তার পূর্ণতা পেলো বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র।ফরিদির উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো ছিল –সন্ত্রাস, অনুতপ্ত, জিদ, ত্যাগ, চোখের পানি, টপ রংবাজ, অপহরণ, সতর্ক শয়তান, প্রেম দিওয়ানা, দুঃসাহস, শত্রু ভয়ংকর, হিংসা,ঘৃণা,দোলা, আত্মঅহংকার, ঘাত প্রতিঘাত, ডন,মহাগুরু,আজকের হিটলার, স্ত্রী হত্যা, বাংলার বধূ, বাপের টাকা, ভণ্ড, রাক্ষস, ঘাতক , গৃহযুদ্ধ, বিশ্বপ্রেমিক, মানুষ , শান্ত কেন মাস্তান, আনন্দ অশ্রু, বিচার হবে, ম্যাডাম ফুলি ছবির মতো অসংখ্য দর্শকপ্রিয় ছবি আছে খলনায়ক হুমায়ুন ফরিদির যা আজো যারা দেখেনি তাঁরা বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের দুর্দান্ত কিছুই দেখেনি এবং অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদি সম্পর্কে কিছুই জানেনি।

উপরের উল্লেখিত খলনায়করা ছাড়াও বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের আরও কিছু বেশ কজন দুর্দান্ত অভিনেতা খলনায়ক চরিত্রে দারুন অভিনয় করতেন যাদের মধ্যে দারাশিকো, রাজ, গোলাম মোস্তফা, মঞ্জুর রাহি, আদিল, বাবর, ড্যানী সিডাক অন্যতম।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *