:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু কমলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর রহস্যজনক মৃতের সংখ্যা বাড়ছে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম সাত মাসে বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে মারা গেছেন ২ জন। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকার সময় মারা গেছেন ৯ জন। গত বুধ (১৭ আগস্ট) ও শনিবার (২০ আগস্ট) গোয়েন্দা পুলিশ এবং হাতিরঝিল থানা হেফাজতে সিদ্দিক ও সুমন নামের যে ২ জন মারা গেছেন। তাঁদের দুইজনের মৃত্যু হিসাব করলে ২০ আগস্ট পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ জনে।
মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ নিহত হওয়ার ঘটনা এবং আইজিপি বেনজির আহমেদসহ সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বন্দুকযুদ্ধ এবং পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা কমে যায়।
“ আমরা এর শেষ পরিণতি দেখতে চাই। পুলিশের হেফাজতে মৃত্যু বন্ধ হয়নি। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বে থাকা পুলিশদের তদন্ত করে শাস্তির আওতায় আনতে পারলেই এ ধরনের অপরাধ কমে যাবে।”
– পুলিশ হেফাজতে জনির মৃত্যুর ঘটনায় মামলা দায়েরের আইনে প্রথম রায় পাওয়া বাদী ইমতিয়াজ হোসেন রকি
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে, ২০২১ সালের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) বন্দুকযুদ্ধে ৩৫ জন নিহত হয়, আর হেফাজতে মারা যায় ৩ জন। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ২ জন, আর হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের(২০ আগস্ট পর্যন্ত।
চুরির মামলায় গত শুক্রবার (২০ আগস্ট) হাতিরঝিল থানা-পুলিশ সুমন শেখ নামের এক তরুণকে গ্রেফতার করে। শনিবার সকালে তাঁর মৃত্যুর খবর জানাজানি হয় হলে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী সড়ক অবরোধ করে।
পরিবারের ভাষ্য, সুমন রামপুরায় ইউনিলিভারের পানিবিশুদ্ধকরণ যন্ত্র পিওরইটয়ের বিপণন অফিসে ছয় বছর ধরে কাজ করতেন। মাসে ১২ হাজার টাকা বেতন পেতেন। গত শুক্রবার রাতে সেখান থেকে পুলিশ তাঁকে মারতে মারতে থানায় নিয়ে যায়।
হাতিরঝিল এলাকাবাসীদের একটি সূত্র নিশ্চিত করে সুমন যেখানে চাকরি করতেন সেই মেসার্স মাসুদ অ্যান্ড ব্রাদার্সের এক কর্মকর্তা তাকে লাথি দেন। এ সময় পুলিশও অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে তাকে।
সুমনকে মারধরের অভিযোগের বিষয়ে জানতে হাতিরঝিল থানার ওসি আব্দুর রশিদকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি। অভিযান পরিচালনাকারী উপপরিদর্শক (এসআই) আদনান মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন বলেই ফোন কেটে দেন। থানার অন্য কর্মকর্তার সঙ্গেও গতকাল দিনভর ফোনে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তারাও ফোন ধরেননি।
দেরি হওয়ার তো কোনো কারণ দেখি না। মামলা হওয়ার পর তদন্ত হবে, এরপর অভিযোগপত্র দেবে। এখন যদি তদন্ত করতে দেরি হয়, অভিযোগপত্র দিতে দেরি হয়, তাইলে তো সেটা পুলিশের দায়িত্ব।’ যেসব মামলা অনেক দিন হয়ে গেছে, সেগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এতে আমাদের সবারই করণীয় আছে এগুলো দ্রুত শেষ করার জন্য।’
সুমনের স্ত্রী জান্নাত খাতুন, স্বজন ও সহকর্মীদের দাবি, সুমন আত্মহত্যা করতে পারেন না। তাকে থানায় নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। অথবা অমানুষিক নির্যাতনের কারণে তিনি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন।
এদিকে সুমনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা নিয়ে গতকাল রোববার দিনভর চলেছে নানা নাটকীয়তা। মরদেহ নিতে গেলে পুলিশ শর্ত দেয় বলে দাবি স্বজনদের। সেই শর্ত না মেনে স্ত্রী জান্নাত ঢাকার মুখ্য বিচার বিভাগীয় হাকিম আদালতে যান মামলা করতে। তবে তিনি বিকেল পর্যন্ত মামলা করতে পারেননি বলে জানান।
সুমনের স্ত্রী জান্নাত গতকাল বিকেলে বলেন, ‘হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর লাশ নিতে গেলে পুলিশ শর্ত দেয় লাশ নিয়ে রামপুরার বাসায় যাওয়া যাবে না। লাশ নিয়ে তাদের সোজা গ্রামের বাড়ি নবাবগঞ্জের বক্ত নগরে চলে যেতে হবে। আমি এ শর্ত মানি নাই।’
কান্না করতে করতে জান্নাত আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী এভাবে মারা গেল। এখন তার লাশও বুঝে পাচ্ছি না। কোর্টে আসছি আমার স্বামী হত্যার বিচার চাইতে। আমি দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করব। তবে মামলা করতে কেউই আমাকে সাহায্য করছে না। যে উকিলের সঙ্গে কথা বলে এসেছি তিনিও ফোন ধরছেন না।’
“দেরি হওয়ার তো কোনো কারণ দেখি না। মামলা হওয়ার পর তদন্ত হবে, এরপর অভিযোগপত্র দেবে। এখন যদি তদন্ত করতে দেরি হয়, অভিযোগপত্র দিতে দেরি হয়, তাইলে তো সেটা পুলিশের দায়িত্ব। যেসব মামলা অনেক দিন হয়ে গেছে, সেগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এতে আমাদের সবারই করণীয় আছে এগুলো দ্রুত শেষ করার জন্য।”
– মামলার সংখ্যা এবং বিচারে ধীরগতির বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার এইচ এম আজিমুল হক সাংবাদিকদের বলেন, পরনে থাকা ট্রাউজার দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন সুমন। এ ঘটনায় ডিউটি অফিসার হেমায়েত হোসেন ও হাজতের প্রহরী মো. জাকারিয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সুমনের স্ত্রী জান্নাত আরা দাবি করেছেন, পুলিশ তাঁকে আটকের পর থানায় নিয়ে মারধর করেছে। এতে তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে শনিবার বিকেলে বিক্ষুব্ধ স্বজনেরা থানার সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন।
আরেক ঘটনায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হেফাজতে থাকা সিদ্দিক আহাম্মেদ (৬২) নামের এক ব্যক্তি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মারা যান। গত মঙ্গলবার ডিবি পুলিশ রাজধানীর রমনা এলাকা থেকে এক হাজার ইয়াবাসহ তাঁকে গ্রেফতার করে। বুধবার রাতে তাঁকে অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, গ্রেফতার হওয়া সিদ্দিকের পেটে ইয়াবা বড়ি ছিল, সেগুলো গলে তিনি মারা গেছেন। আর সুমনের আত্মহত্যার ঘটনা সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। তবে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা আরও সচেতন হলে দুটো মৃত্যুই এড়ানো যেত বলে তিনি স্বীকার করেন।
হাফিজ আক্তার বলেন, এ ঘটনার পর হেফাজতে যেন কোনো নির্যাতনের ঘটনা না ঘটে, সে বিষয়ে নতুন করে আবারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ডিএমপির সবগুলো থানায় রাতে দায়িত্ব পালন করা সেন্ট্রি এবং অফিসারদের আরও সতর্ক থাকার বিষয়ে কমিশনারের পক্ষ থেকে বার্তা পাঠানো হয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং জবাবদিহির অভাবে প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটছে। মেজর সিনহার ঘটনার পর বন্দুকযুদ্ধ কমলেও তারপর যত সময় গেছে, এ সংখ্যা বেড়েছে। তিনি বলেন, উচ্চ আদালত থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আটক এবং জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করে দেওয়া হলেও কেউ তা মানছে না।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ২০২০ সালের (জানুয়ারি-জুলাই) মারা গেছেন ১৪ জন। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) পরিসংখ্যান বলছে, গত তিন বছরে পুলিশের হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ২৯ জনের। তাদের হিসাবে এ বছরই মারা গেছেন ১১ জন।
২০১৩ সালে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন প্রণয়নের পর বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় শাস্তির দেখা মেলে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে।
২০১৪ সালে পুলিশের হেফাজতে ইশতিয়াক হোসেন জনি নামে এক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলায় ছয় বছর পর পাঁচজন আসামির মধ্যে তিনজন পুলিশ সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। অপর দুজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন পল্লবী থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) জাহিদুর রহমান জাহিদ, এসআই রশিদুল ইসলাম এবং এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টু। যাবজ্জীবন ছাড়াও এক লাখ টাকা করে জরিমানা এবং দুই লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। জরিমানা ও ক্ষতিপূরণের অর্থ দিতে ব্যর্থ হলে আরও ৬ মাস করে কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
২০২০ সালের একটি হিসাব বলছে, এ পর্যন্ত নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে মামলা হয়েছে ১৯টি। এর মধ্যে ১৪টি মামলাতেই তথ্যগত ভুল দেখিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাকি ৫টির মধ্যে জনির মামলার রায় দিয়েছেন আদালত। বিচার কার্যক্রম চলছে দুটি মামলার, একটি উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে, বাকি মামলাটি তদন্তাধীন।
মামলার সংখ্যা এবং বিচারে ধীরগতির বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু বলেন, ‘দেরি হওয়ার তো কোনো কারণ দেখি না। মামলা হওয়ার পর তদন্ত হবে, এরপর অভিযোগপত্র দেবে। এখন যদি তদন্ত করতে দেরি হয়, অভিযোগপত্র দিতে দেরি হয়, তাইলে তো সেটা পুলিশের দায়িত্ব।’ যেসব মামলা অনেক দিন হয়ে গেছে, সেগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এতে আমাদের সবারই করণীয় আছে এগুলো দ্রুত শেষ করার জন্য।’
পুলিশ হেফাজতে জনির মৃত্যুর ঘটনায় মামলা দায়েরের আইনে প্রথম রায় পাওয়া বাদী ইমতিয়াজ হোসেন রকি বলেন, ‘আমরা এর শেষ পরিণতি দেখতে চাই। পুলিশের হেফাজতে মৃত্যু বন্ধ হয়নি। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বে থাকা পুলিশদের তদন্ত করে শাস্তির আওতায় আনতে পারলেই এ ধরনের অপরাধ কমে যাবে।’