:: মোস্তফা মামুন ::
আমারও একটা পিএইচডির গল্প আছে। নিজের পিএইচডি করার প্রশ্ন নেই, করেছে আমার স্ত্রী ড. হুমায়রা ফেরদৌস তানিয়া। বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই নরওয়ে সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে ডক্টরেট করতে চলে গেল। বছর খানেক পর আমিও গেলাম একবার, প্রচণ্ড শীত খেয়ে আর অর্ধেকটা ইউরোপ ঘোরার সুখ নিয়ে ফিরে এলাম। সেসব আলাদা গল্প কিন্তু তানিয়ার অভিজ্ঞতায় আমার মনে হয়েছিল পিএইচডি করা এমন কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। কয়েকবার বিমানে যাতায়াত করলেই হয়ে যায়। একবার বোনাস ইউরোপ বেড়ানোর বাইরে আমার আরেকটা ভূমিকা ছিল পুরো প্রক্রিয়ায়। ওকে প্লেনে উঠিয়ে দিতে এবং নিয়ে আসতে এয়ারপোর্টে যাওয়া। অতএব ড.আসিফ নজরুলের পিএইচডির গল্প পড়তে শুরু করেছিলাম একগুচ্ছ সাফল্য আর আনন্দের গল্প পড়ার মন নিয়ে। তিনি লেখক মানুষ। সুবাদে গল্পগুলো আকর্ষণীয় বর্ণণার ছন্দে খুবই উপভোগ্য হবে-এমনই ধারণা। সেসব গল্প যথেষ্ট আছে কিন্তু বইটাতে এর চেয়ে বেশি আছে পিএইচডি ব্যাপারটার মাহাত্ম্য।
পিএইচডি বড় ব্যাপার আমরা সবাই জানি, কত বড় আসিফ নজরুল জানিয়েছেন। তাঁর মত জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে সফল মানুষকে যে খাবি খাইয়েছে সেই সব গল্প অকপটে বলায় বইটা আর ঠিক আÍজৈবনিক গ্রন্থের মোড়কে আটকে থাকেনি। বাঁক-চমক, ক্লাইম্যাক্স-অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্সে কোথাও কোথাও রোমাঞ্চকর উপন্যাস। আসিফ নজরুলকে আমি সম্বোধন করি ‘স্যার’। এই সম্বোধনে বন্ধু-সহকর্মীরা কেউ কেউ একটু ধাক্কা খায়, প্রথম দিন শুনে তো একজন শুধরে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ওনাকে স্যার ডাকার দরকার নেই। উনি আমাদেরই লোক (সাংবাদিকতা অঙ্গনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে)।’আমি একটু রহস্য করে বললাম, ‘স্যারকে স্যার ডাকব না!’তিনি হাসলেন, ‘তা ঠিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলে কথা…আসিফ তো আবার ইউনিভার্সিটি টিচার।’আমিও হাসলাম, ‘উনি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না, আমারও শিক্ষক। আমাকে পড়িয়েছেন।’সত্যি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে তিনি আমার সরাসরি শিক্ষক। এই পিএইচডির কারণেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বড় একটা সময় অবশ্য তাঁকে পাইনি। মাস্টার্সের সময় ফিরলেন। ফিরেই একটা গোলমাল বাঁধিয়ে দিলেন। টিউটোরিয়াল পরীক্ষায় গার্ড দিতে এসে দেখাদেখি করার অপরাধে আমার খাতা কেড়ে নিয়ে গেলেন। এ যেন পুরো অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স। যাকে শিক্ষক হিসাবে পাওয়ার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করেছি, কবে ফিরবেন সেই খোঁজ নিয়েছি অন্য শিক্ষকদের কাছে, সেই ‘দূর প্রেম’ এমন ট্র্যাজেডিতে রূপ নেবে ভাবতেই পারিনি। ততদিনে সাংবাদিকতা করার কারণে স্যারদের কেউ কেউ আলাদা করে চিনতেন, কিছু বাড়তি সুবিধাও পেতাম পরীক্ষার হলে কিন্তু আসিফ স্যার খাতা আর ফেরতই দিলেন না। দিন কয়েক পরই প্রথম আলো অফিসে সাক্ষাৎ। উনি যাদের বন্ধু, তাদের কেউ কেউ ওখানে আমার বন্ধু। স্যার আলাদা করে সেদিনের ঘটনা মনে রাখেননি, অনেকের খাতা পরীক্ষার হলে কেড়ে নিতে হয় বলে এসব দুষ্কৃতিকারী ছাত্রদের কথা শিক্ষকদের মনে রাখা সম্ভব হয় না। আমি পরিচয় দিয়ে বিষয়টা মনে করিয়ে দিলাম। উনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘একেবারে ঠিক করেছি। আরেকবার হলে আরেকবার করব। যত যাই করো, পড়াশুনাটা ঠিকমত করতে হবে।’আমি তখন পড়াশোনার লাইন থেকে অনেক দূরে।
পিএইচডি সবার কাছে একটা বড় প্রাপ্তি। আসিফ নজরুলের কাছে বড় একটা ত্যাগও। এজন্যই আবার পিএইচডির গল্পটা শুধু মাধুর্যময় না হয়ে অম্ল মধুর হয়ে যায়। এক টক-মিষ্টিতে মেলানো প্রাপ্তি। পৃথিবীতে বঞ্চনা যেমন আছে তেমনি বঞ্চনা পুষে যাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। আর কোন কোনটা এমন অদ্ভুতভাবে হয় যে মানুষ নিজেই টের পায় না। স্যারের ক্ষেত্রে যেমনটা হল। তিনি গল্প-উপন্যাস থেকে একটু সরে গিয়ে মন দিলেন টক শো আর রাজনীতির বিশ্লেষণে। সাহসী-অকপট-অবিচল বিশ্লেষণে অল্প দিনেই মাত। হয়ে উঠলেন টিভি ব্যক্তিত্ব। কলাম লেখাতে দুই রকমের নিয়ম আছে। হয় ক্ষমতাসীনদের ঢোল বাজানো অথবা ভারসাম্যের নীতিতে দুই পক্ষকেই খুশি রাখা। তিনি সেই নিয়ম ভেঙ্গে দিয়ে এখানেও তুমুল জনপ্রিয়। সেই জনপ্রিয়তা সূত্রেই মানুষ খোঁজ নিতে গিয়ে দেখল, আরে এ-তো সেই আসিফ নজরুল। যে বিচিত্রায় দুর্দান্ত সব প্রচ্ছদ কাহিনী করেছে। দারুণ সব উপন্যাস লিখেছে ক্যাম্পাসের তরুণ নায়ক বা প্রতিনায়কদের নিয়ে। তাঁর কী কী বই আছে আর? সাহিত্য মর্যাদা ফিরে এল কলাম আর টক শো’র কাঁধে চড়ে। এখন আবার তুমুল বই বিক্রি হয়। বড় প্রকাশকরা লাইন দেন। পুরনো বইয়ের বকেয়া মিটিয়ে দিতে হাজির হয়ে যান বাসায়। দেখে দেখে মজা লাগে। কত পথে যে মানুষ প্রাপ্য বুঝে পায়! সময় লাগলেও ন্যায় প্রতিষ্ঠা হয়ে যায় একদিন। ‘পিএইচডির গল্প’ বই থেকে অনেক দূরে সরে গেছি। সেটা খুব অস্বাভাবিক নয়, বই তো একটা সৃষ্টি মাত্র, স্রষ্টার পরিচয়েই তো তাঁর সম্পূর্ণতা। বইয়ে একটা কৌতূহল ছিল। তিনি স্পষ্ট এবং অকপট, এ ধরণের মানুষের লেখায় রসিকতা কম থাকে। নিজের জীবনের গল্পও কি চলবে একই নিয়মে!
এই বিষয়ে আর কথা বাড়ানোর মানে হয় না। কথা বরং হতে থাকল খেলা নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে, কখনও রাজনীতি নিয়ে। আর অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, তার পছন্দ বা চিন্তার ধরণ যত না শিক্ষকসুলভ তার চেয়ে অনেক বেশি ছাত্রসুলভ। আজও তিনি সেটা রয়ে গেছেন বলে মনে হল পিএইচডির গল্প পড়তে পড়তে। মনে পড়ে, আমাদের মাস্টার্সের সময় একদিন করিডোর দিয়ে হেঁটে আসছেন। পরনে জিন্সের সঙ্গে চলতি সময়ের সঙ্গে মেলানো শার্ট। মাত্রই সিগারেটটা ফেলেছেন বলে ধুমপানের ছাপ রয়ে গেছে চেহারায়। আমাদের এক বন্ধু দেখিয়ে বলল, ‘আচ্ছা এই মানুষটাকে দেখলে কেউ বলবে ইউনিভার্সিটি টিচার।’‘কেন বলবে না?’‘ভঙ্গির মধ্যে একটা ক্যাডার-ক্যাডার ভাব। দেখ, হেঁটে যাওয়া দেখ…’দেখলাম। আমাদের বন্ধুদের অনেকেই জানত না কিন্তু আমি তাঁর ক্যাম্পাসের যুবক-নিষিদ্ধ কয়েকজন পড়ে ফেলেছি সেই বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায়। অভি জাতীয় দুর্ধর্ষ মানুষদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব নিয়ে বাজারের আওয়াজ কিংবা জাহানরা ইমামের সঙ্গে মমতার গভীরতা সব কিছু সম্পর্কে এত সম্যক জানি যে তাঁর হেটে যাওয়া কিংবা ভঙ্গি আমার মধ্যে কোনো পার্থক্য তৈরি করে না। সমস্যা হল, অন্যদের মধ্যে করত। অনেকেই এই কথা বলত (এখনও কী বলে?), ওনাকে ঠিক শিক্ষকের মত মনে হয় না।
ভেবে ভেবে মনে হয়, শিক্ষকের যে স্টেরিওটাইপ আমরা দাঁড় করিয়েছি, সেরকম সবসময় অদৃশ্য শাসনদণ্ড হাতে ঘুরে বেড়ান না বলে তাঁকে আর দশজন শিক্ষকদের মত মনে হয় না। তার চেহারা-ভঙ্গিতে শিক্ষকদের মত জ্ঞান বিতরণের ভীতির বদলে বরং ছাত্রদের মতো জানার-বোঝার চেষ্টা। ছাত্রদের সঙ্গে আড্ডায় তিনি সবসময় বক্তা নন। অনেক সময় স্রোতা। সেটাই তাঁকে ছাত্রদের কাছে নিজের একজন হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে। সে ধরে নেয়, এই মানুষটা সবকিছু আমার উপর চাপিয়ে দেবে না, আমাকে মর্যাদাও দেবে। কিন্তু তার জীবনে অনেক প্রাপ্তির মধ্যে হতাশার ব্যাপারও আছে কিছু। যেমন পিএইচডি করে ফিরে দুঃখভরে আবিষ্কার করলেন, তাঁর সাহিত্যে খ্যাতির জায়গাটা সময়ের কামড়ে ফিকে হয়ে গেছে। তখন ফেসবুক নেই যে দূরে গিয়েও নিজেকে হাজির রাখা যাবে। আর সাধারণ পাঠকরা সাধারণত ভুলো মনের। পুরনোকে মনে না রেখে নতুনকে নিয়ে হুল্লোড়ের এই আয়োজনে ৫-৭ বছরের বিরতির কারণে তাঁর সেই চাহিদা নেই। দুঃখভরে একদিন বললেন, ‘জানো, সেদিন স্টলে বসে ছিলাম, একটাও বই বিক্রি হয়নি। অথচ এই সময় অমুকের (তখন এবং এখনকার একজন জনপ্রিয় লেখক) বই হু হু করে বিক্রি হচ্ছে।’তিনি মানবেন কি না জানি না কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে সেই লেখকই তাঁর শূন্য স্থানের অনেকখানি নিয়ে নিয়েছেন। ধীরে ধীরে একসময় সৃজনশীল লেখালেখি প্রায় ছেড়েই দিলেন। তাঁর ছাত্র এবং শুরুর দিকের পাঠক হিসাবে হতাশই হলাম। কিছু প্রকাশকের সঙ্গে আলাপও করলাম। প্রকাশকদের এক কথা-গ্যাপ দেয়াটা তাঁর ঠিক হয়নি। অন্যের দুঃখ নিয়ে কেউ বসে থাকে না। পাঠক-প্রকাশক-বইয়ের বাজার চলে তার নিষ্ঠুর বর্তমানের নিয়মে। সেই হিসাবে কিন্তু এই পিএইচডিটা তাঁর বড় একটা ক্ষতিও করেছে।
পিএইচডি সবার কাছে একটা বড় প্রাপ্তি। আসিফ নজরুলের কাছে বড় একটা ত্যাগও। এজন্যই আবার পিএইচডির গল্পটা শুধু মাধুর্যময় না হয়ে অম্ল মধুর হয়ে যায়। এক টক-মিষ্টিতে মেলানো প্রাপ্তি। পৃথিবীতে বঞ্চনা যেমন আছে তেমনি বঞ্চনা পুষে যাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। আর কোন কোনটা এমন অদ্ভুতভাবে হয় যে মানুষ নিজেই টের পায় না। স্যারের ক্ষেত্রে যেমনটা হল। তিনি গল্প-উপন্যাস থেকে একটু সরে গিয়ে মন দিলেন টক শো আর রাজনীতির বিশ্লেষণে। সাহসী-অকপট-অবিচল বিশ্লেষণে অল্প দিনেই মাত। হয়ে উঠলেন টিভি ব্যক্তিত্ব। কলাম লেখাতে দুই রকমের নিয়ম আছে। হয় ক্ষমতাসীনদের ঢোল বাজানো অথবা ভারসাম্যের নীতিতে দুই পক্ষকেই খুশি রাখা। তিনি সেই নিয়ম ভেঙ্গে দিয়ে এখানেও তুমুল জনপ্রিয়। সেই জনপ্রিয়তা সূত্রেই মানুষ খোঁজ নিতে গিয়ে দেখল, আরে এ-তো সেই আসিফ নজরুল। যে বিচিত্রায় দুর্দান্ত সব প্রচ্ছদ কাহিনী করেছে। দারুণ সব উপন্যাস লিখেছে ক্যাম্পাসের তরুণ নায়ক বা প্রতিনায়কদের নিয়ে। তাঁর কী কী বই আছে আর? সাহিত্য মর্যাদা ফিরে এল কলাম আর টক শো’র কাঁধে চড়ে। এখন আবার তুমুল বই বিক্রি হয়। বড় প্রকাশকরা লাইন দেন। পুরনো বইয়ের বকেয়া মিটিয়ে দিতে হাজির হয়ে যান বাসায়। দেখে দেখে মজা লাগে। কত পথে যে মানুষ প্রাপ্য বুঝে পায়! সময় লাগলেও ন্যায় প্রতিষ্ঠা হয়ে যায় একদিন। ‘পিএইচডির গল্প’ বই থেকে অনেক দূরে সরে গেছি। সেটা খুব অস্বাভাবিক নয়, বই তো একটা সৃষ্টি মাত্র, স্রষ্টার পরিচয়েই তো তাঁর সম্পূর্ণতা। বইয়ে একটা কৌতূহল ছিল। তিনি স্পষ্ট এবং অকপট, এ ধরণের মানুষের লেখায় রসিকতা কম থাকে। নিজের জীবনের গল্পও কি চলবে একই নিয়মে! না, এখানে দারুণ কিছু রসে টইটুম্বুর জায়গা আছে। যেমন পুল খেলা দেখে তিনি ভাবলেন, এ আর এমন কী! এখানে নিজের দক্ষতা সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে খেলা শুরুর সময় মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদেশীদের তিনি মুগ্ধ করে দেবেন। পরের লাইনটা এরকম, ওরা মুগ্ধ হয়েই দেখল। কারণ আমি বল ফেলব কি, বলে লাগাতেই পারছিলাম না! আবার নিজের বেলবটম প্যান্টের যে বর্ণণা দিয়েছেন, ‘কি-রে প্যান্ট না লুঙ্গী পরছস?’ তাতেও যে দৃশ্য তৈরি হয় সেটা সদ্য মেট্রিক পাশ করা আশির দশকের এক তরুণকে অসাধারণভাবে প্রকাশ করে। সে ফুটানি করতে চায়। তাতে তাঁর স্বপ্ন ফুটে ওঠে। ধরা খায়। তাতে বন্ধুত্বের মজা এবং ধরণটা ধরা পড়ে।
অকপট এবং সাহস তাঁর বৈশিষ্ট্য, কাজেই নিজের প্রেম-বিয়ের স্মৃতিতে লুকোছাপা না থাকারই কথা। তবু বিয়ের ক্ষেত্রে যে আত্মোপলব্ধি, নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো্– অক্ষরে প্রকাশের সাহস কয়জন দেখায়। বইয়ে সে অংশ সামান্য কিন্তু অসামান্য হয়ে ওঠে এর মায়াময়তায়। দুর্ধর্ষ সুন্দরী ক্লাসমেটের প্রেমে পড়ে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রদের প্রায় সবার জীবনের ঘটনা। কিন্তু ঘটনা চরম বিষাদের মাত্রা পায় শেরি নামের সেই বান্ধবীর মৃত্যুতে। মৃত্যুতে ভেংগে পড়ে তিনি বসে থাকতেন তাঁর কবরের পাশে। এই বর্ণনা পড়ার সময় চোখে জল না এলে চোখের জলের মানেই থাকে না কোন! আবার ডিগ্রি না হতে পারে এই ভয়ে নিজেকে খোদার কাছে সমর্পন করে তাবলিগে যাওয়ার গল্প আছে। আছে এমনকি আমার নিজেরও না জানা সেই কাহিনী, যেখানে তিনি কয়েক মাস ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি করেছেন। আর এভাবেই বইটি আর ঠিক একমুখী একটা অর্জনের গল্প নয়। নানামুখীতা, স্বপ্ন-স্বপ্ন ভেস্তে যাওয়ার ভীতি, চমক, বাঁক, নাটক, প্রতিচরিত্রের উপস্থিতি মিলিয়ে রোমাঞ্চকর রচনা। বাতিঘর বইয়ের লাইব্রেরি থেকে প্রকাশনায় নেমে বেশ নাম করে নিচ্ছে অল্প সময়ে, এই বইটা তেমনি অগ্রগতির প্রকাশ। প্রচ্ছদ, ছাপা, বাইন্ডিং মিলিয়ে প্রডাকশন ভালো। দীপংকর দা’র বিপণন কৌশলও ভালো বলে বইটা প্রচারও পাচ্ছে বেশ। দ্বিতীয় মুদ্রণ হয়ে এখন তৃতীয়টার অপেক্ষায়। ও, হ্যাঁ, শেষে বলব বলে আরেকটা কথা বলিনি।
যারা তাঁকে চেনেন তারা জানেন অন্যের সুখ্যাতি করাটা তাঁর চরিত্রের স্বাভাবিকতা এবং সে ক্ষেত্রে তিনি বাছবিচার করেন না। নিজের ছাত্রসম কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বীদর যেভাবে ভাসিয়ে দেন গুণকীর্তনে তাতে মাঝে মধ্যে চমকে যাই। এখানে যা করেছেন ফিলিপের ক্ষেত্রে। সুপারভাইজার ফিলিপ, তাঁকে খুব পছন্দ করছে না বলে নিজের পিএইচডি করাটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে তবু তাঁর গুণগান থামছেই না। বারবার জানাচ্ছেন, এই ৩৪ বছর বয়সী ফিলিপ নিজের ক্ষেত্রে বিশ্বসেরাদের একজন। তাঁকে যে পাত্তা দিচ্ছে না সেই দোষের দেয়ালে ফিলিপের অর্জন ঢাকা পড়ছে না। এটা বইয়ের বস্তুনিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠিত করে আর পড়তে পড়তে আমার মনে পড়ে আরেকটা পুরনো ব্যক্তিগত গল্প। সেই গল্প যা তাঁর চরিত্রের উদার আর ছাত্রপ্রীতির অংশটাকে আরও প্রতিষ্ঠিত করে। ২০০৩-০৪ সালে একদিন প্রথম আলো অফিসের বারান্দায় পেলেন আমাকে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে বললেন, ‘তোমার কলেজ ক্যাপ্টেন বইটা আমি পড়েছি। এই বই লেখার জন্য তুমি একটা সিগারেটের দাবিদার।’ এমন স্তব্ধ হয়ে গেলাম যে হাত বাড়াতেও ভুলে গেলাম। কথা বের হতে সময় লাগল অনেক। আমি অনেক সিগারেট খাই। সেদিন এক বন্ধু হিসাব করে দেখাল, প্রায় ২০-২২ লাখ টাকার সিগারেট খেয়ে ফেলেছি এই জীবনে। কিন্তু স্যার, আপনার সেই একটি সিগারেটের স্বাদ আজও ঠোঁটে লেগে আছে!
লেখকঃ ক্রীড়া সাংবাদিক