:: তৈয়েবুর রহমান গালিব ::
তপুকে খুব ভাল করে মনে আছে আমার। তপু আমার চার বছরের জুনিয়র। ঢাকা মেডিকেলে দুদিন শ্বাসকষ্টে ভোগার পর টেস্টে তার মায়ের করোনা পজিটিভ আসায় মুগদা হাসপাতালে নেয়া হয়। এবং গতকাল সন্ধ্যায় তপুর মা মারা যান।
তপুকেও এর পরবর্তীতে টেস্ট করা হয় এবং তারও করোনা ভাইরাস পজিটিভ আসে। আমি পুরো ঘটনার দিকে খেয়াল রাখি কারন আমার স্ত্রী তপুর মায়ের ডাক্তার ছিলেন এবং তাকে নিজে স্যুপ বানিয়ে খাইয়েছেন। আমি আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম, আন্টির বেশি একা লাগলে তাকে কিছু বই দিয়ে এসো। তপুর মা চলে যাবার পর কাল তার জানাজা হয়। এবং আমি জানতে পারি তাকে এটেন্ড করার কারনে আমার স্ত্রীকে কোয়ারেন্টিনে চলে যেতে হয়। সোমবার হয়ত তারও টেস্ট করা হবে।
এই তো, আমি কিছুদিন আগেও ভাবতাম, দেশ ছেড়ে চলে যাবো। কিন্তু যেদিন ডাঃ মইনুদ্দিন স্যার চলে গেলেন, আমার মনে হলো, আমি এদেশের মানুষের জন্যই বেচে থাকবো। আমার অগ্রজ, ইচ্ছা করলেই যিনি বাইরে চলে যেতে পারতেন, তিনি যেমন নির্ভীকচিত্তে মানুষের জন্য জীবন দিয়েছেন, আল্লাহ আমাকেও কবুল করুন। যেদেশ আমার যুদ্ধস্থল ছিল, সেদেশই আমাকে মাটি করুক।
অথচ খুব অল্প সময়ের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র মইনুদ্দিনের সাথে আমার কথা হয়। ব্যক্তিগত পরিচয় আমাদের ছিলো না। কোন একটা ব্যাপারে কয়েকদিন ফোনে আমরা কথা বলেছিলাম। বড় ভাল মানুষ ছিলেন। মইনুদ্দিন স্যারের বাবা মারা গিয়েছিলেন খুব ছোট বয়সে এবং খুব স্ট্রাগল করে তাকে এ পর্যন্ত আসতে হয়েছে। ভাগ্যের কি নির্মমতা তার সন্তানদেরও একই রাস্তা পার করতে হবে। আমি আমার দেশের কাছে সেদিনই কথা দিয়েছি, মইনুদ্দিনের লাশ যেদেশে শুয়ে আছে, মইনুদ্দিনের সন্তানদের ছেড়ে আমি চলে যাবো না।
পরদিন মইন স্যারের লাশ চলে গেলো গ্রামে। অনেকে চেয়েছিলো তাকে ঢাকাতেই রেখে দিতে। কিন্তু তিনি ফিরলেন এলাকাবাসীর দাবীর মুখে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যেদেশের সাধারন মানুষ এত সুন্দর, যারা ভালবাসা বুঝে তাদেরকে আমার সম্মান করতেই হবে। আমি আজ জানি এদেশের মানুষকে যারা দিয়েছে, তাদের কখনো মানুষের ভালবাসা পেতে অপেক্ষা করতে হয় নি।
কিন্তু আজকে আমি আবার ধাক্কা খেয়েছি। আমার স্ত্রী যে তপুর মায়ের জন্য কোয়ারেন্টিনে চলে গেলো সেই ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র তপুর মা সরকারের তৈরি করোনা মৃত্যুর তালিকায় স্থান পান নাই। সরকারি হিসাব মতে ২৩ এপ্রিল ২০২০ তারিখে মোট চারজন মৃত্যুবরণ করেছেন, যারা সবাই পুরুষ। তাহলে এর মধ্যে তপুর মা কোথায়! তপুর মাকে কেন স্বীকৃতি দেয়া হলো না!
ক’দিন আগে সিলেট থেকে এক স্নেহের অনুজ ফোন করেছিলো। তারা ইন্টার্নরা জয়েন করবে কি না, বুঝতে পারছে না। আমি বলেছিলাম, এটা তো সুযোগ নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার। অনুজ, নির্দ্বিধায় পাশে এসো। দেশকে মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে আনতে তোমাদের হাতগুলো আমাদের হাতের পাশে প্রয়োজন। আমরা থাকতে কেন এদেশ হেরে যাবে! আমরা অবশ্যই আমাদের পূর্বপুরুষদের মত লড়াই করবো। আমাদের জ্ঞান দিয়ে, আমাদের সাহসিকতা দিয়ে। আর বিশ্বাস করো, লড়াই করে হেরে যাবার মাঝেও অহংকার আছে, পালিয়ে যাবার মাঝে কিচ্ছু নেই। অনুজ কথা রেখেছে। পরদিনই সিলেট মেডিকেলে ইন্টার্নরা জয়েন করেছে। কিন্তু আজ তো ভয় হচ্ছে, এই তরুনরা যারা কাজ করতে নামলো, তারা কেউ অসুস্থ হলে রাস্ট্র লুকিয়ে ফেলবে না তো!
তথ্য লুকোচুরির অভিযোগ প্রথম থেকেই ছিলো। পরিচয় প্রকাশ না করার শক্ত কারনও রাস্ট্র বের করে ফেলেছিলো। কিন্তু এ কেমন ব্যবস্থা! একজন মানুষের পরিচয়, যার মৃত্যুর পুরোটা আমি জানি, তাকে কিভাবে রাস্ট্র লুকিয়ে ফেললো! তপুর মায়ের ব্যাপারটা দেশব্যাপি আলোড়িত ঘটনা না হলেও ঢাকা মেডিকেলের আলোড়িত ঘটনা। আর আলোড়িত বলেই এই ঘটনাকে লুকিয়ে গিয়ে রাস্ট্রকে অবশ্যই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। করোনা নিয়ে কেন এই লুকোচুরি! তবে কি এতদিন যারা লুকোচুরির অভিযোগ করেছিলো তারাই সঠিক!
এখন তো আমার আশঙ্কা হচ্ছে, আক্রান্তের যে সংখ্যা প্রকাশ করা হচ্ছে, সেখানে কতটা লুকোচুরি হচ্ছে! একজন চিকিৎসকের মা, যিনি মৃত্যুর আগেই করোনা পজিটিভ, যার সন্তান করোনা পজিটিভ তাকে লুকিয়ে ফেলা হলো! আমি কি এখন দাবী করবো, করোনা আক্রান্ত হয়ে যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের পরিচয় জানিয়ে দেয়া হোক!
এখন আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, ২৩ এপ্রিল ২০২০ তারিখে যে ৫০৩ জনের আক্রান্তের কথা বলা হয়েছে, সেখানে তপু আছে তো!