:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে বুধবার (৩০ আগস্ট) রাজধানীর কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে এক অনুষ্ঠানে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা এক হয়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে পাওয়ার আকুতি জানান।
বাংলাদেশে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে এ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে ‘মায়ের ডাক’ সংগঠন।
অনুষ্ঠানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পরিবারের সদস্যরা বক্তব্য দিয়ে এভাবেই তাদের অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তোলেন। এদের মধ্যে কেউ গুম হওয়া ব্যক্তির সন্তান, স্ত্রী, মা কিংবা বোন।
মৃত্যুর আগে নিজের ছেলেকে দেখে যাওয়ার আকুতি জানালেন গুমের শিকার সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা খাতুন। তিনি কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘আমি গুম হওয়া সুমনের মা। আজকে এত বছর হয়ে গেছে দুই নাতিন নিয়ে আছি। ছেলের কোনো খোঁজ পাই না। আপনারা দোয়া কইরেন, মরার আগে যেন আমার ছেলেকে দেখে যেতে পারি।’
২০১৪ সালে নিখোঁজ হওয়া চঞ্চল হোসেনের ১০ বছর বয়সী ছেলে আহাদ হোসেন বলেন, ‘আমার বন্ধুরা যখন জিজ্ঞেস করে তোমার বাবা কোথায়- আমি বলি, বিদেশে।’
একই বছর নিখোঁজ হওয়া মফিজুল ইসলামের ছেলে সহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বাবা গুম হওয়ার ৩ মাস পর মা আইন ও সালিস কেন্দ্রে যাওয়ার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। যখন মায়ের লাশ আনতে যাই, তখন থানায় বাবা মৃত লিখে মায়ের লাশ নিয়ে আসতে হয়েছে।’ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সহিদুল বলেন, ‘কথা না বললে আজ আমরা কাঁদছি, কাল আপনারাও কাঁদবেন।’
খিলগাঁওয়ে গুলিতে নিহত নুরুজ্জামান জনির বাবা ইয়াকুব আলী বলেন, ‘একটা মানুষকে খুন করতে কয়টা গুলি লাগে? আমার জনিকে ওরা ১৮টা গুলি করেছিল।’
মায়ের ডাকের আহ্বানে অনুষ্ঠানে এসেছিলেন ২০১২ সালে নিখোঁজ বরিশালের ছাত্রদল নেতা ফিরোজ খানের স্ত্রী আমেনা আক্তার। তিনি বলেন, তিন মাসের ব্যবধানে ফিরোজ খান ও তাঁর ভাই মিরাজ খান নিখোঁজ হন। তারপর থেকে আর কোনো খোঁজ নেই। তাঁরা দুজনেই বিএনপির রাজনীতি করতেন। স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর নিরাপত্তার কারণে তিনি বরিশাল থেকে পিরোজপুরে চলে যান। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে সেখানে তিনি সেলাইয়ের কাজ করে মানবেতর জীবন পার করছেন।
২০১৩ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকার মিরপুর থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন মিরাজ খান। এর চার মাস পর চট্টগ্রাম ঈদগাহ এলাকা থেকে মিরাজের ভাই ফিরোজ খানকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ফিরোজ খানের স্ত্রী আমেনা আক্তার বৃষ্টি বলেন, ‘গত ১১টা বছর সেলাইয়ের কাজ করে ছেলেকে নিয়ে কোনো রকম বেঁচে আছি।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি খালেদ হাসানকে ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। ঘটনার ১০ বছর পরও তাঁর কোনো খোঁজ নেই। আজকের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন খালেদ হাসানের স্ত্রী শারমিন সুলতানা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোহেলের একটি মোটরসাইকেল ছিল। রাতে হঠাৎ মোটরসাইকেলের আওয়াজ পেলেই ভাবি, সোহেল (খালেদ হাসান) হয়তো ফিরেছে। সোহেল আর ফিরে না। জানি না সে বেঁচে আছে, নাকি মরে গেছে। আমার পরিচয় এখন গুম সোহেলের স্ত্রী আর আমার সন্তানের পরিচয় গুম সোহেলের ছেলে। আমার একটাই দাবি, আমার স্বামীকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিন।’
২০১০ সালের ২৫ জুন রাজধানীর ইন্দিরা রোড থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় ঢাকার শাহবাগ এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমকে। এরপর থেকে তাঁর আর খোঁজ নেই। আজকের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন চৌধুরী আলমের ভাই খোরশেদ আলম। তিনি সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে বলেন, ‘আমার ভাই কোন অপরাধে ১৩ বছর ধরে গুম হয়ে আছে জানি না। আমি বিচার চাইব না, কোনো মামলা করব না, কোনো প্রতিবাদও করব না। শুধু ভাইয়ের লাশটা ফেরত চাই। একটাই চাওয়া আমার, ভাইকে যেন নিজ হাতে কবর দিতে পারি, ভাইয়ের লাশ একবার ছুঁয়ে দেখতে পারি।’
অনুষ্ঠানে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘শেখ হাসিনা সব জানেন, শুধু জানেন না মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা। তার মনে কোনো দয়া-মায়া নেই। যতই কাঁদেন তার চোখের কোনাও ভিজবে না। এই সরকার যত দিন আছে তত দিন গুম হয়ে যাওয়া মানুষের কোনো খোঁজ পাওয়া যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মানুষকে গুম করা হয়েছে। ভিন্ন মতের মানুষের মধ্যে ভয় সৃষ্টির জন্য গুম করা হচ্ছে। অধিকাংশ গুমের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন বাহিনী ও দলীয় লোকজন জড়িত। এই সব গুমের বিচার যারা করছেন না, তাদেরও বিচার হবে। দেশে না হলেও আন্তর্জাতিক আদালতে হবে। তিনি বলেন, যদি আমরা গুমের বিচার চাই, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই- তাহলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আমরা কোনো প্রতিশোধের রাজনীতি করি না। কিন্তু যারা খুনি ডাকাত এবং প্রতিটি গুমের জন্য দায়ী তাদের বিচার করা হবে। দেশকে আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক ধারায় নিয়ে যাবো। সেই লড়াইয়ে আমরা গুম হওয়া পরিবারের সকলের সঙ্গে ভাই-বন্ধু হিসেবে এগিয়ে যাবো। আমরা আপনাদের সঙ্গে ছিলাম, আপনাদের সঙ্গে আছি এবং শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গে থাকবো।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, এই সরকার টিকে থাকলে আরও গুম-খুন করবে। যারা এখন নিজেদের নিরাপদ ভাবছেন তাদের ঘরেও হাত যাবে। গুম-খুন করে তারা ভয় দেখাতে চায়। এই ভয়কে অকার্যকর করতে পারলে একদিনেই এই সরকারের পতন সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, এই সরকার বাসে আগুন দেওয়া, হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দেওয়া, মাদক ধরিয়ে দেওয়াসহ নানা ধরনের চক্রান্তের জালসহ সবকিছু করবে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে মানুষের শক্তি নিয়ে আমরা রাজপথে দাঁড়াবো। তাদের সব শক্তিকে আমরা নস্যাৎ করে দেব- সেই শপথ আমাদের নিতে হবে। আপনারা কেউ ভয় পাবেন না। কারণ, ওই ভয় পাওয়ানোটাই তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, এই সরকার আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চায়। এ লক্ষ্যে বিরোধী দল নির্মুল করার জন্য তাদের একটা টার্গেট থাকবেই। আগামী দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। তাই বিরোধী দলের যেসব ভাইয়েরা রাজপথে আন্দোলন করছেন তাদেরকে এক থাকতে হবে। হয় লড়ো, না হয় মরো।
গুমের ঘটনায় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন মায়ের ডাকের সমন্বয়কারী আফরোজা ইসলাম আঁখি। তিনি বলেন, ‘মায়ের ডাক গুম বন্ধ করাসহ গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের কাছে অবিলম্বে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে হয়রানি বন্ধ করা এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানাচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গুমের সব অভিযোগের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। গুমসংক্রান্ত জাতিসংঘের ওয়ার্কিং কমিটিকে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে।’
হাজেরা খাতুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন- বিএনপির মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল, জেএসডির তানিয়া রব, মায়ের ডাকের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম তুলি প্রমুখ। অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বেশ কয়েকটি দেশের দূতাবাস ও হাইকমিশনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।