রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অর্থনীতি

:: ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব ::

একমূখী রাষ্ট্রীয়করণ থেকে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ভারসাম্যপূর্ণ বাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করেন।

জিয়াউর রহমান সরকার সমাজতান্ত্রিক মেরুকরণকৃত একমুখী নীতি কৌশল থেকে সরে এসে অর্থনীতি, শিল্পনীতিতে  গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক নীতিপদ্ধতির মাঝামাঝি একটা মধ্যপন্থী ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা তৈরি করে। এসময় গুরুত্বপূর্ন প্রায়  সকল নাগরিক সেবাকে সরকারি খাতে রেখেই বেসরকারি শিল্প বিকাশের পথে হাঁটা হয়। 

দ্রুত দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জিয়াউর রহমান জনপ্রিয় করেছেন তিনটি উৎপাদন মূখী অর্থনৈতিক ধারা। এক — কৃষির সবুজ বিপ্লব। দুই — গণশিক্ষা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযান। তিন — শিল্প উৎপাদন। এসময় সম্পূর্ণ নতুন ধরনের দুটি শ্রমবাজার তৈরি হয় বাংলাদেশে। এক — তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজার। দুই —  মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক প্রবাসী শ্রমবাজার। এর বাইরেও আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ  উদ্যোগ ছিল যা হচ্ছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করা। তিনটি অর্থনৈতিক ধারা এবং দুটি শ্রম বাজার পরবর্তিকালের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিমূল হিসেবে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু বংলাদেশ একটি বাজারমুখি রাষ্ট্র এবং যার সূচনা জিয়াউর রহমানের শাসনকালেই, তাই অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও এটা বলা যায় যে, মূলত এই সময়কালে সূচিত পরিবর্তন গুলোর ভিত্তিতেই পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশ ও গতিপথ আবর্তিত হয়েছে।  বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান তিনটি অর্থনৈতিক স্তম্ভ হচ্ছে কৃষি, প্রবাসী শ্রমবাজার এবং তৈরি পোশাক শিল্প। এই তিনটি অর্থনৈতিক বুনিয়াদ এই সময়েই সূচিত হয়েছিল।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকালে ক্ষুধার তাড়নায় নিন্মবিত্ত ও নিন্মমধ্যবিত্ত স্রোতের মত নগরে বিশেষ করে ঢাকায় ছুটেছেন,যাঁদের অনেকেই পরে গ্রামে ফিরে যাননি। অন্যদিকে গ্রামীণ কৃষিতে সেচের সমস্যা ও অযান্ত্রিক শ্রমের প্রাচুর্য ছিল বলে সেখানে কৃষির কাজে অধিকতর সংখ্যায় শ্রমিক নিয়োজিত ছিল, ফলে বাংলদেশের গ্রামে গ্রামে ছদ্মবেকারত্বের প্রাচুর্যছিল। শ্রমঘনীভবনের দুর্ভিক্ষকালীন ধারা এবং আগে থেকেই বিরাজমান কৃষির ছদ্মবেকারত্ব —  এই দুটি ধারা জিয়াউর রহমানের আমলে শ্রমবাজারে রূপান্তর ঘটে। এসময় গণচীন পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন সহায়তায় তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ নতুন এক শ্রমবাজারের পাশাপাশি, মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক প্রবাসী শ্রমের আরেকটি নতুন বাজার গড়ে উঠে। পাশাপাশি অলস ভাতার পরিবর্তে কাজের বিনিময়ে অলস শ্রমকে উৎপাদনমুখী কাজে জড়িত করায়, খাল খনন করে সেচের সুবিধা তৈরির ফলে কৃষিতে ও সবুজবিল্পব আসে। ফলে দেশে প্রায়োগিক পূঁজি ও মানবপূঁজি উভয়ের বহুবিধবিকাশ শুরু হয়। এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে মধ্যবিত্ত বিকশের পথ ও তৈরিহয়।

ফলস্বরূপ জিয়াউর রহমানের শাসনামলের মাঝের ও শেষ এই দুটি অর্থবছরে (১৯৭৭-৭৮ এবং ১৯৮০-৮১) বাংলাদেশ সাত শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। জিয়াউর রহমান ও আব্দুস সাত্তার দুই রাষ্ট্রপতির সময়ে  বাংলাদেশের মাথাপিছু স্থূল দেশজ উৎপাদন গড়ে ৪.৫২% হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল, , যা নব্বই দশকের আগের সময়ে গড় হিসেবে সর্বোচ্চ।

বছর  মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার

১৯৭৭ ২.৬৭%

১৯৭৮ ৭.০৭%

১৯৭৯ ৪.৮০%

১৯৮০ ০.৮২% (বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাক্রান্ত বছর)

১৯৮১ ৭.২৩%

গড় মোট দেশজ উৎপাদনের  (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৪.৫২%

ছক —  জিয়াউর রহমান ও আবদুস সাত্তার দুই রাষ্ট্রপতির সময়ে  মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার। তথ্যসূত্র —  বিশ্বব্যাংক।   

বিবিধ কারণে জিয়াউর রহমানের শাসনামলের শুরুর সময়কাল পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধকালীন যুদ্ধবিদ্ধস্ত অবকাঠামোগত পুরোপুরি পুনর্ঘটিত হতে পারেনি। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ,  ১৯৭৫ সালের বাকশাল ও সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডসহ সার্বিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন জনিত বড় বড় দুর্ভাগ্যজনক অস্থিরতাগুলো বাংলাদেশের অর্থনিতিকে ভুগিয়েছে। দেশে সার্বিক স্থিতিশীলতা আনয়ন করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।

বহুমুখী বাস্তবধর্মী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে তিনি রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হন। প্রথমেই প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রকে ঢেলে সাজানো হয়। এরপর সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করা হয়। প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীকে পুরো নিয়ন্ত্রণে এনে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে অনেকটা পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর আদলে বাস্তবায়ন করা হয়। এর একটি দিক ছিল সামাজিক অংশগ্রহণ ও অপরদিকে সামরিক প্রশিক্ষণ। এ সময়ে খাল খনন, গণশিক্ষা, গ্রাম সরকার, ভিডিপির মতো বিভিন্ন কর্মসূচিতে নাগরিকদের সরাসরি যুক্ত করা হয়েছে, গ্রাম বা গণমানুষকে ভিত্তি করে বিভিন্ন কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে। জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ধারণার বিভিন্ন পরিকল্পনার মধ্যে একধরনের গণভিত্তিক আর্থ-সামাজিক  কর্মসূচি লক্ষ করা যায়। এমনকি কৃষিজমির আল বা বিভাজনও তুলে দেওয়ার কথা জিয়া বলেছিলেন। অনেকেই মনে করেন, দেশে কৃষি খাতে যৌথ খামার পদ্ধতি শুরু করার পরিকল্পনা হয়তো ছিল জিয়া সরকারের। জিয়াউর রহমান সরাসরিই কৃষি সমবায় এবং সমবায় বাঁধের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে উদার অর্থনীতির সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থার সমন্বয়ের চিন্তাও থাকতে পারে। অর্থনৈতিক কর্মসূচী দৃষ্টিতে জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে একধরনের মিশ্র ব্যবস্থা বলা যেতে পারে। তৃণমূলে গণভিত্তিক উৎপাদন ও শাসনব্যবস্থা প্রয়োগের চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এসবের পাশাপাশি মৌলিক সেবা খাতকে সরকারি আয়ত্বে রেখে পশ্চিম ইউরোপীয় ধারার এক ধরণের নিয়ন্ত্রিত বেসরকারি খাতের উৎসাহিত করা হয়েছে, এই বিকাশ সাধনে ব্যাংক ঋণ কর্মসুচীও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যেমন আগে সেচ ও কৃষি যন্ত্রের খাত পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু জিয়ার আমলে কৃষিতে খাতে বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়। সেচের জন্য গ্রামে গ্রামে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল গড়ে ওঠে। একজন সেচযন্ত্র কিনে অন্যদের চাষের জমিতে পানি সরবরাহ করত। এ ধরনের গণভিত্তিক উৎপাদন প্রক্রিয়া সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে দেখা যায়। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর সময়ে একুশে ও স্বাধীনতা পদক প্রদান করা শুরু হয়। জাতীয় লোকসংগীত উৎসব, জাতীয় নাট্যোৎসব, জাতীয় বার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী, বেতার-টিভির সম্প্রসারণ, টিভির রঙিন সম্প্রচার, জাতীয় শিশু-কিশোর পুরস্কার প্রবর্তন, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শুরু করা, চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান তহবিল গঠন, ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভ চালু করা, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয়। মেয়েদের স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়।

নিন্মে এই সময়ের উল্লেখযোগ্য দিক গুলোর বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করা হয়েছে। 

স্থিতিশীলতা

১। গ্রামাঞ্চলে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধ করে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা প্রদান ও গ্রামোন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী (ভিডিপি) গঠন। 

২। তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামের জনগণকে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তকরণ এবং সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে দেশ গড়ার কাজে নেতৃত্ব সৃষ্টি করার লক্ষ্যে গ্রাম সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন।

৩।রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই জিয়াউর রহমান চরম বিশৃঙ্খল দেশে শান্তি শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন।‍ সশস্ত্র বাহিনীতে মোটামুটি একটা শৃঙ্খলা ফিরে আসে। কঠোর প্রশিক্ষণ ব্যাবস্থার মাধ্যমে ‍সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে পেশাগত শৃঙ্খলা উন্নয়নের কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় এবং সদস্য সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করা হয়।  সামরিক পুনর্গঠনের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর সাথে উষ্ণ কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে বিমান পরিবহন সংস্থা বিমানের আধুনিকীকরণও সম্পন্ন হয়েছিলেন। 

৪। বাংলাদেশ মহিলা পুলিশ প্রতিষ্ঠা। 

কৃষি

১। আবাদী জমি তিন গুণ করার উদ্যোগ নিয়ে সেচব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাশ্রম ও সরকারি সহায়তার সমন্বয় ঘটিয়ে ১৪০০ খাল খনন ও পুনর্খনন ছিল এই সময়ের একটা বড় উদ্যোগ।

২। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও দেশকে খাদ্য রপ্তানির পর্যায়ে উন্নীতকরণের উদ্যোগ।

৩। দারিদ্র্য বিমোচনে ড. আখতার হামিদ খানের কুমিল্লা মডলকে এগিয়ে নেয়া। 

৪। কাজের বিনিময়ে খাদ্য/কাবিখা, কাজের বিনিময়ে নগদ মজুরীর মত মেধাবী ধারনা দিয়ে সারফেইসে স্বাদু পানির রিজার্ভ বৃদ্ধি করে আবাদী জমি বাড়াতে খাল খননকে একটি সফল কৃষি বিপ্লবে রূপ দেয়া।  

শিল্প

১। নতুন ধারার বেসরকারি শিল্প কলকারখানা স্থাপনের ভেতর দিয়ে অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ। কলকারখানায় তিন শিফট চালু করে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি। টেলিফোন শিল্প সংস্থার বিকাশ করে দেশে টেলিফোন সেট উৎপাদন শুরু হয়। ১৯৭৯ সালে পাকশি কাগজ কলে দৈনিক ৩০ টন করে কাগজ উৎপাদন শুরু হয়, যা দেশে পাটখড়ি থেকে কাগজ উৎপাদনের প্রথম উদাহরণ।

২। যুব উন্নয়ন মন্ত্রাণালয় ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুব ও নারী সমাজকে সম্পৃক্তকরণ।

৩। তৈরি পোশাক শিল্প কারখানার মত নব ধারার বেসরকারি খাত ও উদ্যোগকে উৎসাহিতকরণ।

৪। জনশক্তি রপ্তানি, তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, হস্তশিল্পসহ সকল অপ্রচলিত পণ্যোর রপ্তানির দ্বার উন্মোচন।

৫। ১৯৭৬ সালে প্রথম ৬০০০ শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পাঠানোর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমবাজারের যাত্রা শুরু। হয়

৬। শিল্পখাতে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ।

৭। ১৯৭৯ তে বাংলাদেশ-দক্ষিণ কোরিয়া জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে শুরু হয় বাংলাদেশের প্রথম রপ্তানীযোগ্য তৈরি পোশাক শিল্প (বস্ত্র শিল্প) প্রতিষ্ঠান দেশ গার্মেন্টসের যাত্রা। এর আগে ১৯৭৭-৭৮ সালে প্রথম বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক রফতানি করে রিয়াজ গার্মেন্টস। ১৩০ জন কর্মী-উদ্যোক্তাকে বাংলাদেশের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়দক্ষিণ কোরিয়াতে ট্রেনিং পাঠানো হয়।আশির দশকের শেষ দিকের একটি জরীপে দেখা যায়, এই ১৩০ জন্যের অধিকাংশেরই নিজস্ব তৈরি পোশাক শিল্প কারখানা ছিল। তবে অভিযোগ আছে, শিল্প ঋণ প্রণোদনা পাওয়া একটা ক্ষুদ্র অংশ ঋণ খেলাপি হয়েছেন এবং শিল্প ঋণের খেলাপি সংস্কৃতি তৈরি করেছেন, যা তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে  পুঁজিবাদী অর্থনীতির একটি অপধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।  

৮। ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণকার্যক্রম শুরু করে (অধ্যাদেশ পাশহয় ১৯৮৩ সালে)।

৯। ১৯৮০ সালের ১৫-১৭ ডিসেম্বর ইসলামী অর্থনীতি গবেষণা ব্যুরোর উদ্যোগে ঢাকায় ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ওপর একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করা হয়, ১৯৮১ সালে তিনি বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন।

শিক্ষা

১। গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করে অতি অল্প সময়ে ৪০ লক্ষ মানুষকে অক্ষরজ্ঞান দানেরউদ্যোগ।

২। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়তৈরি।

৩। আলিয়া মাদ্রাসার সিলেবাসে ইংরেজী, বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করা। 

৪। শিশু একাডেমী প্রতিষ্ঠা করা, শিশু মনোবিকাশে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক মানের শিশু পার্ক নির্মাণ করা হয়। 

৫। টেক্সটাইলকলেজপ্রতিষ্ঠাযাবর্তমানেবাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স)। 

৬। সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে সরকারি কর্ম কমিশন সংস্কার করে বিসিএস এ ১৪ টি বিশেষায়িত ক্যাডার সার্ভিস চালু করেন যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম।

স্বাস্থ্য

১। ২৭, ৫০০ পল্লী চিকিৎসক নিয়োগ করে গ্রামীণ জনগণের চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধিকরণ।

২। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়।

৩। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ এর পুনঃ সূচনা। (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা (স্যাটো) কলেরা গবেষণা পরীক্ষাগার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত গবেষণাগার (সিআরএল) খুব দ্রুত ডায়রিয়া রোগ গবেষণায় একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও ফান্ড জনিত কারণে উল্লেখযোগ্য এই স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৮ সালে কলেরা গবেষণা গবেষণাগার (সিআরএল) কে আইসিডিডিআর’বি নামে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এসময় বক্ষব্যাধী/টিবি হাসপাতাল ও পঙ্গু হাসপাতালের পরিসর বড় করা হয়,হার্টফাউন্ডেশান, ক্যান্সার হাসপাতাল ও জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। জাতীয় শিশু টিকাদান কর্মসূচী চালু করেন।   

৪। অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করে জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী প্রণয়ন। বাংলাদেশের জরূরী ভিত্ততে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া নিয়ে মার্কিন তারবার্তায় (জানুয়ারী ১৯ ১৯৭৬, সিআইএ টেলিগ্রাম নাম্বার ০৩২৫/০৯৫০Z) সিনেটর ম্যাক গভার্নের সাথে আলাপের প্রসঙ্গে বলা হয় যে- “তারা (জিয়া) এটি বুঝতে পারছে যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আটকাতে না পারলে অন্য সেক্টর গুলোতেও তারা সফল হবেনা। তিনি (জিয়া) আরো জানিয়েছেন যে তারা তাদের সেরা এবং সবচেয়ে কার্যক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের একজন সাত্তার’কে জনসংখ্যা বিষয়ক কার্যক্রমের সচিব নিযুক্ত করেছেন এবং আশা করছেন যে এটা ফলপ্রসু হবে। তারা আরো বেশী সংখ্যক এবং বেশী দক্ষ লোকবল নিয়োগ করবে এবং আরো বেশী সংখ্যক নারীকে এটার সাথে জড়িত করবে।”   

জিয়াউর রহমান সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্যের অন্যতম বড় একটা কারণ সেসময়ের পরিবর্তিত পররাষ্ট্রনীতি। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের প্রতি বিভিন্ন পরাশক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে যে বিশেষ কূটনৈতিক অবস্থানের সৃষ্টি হয়, যার ফলে বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশি ভারতসহ সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুতার জেরে অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক দুরুত্ব তৈরি হয়েছিল। জিয়াউর রহমান আন্তর্জাতিক স্নায়ুযুদ্ধের তৎকালীন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির উল্লেখযোগ্য সংস্কার করেন যার তিনটি মূল দিক ছিল। এক —  একচেটিয়া সোভিয়েত ব্লক থেকে বাংলাদেশের সরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের সাম্যাবস্থা তৈরি। দুই —  মুসলিম বিশ্বের কাছ থেক স্বীকৃতি আদায় করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক স্থাপন করা, এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক শ্রমবাজার তৈরি হয়। তিন— চীনের সাথে সুস্পম্পর্ক স্থাপন যার মাধ্যমে তৈরি পোশাক শিল্পের সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বাণিজ্য বিভাগ ও বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগ নামে দু’টি বিভাগে বিভক্ত করা হয়।  

জিয়াউর রহমান প্রাচ্যের পারমাণবিক শক্তি চীনের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হন। তার পররাষ্ট্রনীতি সংস্কার প্রক্রিয়ার আওতায় আরও ছিল বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আরব বিশ্বের সাথে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ, যে সম্পর্ক গুলোতে সমাজতান্ত্রিক বাঁকজনিত কারণে স্বাধীনতার পর থেকেই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শৈত্য বিরাজ করছিল। মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সুবিধা ও উপকারিতা বাংলাদেশ আজও পুরোমাত্রায় উপভোগ করছে, কেননা বর্তমানে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মস্থলে পরিণত হয়েছে তার রূপরেখা এই আমলে রচিত হয়, এক্ষেত্রে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের সাথে স্থাপিত সম্পর্ক অনেকটা অর্থনৈতিক হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাথে স্থাপিত সম্পর্কে সামরিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক ইস্যুগুলোও প্রাসঙ্গিক ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সত্তরদশকে মধ্যপ্রাচ্যসহ তেল উৎপাদনকারী দেশ সমূহের অবরোধের প্রেক্ষিতে জিয়াউর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন তৎকালীন স্বল্পোন্নত দেশের জন্য অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানীতেল প্রাপ্তির দাবী করেন যা বিশেষ করে চীনের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পু্নর্গঠনের কাজ অনেকটা ত্বরান্বিত করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার পররাষ্ট্রনীতির সাফল্যে বাংলাদেশ ১৯৭৮ সালে শক্তিশালী জাপানকে হারিয়ে প্রথমবারের মত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়।

প্রাথমিকভাবে এসব সংস্কার বৃহত্তর প্রতিবেশি ভারতের সাথে সামান্য দূরত্ব সৃষ্টির ইঙ্গিত বহন করলেও জিয়াউর রহমান যে আঞ্চলিক সহায়তাকে গুরুত্ব দিতেন সেই সত্যের প্রতিফলন ঘটে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহায়তা সংস্থা (সার্ক) গঠনে তার উদ্যোগ ও অবদানের মধ্য দিয়ে। যেহেতু ভারত সে সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের অত্যন্ত বন্ধুভাবাপন্ন ছিল, স্নায়ুযুদ্ধের অপরপক্ষ অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ কূটনৈতিক নৈকট্য ভারতের সাথে দূরত্ব সৃষ্টির একটি কারণ হতে পারত। তাই গঙ্গার পানি চুক্তি বিষয়ে জাতিসংঘে যাবার প্রেক্ষিতে কিছুটা টেনশন তৈরি হলেও জিয়াউর রহমান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। চীনের সাথে বাংলাদেশের তৎকালীন সদ্যস্থাপিত সুসম্পর্কও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন যে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার বদলে সহযোগিতা স্থাপিত হলে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে যার ফলে বাংলাদেশ সহ এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলো উপকৃত হবে। এই লক্ষ্যে তিনি সার্কের রূপরেখা রচনা করেন যা পরে ১৯৮৫ সালে বাস্তবে রূপ নেয় ও প্রতিষ্ঠিত হয় সার্ক।‍

জিয়াউর রহমানের কর্মসুচীগুলোর একটা ভিন্ন মাত্রা হচ্ছে, এখানে অলস ভাতা এবং অলস সামাজিক সুরক্ষার বরাদ্দকে কর্ম নির্ভর বা উৎপাদনমুখী করা হয়েছে (কাজের বিনিময়ে খাদ্য, খাল কাটার বিনিময়ে মজুরি, উপবৃত্তি)। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ভাতা ও বরাদ্দের কৌশলে উৎপাদনের সম্পর্ক স্থাপনা করা হয়েছে। এতে যুদ্ধ পরবর্তি দেশের কর্মচাঞ্চল্য ফরে এসেছে। অভ্যন্তীণ উৎপাদন কৌশলের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মধ্যপ্রাচ্য মূখী পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে অর্থনৈতিক সহযোগীতার ফ্রেইমোয়ার্ক তৈরি করে জিয়াউর রহমান দেশের অর্থনীতি সংহতকরণে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন।

  • লেখক: ডেভেলপমেন্ট এক্টিভিস্ট ও গ্রন্থপ্রণেতা। ‘বাংলাদেশঃ অর্থনীতির ৫০ বছর’ এবং ‘চতুর্থ
    শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থের লেখক। পরিবেশ, অর্থনীতি ও প্রযুক্তি বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন। 
শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *