:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে ৯ মাসের মাথায় ফের ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়িয়েছে সরকার। অকটেন ও পেট্রোলের দামও বেড়েছে। এক লাফে ৪৭ শতাংশের বেশি দাম বাড়ানো হয়েছে।
ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা, অকটেনের দাম লিটারে ৪৬ টাকা আর পেট্রলের দাম লিটারে ৪৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
এখন এক লিটার ডিজেল ও কেরোসিন কিনতে ১১৪ টাকা লাগবে। এক লিটার অকটেনের জন্য দিতে হবে ১৩৫ টাকা। আর প্রতি লিটার পেট্রলের দাম হবে ১৩০ টাকা।
জ্বালানি তেলের নতুন দাম আজ রাত ১২টার পর থেকে কার্যকর হবে।
শুক্রবার রাত ১০টায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপপ্রধান তথ্য অফিসার মীর মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিন স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে এর আগে একাধিক দফায় আভাস দিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকারকে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকী দিতে হচ্ছে। লোকসান গুণতে হচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে। তাই শিগগিরই এই দাম সমন্বয় করা হবে। তবে তিনি প্রতিবারই বলেছেন, দাম এমনভাবে বাড়ানো হবে যাতে তা সবার জন্য সহনীয় হয়। কিন্তু যে হারে দাম বাড়ানো হয়েছে, তাতে কোনোভাবেই সেটি আর সহনীয় থাকছে না।
কেরোসিন ও ডিজেলের দাম ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ, অকটেনের ৫১ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং পেট্রোলের ৫৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
এর আগে গত বছরের নভেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সে সময় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানো হয়। তাতে দাম হয়েছিল ৮০ টাকা লিটার। তার আগে এই দুই জ্বালানি তেলের দাম ছিল লিটারে ৬৫ টাকা।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের উর্ধ্বগতির কারণে পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিভিন্ন দেশে নিয়মিত তেলের মূল্য সমন্বয় করা হয়। ভারত গত ২২ মে থেকে কলকাতায় ডিজেলের মূল্য প্রতি লিটার ৯২ দশমিক ৭৬ রুপি এবং পেট্রল ১০৬ দশমিক ০৩ রুপি নির্ধারণ করেছে।এই মূল্য বাংলাদেশি টাকায় যথাক্রমে ১১৪ দশমিক ০৯ টাকা এবং ১৩০.৪২ টাকা (১ রুপি = ১.২৩ টাকা ধরে)। অর্থাৎ বাংলাদেশে কলকাতার তুলনায় ডিজেলের মূল্য লিটার প্রতি ৩৪ দশমিক ০৯ এবং পেট্রল লিটার প্রতি ৪৪ দশমিক ৪২ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছিল। তাই সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তেল পাচার হওয়ার আশঙ্কা থেকেও জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানো ছিল সময়ের দাবি।’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বিগত ছয় মাসে (২২ ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত) জ্বালানি তেল বিক্রয়ে (সব পণ্য) ৮০১৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে। বর্তমানে, আন্তর্জাতিক তেলের বাজার পরিস্থিতির কারণে বিপিসির আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে যৌক্তিক মূল্য সমন্বয়ও অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।
আজই রাজধানীর বারিধারায় গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ তেলের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।তিনি বলেন, ‘যেহেতু বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম ঊর্ধ্বমুখী, সেই জায়গায় আমাদের খুব চিন্তাভাবনা করতে হবে। এটার সরাসরি প্রভাব পড়ে জনগণের ওপর। ডিজেল, পেট্রল, অকটেন- এগুলো যেন একটা সহনীয় পর্যায়ে থাকে। দেশ ও দশের কথা চিন্তা করে আমরা একটা অ্যাডজাস্টমেন্টে যাব।’
যাত্রীদের চাপ বাড়বে
মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকটে নিত্যপণ্যের দামে সংসার চালাতে এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। ঠিক সে সময়ে এলো বড় দুঃসংবাদ।
জ্বালানি তেলের দাম যে পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে, তাতে যাত্রীদের ওপর চাপ বিপুলভাবে বাড়বে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রমেশ ঘোষ। তিনি বলেছেন, এর আগে এক দফায় জ্বালানি তেলের দাম এতটা বাড়ানোর নজির আছে কি না, তা মনে পড়ছে না।
জ্বালানির দাম বাড়ানোর এই হারকে অস্বাভাবিক আখ্যায়িত করেছেন শ্যামলী পরিবহনের স্বত্বাধিকারী রমেশ ঘোষ। দ্রব্যমূল্যের ওপরও এর প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
দাম বৃদ্ধি জনগণের জন্য অভিশাপ হবে বলে মন্তব্য করেছেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এক লাফে এত দাম বৃদ্ধি অন্যায্য। খাদ্যসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। করোনায় সাধারণ মানুষের আয় কমেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে মানুষ দিশেহারা। কমিশনকে পাশ কাটিয়ে এভাবে দাম বৃদ্ধি ফৌজদারি অপরাধ।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, বিশ্ববাজারে দাম পড়তির দিকে। এ সময়ে দেশে দাম বাড়ানো উচিত হয়নি। গত কয়েক বছরে বিপিসি প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। যার বড় অংশ সরকার নিয়ে গেছে। এই অর্থ দিয়ে একটা তহবিল গঠন করলে ক্রাইসিস মুহূর্তে কাজে লাগানো যেত। এতে জনগণের ওপর দাম বৃদ্ধির বোঝা চাপাতে হতো না। আইএমএফের ঋণ পেতে শর্ত মেনে দাম বাড়িয়েছে সরকার।
সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেছেন, সরকার তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। আগেরবারের মতোই হুট করে দাম বাড়িয়েছে। শনিবার মালিকরা বসে আলোচনা করে প্রতিক্রিয়া জানাবে।
ট্রাক কাভার্ডভ্যান মালিকদের সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী বলেছেন, পরিবহন খরচ নিশ্চিতভাবেই অনেক বাড়বে। খরচ পরিবহন মালিকরা তো দেবেন না। যে পণ্য পরিবহন করবে, সে দেবে। সে বাড়তি খরচ তুলবে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে। শেষ পর্যন্ত জনগণের পকেট থেকেই যাবে বাড়তি খরচ।