:: আবীদ আবরার ::
নাদিয়া আমার ছাত্রী। আজকে পড়ানোর সময় দেখি তার বইয়ের ভাঁজে রঙিন একটা চিরকুটে লেখা ” বড্ড বেশি ভালোবাসি স্যার”। আমি তো রীতিমতো অবাক হবার চরম পর্যায়ে, তবে এমন কিছু একটা আগেই ভেবেছিলাম। কিছুদিন ধরে নাদিয়ার আচরণ একটু অস্বাভাবিক মনে হতো।
চিরকুটটা নিজের কাছে রেখে স্বাভাবিক ভাবেই পড়ানো শেষ করলাম। তারপর নির্দিষ্ট সময় শেষে যখন ওর রুম থেকে বের হচ্ছিলাম তখন নাদিয়া বললো,
— স্যার কিছু বললেন না?
— কোন বিষয়?
— আপনাকে যে চিরকুট দিলাম।
— সেখানে তো কোনো উত্তর দেবার মতো কিছু পেলাম না। তুমি তোমার নিজের কিছু কথা লিখে দিয়েছ, সবসময় সব জিনিসের উত্তর হয় না।
— কিন্তু আমার তো উত্তর চাই।
– অপেক্ষা করো, পেয়ে যাবে।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়লাম, এটাই হয়তো আমার শেষ যাওয়া। আর এ বাড়িতে পা রাখা যাবে না, সদ্য বেড়ে ওঠা নাদিয়ার আচরণ প্রশ্রয় দেওয়া যায় না।
নাদিয়াদের বাসা থেকে বেরিয়ে আমি সরাসরি আঙ্কেলের অফিসে চলে এলাম। আঙ্কেল আমাকে দেখে খানিকটা অবাক হয়েছে নিশ্চয়ই কেননা এখনো মাস শেষ হয়নি।
মাস শেষে টিউশনির বেতনটা আঙ্কেলের অফিসে এসে আমাকে নিতে হয়। প্রতি মাসের এক তারিখ টিউশনি শেষ করে অফিসে যাবার নিয়ম সেই শুরু থেকে।
— কি ব্যাপার রাফসান? কেমন আছো?
— আলহামদুলিল্লাহ আঙ্কেল, আপনি কেমন আছেন?
— এইতো চলছে।
— আমি একটা কথা বলতে এসেছি আঙ্কেল।
— বলো।
— আমি নাদিয়াকে আর পড়াতে পারবো না। তাই ওর জন্য নতুন শিক্ষক রাখার ব্যবস্থা করেন।
— চাকরি হয়ে গেছে?
— না আঙ্কেল, অন্য কারণ।
— আমাকে বলা যাবে?
— আঙ্কেল, নাদিয়া আমাকে প্রপোজ করেছে। সে হয়তো আমাকে পছন্দ করে ফেলেছে তাই আমি চাইনা এটা আর সামনে বাড়ুক।
— হুম বুঝলাম।
– আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমি চাই নাদিয়া অনেক বড় হোক। নাদিয়া বেশ মেধাবী, তার মতো ছাত্রী আমি কখনো পাইনি। তাই তার সেই মেধাকে আমি প্রেমের ফাঁদে ফেলতে চাই না।
— তুমি তার থেকে আলাদা হলে সে কি স্বাভাবিক থাকবে বলে মনে হয়?
— নাদিয়া সবেমাত্র ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে, এটা তার ভুল করার সময়। আপনি আজকে বাসায় গিয়ে তাকে যথেষ্ট বোঝাবেন। তাকে আমার কথা বলবেন।
— কি বলবো?
— বলবেন যে আমি বলেছি, তাকে ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে দেশের ভালো কোনো ভার্সিটিতে তাকে ভর্তি হতে হবে। যদি সে পারে তাহলে একদিন আমি তার সামনে আসবো। তার সফলতা একদিন আমাকে তার কাছে নিয়ে আসবে।
— সত্যি সত্যি যদি সে অপেক্ষা করে?
— করবে না, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ, মানুষ, প্রকৃতি, সবকিছু বদলে যায়। ২/১ বছর গেলে সে এমনিতেই আমাকে ভুলে যাবে।
— ঠিক আছে আমি তাই বলবো।
— আজকে থেকে আপনি একটু বেশি সময় দিবেন তাকে। তবে আমাকে প্রপোজ করার জন্য তাকে মোটেই বকাবকি করার দরকার নেই। তাকে ভালোবাসা দিয়ে বোঝাবেন, সে বুঝতে পারবে।
— চা খাবে?
— না আঙ্কেল।
— একটা প্রশ্ন করি?
— জ্বি আঙ্কেল, করেন।
— নাদিয়া আমার একমাত্র সন্তান, যথেষ্ট মেধাবী শিক্ষার্থী সেটা তুমি নিজেই স্বীকার করেছো।
— হ্যাঁ সত্যি বলছি।
— সৌন্দর্যের দিক থেকেও নাদিয়া কিন্তু কোনো অংশে কম নয়, তাই না রাফসান?
— জ্বি এটাও সত্যি, নাদিয়া অনেক সুন্দরী।
— একটা মেয়ের এতগুলো ভালো দিক থাকার পরও সে নিজে থেকে তোমাকে প্রপোজ করেছে। কিন্তু তুমি তাকে গ্রহণ না করে, রিজেক্ট করে কেন এড়িয়ে যেতে চাইছো? নাদিয়াকে তোমার পছন্দ নয় তাই না?
— আঙ্কেল আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি। অনেক বেশি সেই ভালোবাসা, তাই আমার কাছে পৃথিবীতে সে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয়।
— সে মেয়ে কি করে? পড়াশোনা?
— আমার চেয়ে এক বছরের জুনিয়র ছিল, গত তিনমাস আগে তার বিয়ে হয়ে গেছে।
— মানে?
— জ্বি, পরিবার থেকে ভালো পাত্র পেয়ে তাকে বিয়ে দিয়েছে। চাইলে পালিয়ে বিয়ে করতে পারতাম কিন্তু সে আমি দুজনের কেউ সেটা চাইনি এটা।
— মাঝে মাঝে অফিসে এসো, দেখা করে যেও।
— কথা দিতে পারছি না, তবে আপনার দাওয়াত আমার স্মরণ থাকবে।
এটাই আঙ্কেলের সঙ্গে আমার শেষ দেখা।
রাত দশটার মতো বেজে গেল তবুও মেসে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। দুই মাসের বাসা ভাড়া বাকি হয়ে গেছে, গত মাসে যেদিন আঙ্কেলের অফিস থেকে টাকা নিয়ে বের হলাম। তার ঠিক ৩/৪ ঘন্টার মধ্যে পকেট ফাঁকা করে রাজধানীর কোনো এক পকেটমার তার পকেট ভারি করেছে।
আজকে দুপুরে মেস থেকে বের হবার সময় মেসের ম্যানেজার কড়া করে কথা বলে দিয়েছে। দরকার হলে মোবাইল বিক্রি করে দিয়ে তারপর যেন বাসা ভাড়া দেই এমন কথা বলেছে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্লান্ত হয়ে সাড়ে দশটার দিকে মেসে ফিরে গেলাম। আমার একমাত্র রুমমেট সাদ্দাম, অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়লাম, পোশাক পাল্টাতে ইচ্ছে করছে না।
একটু পরে সাদ্দাম বললো,
— সন্ধ্যা থেকে কোই ছিলেন রাফসান ভাই? আর মোবাইল বন্ধ কেন? আফরিন আপু এসেছিল।
আমি চমকে উঠলাম। বিয়ের পরে আফরিনের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি আমার। আজকে হঠাৎ করে মেসে চলে এসেছে, ঘটনা কি?
— কখন এসেছিল?
— বিকেলে এসেছিল, ঘন্টা দুই অপেক্ষা করে চলে গেছে।
— ওহ্।
— আপনার দু মাসের বাসা ভাড়া দিয়ে গেছে আর একটা চিঠি রেখে গেছে। চিঠিটা আপনার টেবিলে “আরণ্যক” উপন্যাসের মধ্যে আছে।
— আচ্ছা ঠিক আছে।
ক্লান্ত শরীরে সেভাবেই ঘুমিয়ে গেছিলাম। রাত তিনটার দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল, সাদ্দাম বই পড়ছে এখনো। এই ছেলেটা অনেক মেধাবী, ঠিক নাদিয়ার মতো বলা যায়। নাদিয়া যেকোনো পড়া সহজেই আয়ত্ত করতে পারে। আর সবসময়ই সে নতুন করে প্রশ্নের উত্তর সাজিয়ে বের করে। এতে করে শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ বেশি হবে বলেই আমার ধারণা।
মাথা নাড়া দিলাম, মাথার মধ্যে নাদিয়া ঘুরঘুর করতে শুরু করেছে। তার চিন্তা মাথা থেকে বের করে দিতে হবে, আর সেজন্য এখন আফরিনের রেখে যাওয়া চিঠিটা পড়া যেতে পারে।
আমি বিভূতিভূষণের “আরণ্যক” উপন্যাসের মধ্য থেকে চিঠিটা বের করলাম। আফরিন জানে এটা আমার প্রিয় একটা উপন্যাস।
কেমন আছো?
তোমার কথা মতো মা-বাবার পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করলাম। সত্যি বলছি, হাসবেন্ড হিসেবে সে অনেক ভালো। আমি তোমার সঙ্গে কাউকে তুলনা করতে চাই না তাই করলাম না। নাহলে সবদিক দিয়ে সে প্রায় তোমার মতো।
সপ্তাহ খানিকের মধ্যে আমরা দেশ ছাড়ছি। চলে যাবো ইউরোপের কোনো এক উন্নত ব্যস্ত শহরে। তোমার সঙ্গে দেখা করার অনেক ইচ্ছে ছিল, কিন্তু তোমার মোবাইল বন্ধ। বাসা ভাড়া দিয়ে গেলাম, তবে আমার মন বলছে আগামী মাসের মধ্যে তুমি ভালো একটা চাকরি পাবে। তুমি তো জানো আমি মাঝে মাঝে যা বলি তাই হয়ে যায়, এবার যদি হয় তাহলে আমি হ্যাপি।
ভালো থাকার চেষ্টা করবে, কত বছর পরে আর দেশে ফিরবো জানি না। তবে বাংলাদেশে ফিরে আমি তোমার সাথে দেখা করার চেষ্টা করবো। আশা করি সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করবে না।
আফরিন…
তিনবার পড়লাম। তারপর ভাজ করে সেভাবেই রেখে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে হলাম। রাতে কিছু খাওয়া হয়নি তাই ক্ষুধাটা বড্ড জ্বালাতন শুরু করেছে।
ছয় বছর পেরিয়ে গেছে। অফিসে বসে বসে সেই চিঠিটা একটু আগে আবার পড়লাম। আফরিন কিংবা নাদিয়ার পরিবারের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি। অবশ্য ঢাকা শহর ছেড়ে আমি সেই সময়ই চট্টগ্রামে চলে এসেছিলাম। এরপর আর কোনদিন ঢাকা শহরে যাইনি তাই কারো সঙ্গে যোগাযোগ হবার সুযোগ ছিল না।
ব্যবহৃত সিম আর ফেসবুক আইডি সবকিছু শেষ করে দিয়ে নতুন জগৎ তৈরি করলাম। এখনো ব্যাচেলর বাসা ভাড়া নিয়ে বাস করি, সকাল বেলা অফিসে নাস্তা করি। দুপুরে অফিস থেকেই লাঞ্চ করা হয়, আর রাতে হালকা কিছু খাওয়া।
এইতো জীবন।
সপ্তাহ খানিক পরের ঘটনা। অফিস স্টাফদের নিয়ে কক্সবাজার থেকে ঘুরে এলাম গতকাল। চট্টগ্রাম থেকে খুব কাছেই, বৃহস্পতিবার রাতে গিয়ে আবার শুক্রবার রাতে ফিরে এসেছি। তার পরে গতকাল শনিবার পেরিয়ে আজ রোববার।
রিসিপশন থেকে কল দিয়ে বললো আমার সঙ্গে একটা মেয়ে দেখা করতে এসেছে। নাম জিজ্ঞেস করতেই সে বললো মেয়েটার নাম নাদিয়া।
আমি চমকে গেলাম, সরাসরি নিজেই ওয়েটিং রুমের মধ্যে গিয়ে দেখি সোফায় কালো শাড়ি পরে বসে আছে এক তরুণী। মেয়েটা সেই নাদিয়া এটা চিনতে একটুও ভুল হলো না, আমাকে দেখে সে নিজেও তাকিয়ে আছে।
আমি নাদিয়াকে নিয়ে অফিস থেকে বের হলাম। আগ্রাবাদের কাছেই একটা পার্ক আছে সেখানে চলে গেলাম দুজনেই। এরমধ্যে আমাদের কোনো কথা হলো না। পার্কে গিয়ে আমিই প্রথম জিজ্ঞেস করলাম,
— বাদাম খাবে?
— হুম।
— কেমন আছো তুমি?
— ভালো, আপনি কেমন আছেন স্যার?
— আমিও ভালো আছি, এতদিন পরে কীভাবে খুঁজে পেলে আমাকে? সরাসরি অফিসে।
— আপনি কি বিরক্ত হয়েছেন?
— না তবে অবাক হয়েছি। আমি ধরেই নিয়েছি আমাদের আর কোনদিন দেখা হবে না। আঙ্কেল আন্টি কেমন আছে?
— তারাও ভালো আছে।
— কীভাবে জানলে আমি এই অফিসে চাকরি করি?
— আপনারা দুদিন আগে কক্সবাজার গিয়েছেন তাই না?
— হ্যাঁ।
— আপনারা যে গ্রুপের সঙ্গে গেছেন সেই গ্রুপের সঙ্গে আমি বেশ কয়েকবার ভ্রমণ করেছি। সাজেক বান্দরবান, রাঙামাটি, এমনকি কক্সবাজারও তাই ওই গ্রুপের সঙ্গে আমার এড আছে। কক্সবাজারে তোলা আপনাদের সবার কিছু গ্রুপ পিকচার সেই গ্রুপের মধ্যে আপলোড করা হয়েছে। আমি প্রথমে সেখানেই দেখেছি আপনাকে, এ ক’বছরে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি আপনার।
— হুম বুঝলাম।
— ওদের সঙ্গে অনেকবার ভ্রমণ করার কারণে তাদের সঙ্গে হালকা কথাবার্তার পরিচয় ছিল। তাই সেখানে জিজ্ঞেস করলাম, তারপর তারা বললো আপনারা একই অফিসের কিছু স্টাফ।
— এতো কষ্ট করে খোঁজার কি দরকার ছিল?
নাদিয়া এবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর বললো,
— দরকার নেই তাই না স্যার?
— না মানে, এতদিনে তোমার বিয়ে সংসার সব হবার কথা। পরিবার থেকে নিশ্চয়ই ভালো কোনো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়েছে।
— যেখানে পরিবার নেই, সেখানে আমার বিয়ে?
— মানে?
— আপনি চলে আসার পরে তিনমাসের মধ্যে মা-বাবার ডিভোর্স হয়ে যায়। দোষটা সম্পুর্ণ বাবা করেছেন, সেই কারণে মা ও তাড়াহুড়ো করে আলাদা হবার সিদ্ধান্ত নেয়।
— অবিশ্বাস্য।
— ডিভোর্সের পরে আমি বাবার সঙ্গে ছিলাম, আর মা চলে গেল মামার বাসায়। এরপর বাবা হুট করে আবার বিয়ে করেন, আমি আর সেই বাসায় থাকার মতো স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। মামার বাসায় যাবার কোনো ইচ্ছে ছিল না তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে মেসে উঠতে হলো।
— তারপর?
— চিন্তা করতে পারেন? মা-বাবা সবাই আছে কিন্তু আমি কাউকে পাইনি। বাবা মাসে মাসে টাকা দিতেন, তবে আমিও এরমধ্যে টিউশনি খুঁজতে শুরু করি।
— তখন কি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ?
— হ্যাঁ, ভার্সিটি এডমিশন নেবো এরকম মুহূর্ত।
— চান্স পেলে কোথায়?
— ইডেন মহিলা কলেজ।
— আন্টি এখন কোথায়?
— মা’ও বিয়ে করে নিয়েছে। কি করবে? বলেন।
— এতকিছু হয়ে গেল?
— সদ্য ভার্সিটিতে ওঠা একটা মেয়ের মা-বাবার ডিভোর্স হয়ে যায় তারপর তারা দুজনেই যদি আলাদা আলাদা বিয়ে করে। তাহলে সেই মেয়ের মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে স্যার?
— আমি এমনটা আশা করিনি।
— এরপর থেকে সবসময় ঘোরাফেরা করতাম। সুযোগ পেলেই যেকোনো গ্রুপের সঙ্গে ট্যুরে অংশ নিতাম৷ নতুন সংসারে গিয়ে মা নিজেও আমাকে টাকা দিতেন আর বাবা তো আগে থেকেই। তাই আর টিউশনি করতে হতো না। একসময় যে নাদিয়াকে আপনি পড়াতেন সেই নাদিয়া নিজেও বেশ কিছুদিন টিউশনি করিয়েছে।
— পড়াশোনা তো এখনো শেষ হয়নি?
— না।
— আপনি চলে এসেছেন ছয় বছর হয়ে গেছে, বছর খানিক চলে গেছে এইচএসসি পাশ করে। আর বাকি পাঁচ বছর ভার্সিটিতে।
— নতুন করে কাউকে ভালো লাগেনি?
— একজনকেই ভালো করে ভালোবাসতে পারলাম না সেখানে আবার আরেকজন?
— আমি একজনকে ভালোবাসতাম জানো?
— আপনি চলে আসার পর আমি আপনার মেস খুঁজে বের করেছিলাম। বাবা বলেছিলেন লাভ হবে না কিন্তু মন মানতো না তাই খুঁজতাম। আপনার রুমে যে ছেলেটা ছিল তার কাছে জানতে পারি আফরিন নামের একটা মেয়েকে ভালোবাসতেন।
— জানার পরে ভুলে যেতে ইচ্ছে করেনি?
— না, যদি তার সঙ্গে বিয়ে হতো তাহলে নাহয় একটা কথা ছিল।
— এখন তো খুঁজে পেলে, মন ভালো লাগছে?
এবার ভেজা চোখ নিয়ে নাদিয়া হাসলো। অনেক মিষ্টি সেই হাসিটা, হাসতে হাসতে বললো,
— আপনি বলেছিলেন আমি জীবনে সফল হতে পারলে আপনি আমার সামনে যাবেন।
— এখনো তো হওনি।
— হলে বা কি হতো? আপনি তো আমার কোনো খবর রাখেননি।
— আমি তোমার ভালো চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি এভাবে একা হয়ে যাবে ভাবিনি।
— আমি কি আমার অপেক্ষার পুরষ্কার পাবো না?
— কি চাও?
— যাকে এতো কষ্ট করে খুঁজে বের করলাম।
— ভেবে তারপর জানাবো।
ওর মুখটা কালো হয়ে গেল। আমি নাদিয়ার একটা হাত ধরে সামনে হাঁটতে লাগলাম। চারিদিকে তখন মাগরিবের আজান দিচ্ছে।
রাত এগারোটা।
নাদিয়াকে ঢাকার বাসে তুলে দেবার জন্য তাকে নিয়ে অলংকার বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছি। নাদিয়া এখনো মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কালো শাড়ির উপর নীল একটা চাদর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে নাদিয়া। একটু পরে সুপারভাইজার এসে ডাকতে লাগলো। আমি ওকে নিয়ে গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। নাদিয়া আমার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় অনেক কিছু বলতে চাইছে।
আমি ওর কানের কাছে মুখটা নিয়ে বললাম,
— ঢাকায় গিয়ে তোমার ভার্সিটির আশেপাশে দুজনে থাকার মতো একটা ছোট্ট ফ্যামিলি বাসা খুঁজে বের করবে।
— কেন?
— আমাকে বছর খানিক ধরে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা হেড অফিসে বদলি করতে চায়। কিন্তু ঢাকায় যাবার কোনো ইচ্ছে ছিল না তাই রাজি হইনি। তবে এখন তো সেই উপায় নেই, আমি আগামীকাল অফিসে গিয়ে বদলির আবেদন করবো।
নাদিয়া এবার হাসলো। মাঝরাত তবুও ব্যস্ত এই শহরের ব্যস্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে সবার সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বাসের সুপারভাইজার অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, আশেপাশের আরো অনেকেই হয়তো তাকিয়ে আছে। আমি সেভাবে জড়িয়ে ধরে বললাম,
— সবাই দেখছে, এবার ছাড়ো।
— ইচ্ছে করছে না।
— তাহলে চলো আমিও সঙ্গে যাই।
— সত্যি বলছেন?
— একদম।
আরো একটা টিকিট কেটে আমিও বাসে উঠে গেলাম। নাদিয়ার পাশের সিটের ভদ্রলোককে একবার বলাতেই সে সিট ছেড়ে আমার টিকিটের সিটে চলে গেল।
বাস চলতে আরম্ভ করলো, জানালার পাশে বসা নাদিয়া আমার একটা হাত জড়িয়ে ধরে বসে আছে। অনেকক্ষণ পর সে বললো,
— আমি ঢাকা থেকে আসার সময় কোনদিন ভাবিনি আপনাকে সারাজীবনের জন্য পাবো।
আমি কিছু বললাম না, ভাবতে লাগলাম কালকে সকালে অফিসে কল দিয়ে বলতে হবে আমি অফিসে যেতে পারবো না। একদিনের ছুটি নিতে হবে।