:: পঞ্চগড় প্রতিনিধি ::
পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসাকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে মুসল্লিদের সংঘর্ষে আরিফুর রহমান (২৮) নামে এক পথচারী ও জাহিদ হাসান (২৩) নামের এক তরুণ নিহত হয়েছেন। নিহত জাহিদ আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বলে জানা গেছে।
বিক্ষোভকারীরা তাঁকে করতোয়া নদীর ধারে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসার আহ্বায়ক আহমদ তবশের চৌধুরী।
পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার এস এম সিরাজুল হুদা দুজন মারা যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এ সময় ৯ পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৭ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে বলে সংস্থাটির জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
নিহত আরিফ পঞ্চগড় পৌরসভার মসজিদ পাড়া এলাকার ফরমান আলীর ছেলে। তিনি পঞ্চগড় পৌরসভার মসজিদপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তিনি শহরের একটি প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবস্থাপক ছিলেন। সংঘর্ষের সময় তিনি নামাজ পড়ে বাড়িতে ফিরছিলেন বলে তাঁর স্বজনেরা দাবি করেছেন। পঞ্চগড় পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাজেদুর রহমান চৌধুরী আরিফুরের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
স্বজনেরা জানান, দুপুরে শহরের মসজিদপাড়া এলাকায় সংঘর্ষের সময় আরিফুরের মাথায় গুলি লাগে। তাঁকে প্রথমে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থান্তান্তর করা হয়। রংপুরে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।
আহত ব্যক্তিদের মধ্যে পঞ্চগড় সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কাউয়ুম আলী, ভবেস চন্দ্র পাল, ট্রাফিক পরিদর্শক কাজী কামরুল ইসলাম, সহকারী উপরিদর্শক (এএসআই) মো. আব্দুল্লাহ, পুলিশ সদস্য আল-আমিন, ফরিদুর রহমান ও কামরুজ্জামানের নাম পাওয়া গেছে। আহত অন্যান্য ব্যক্তিরা স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রাথমিকভাবে তাঁদের নাম জানা যায়নি।
বিক্ষোভদের সময় বিদ্যুতের কয়েকটি ট্রান্সফরমার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় জেলা শহরের কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর পৌরসভা এলাকার কয়েকটি মসজিদ থেকে বিক্ষোভকারী মুসল্লিরা পঞ্চগড়-ঢাকা মহাসড়কের চৌরঙ্গী মোড় এলাকায় জড়ো হন। সেখান থেকে তারা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। এ সময় মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা মিছিল নিয়ে পৌরসভার আহামদনগর এলাকায় আহমদিয়াদের জলসা অভিমুখে রওনা দেন। এ সময় পুলিশ মিছিলটি আটকে দেয়। এর জেরে বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে প্রায় তিন ঘণ্টা ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের সময় আরিফুর রহমান গুরুতর আহত হন। পরে তাকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
এদিকে, বিকালে বিক্ষোভকারীদের একাংশ আহমদিয়াদের ২৫-৩০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বলে জানা গেছে। পরে ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনার পর ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও রংপুর থেকে অতিরিক্ত পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্য এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
ভাঙচুর ও আগুনের ছবি তুলতে দিয়ে এসএ টিভির প্রতিনিধি কামরুজ্জামান টুটুলকে বেধড়ক মারপিট করে বিক্ষুব্ধ জনতা। আরও কয়েকজন সাংবাদিককে ছবি তুলতে গেলে তাদের লাঞ্ছিত করা হয়। এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ জনতা জেলা শহরের অদুরে আহাম্মদনগর গ্রামে আহমদিয়াদের জলসা অভিমুখে মিছিল নিয়ে রওয়ানা দিলে চৌরঙ্গি মোড় এলাকায় পুলিশ মিছিলটিকে আটকে দেয়।
পঞ্চগড় পুলিশ সুপার এস এম সিরাজুল হুদা বলেন, ‘পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আমরা আহমদিয়াদের সালানা জলসা বন্ধ করতে বলেছি। হামলাকারীদের শনাক্তে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
অন্য দিকে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও খতমে নবুয়াত সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ক্বারী মো. আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকাল পৌনে ৪টা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেছি। পরে প্রশাসনের আশ্বাসে আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেই। কিন্তু আজ (শুক্রবার) আমাদের কোনো বিক্ষোভ মিছিল ছিল না। প্রশাসনের ফোন পেয়ে আমরা বিক্ষোভকারীদের সড়ক থেকে সরিয়ে নিয়ে আসি। কে বা কারা মিছিল করেছে জানি না। আমরা কোনো সংঘর্ষ, হামলা ও অগ্নিসংযোগ করিনি।’
আহমদিয়া মুসলিম জামাতের সালানা জলসা আয়োজন কমিটির গণমাধ্যম কর্মকর্তা মাহমুদ আহমেদ সুমন বলেন, ‘আমরা প্রতি বছরই সালানা জলসা করি। কারো কোনো সমস্যা করিনি। হঠাৎ কিছু বিপথগামী মানুষ আমাদের বাড়িঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছে। বাড়তি পুলিশ মোতায়েন থাকলেও তারা আমাদের ওপর হামলা করে। এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’
বিক্ষুব্ধ মুসল্লিদের দাবি আহমদিয়া মুসলিম জামাতের অনুসারীরা গোলাম আহমদকে নবী মনে করে তাই তারা কাফের। ইসলামের নামে তাদের কোনো জলসা ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা মেনে নিতে পারেন না। সে কারণে তাদের জলসা বন্ধে প্রশাসনকে ভূমিকা নিতে হবে।
এদিকে এর আগে বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) পঞ্চগড়ে আহমদিয়া মুসলিম জামাতকে নিষিদ্ধ ও শুক্রবার তাদের বার্ষিক সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা মহাসড়কে সাড়ে ৪ ঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে সর্বস্তরের তৌহিদী জনতা।
প্রতিবছরের ন্যায় এবারও পঞ্চগড়ের ফুলতলায় আহম্মদ নগরে ৩ দিনব্যাপী বার্ষিক সালানা জলসার আয়োজন করে আহমদিয়া মুসলিম জামাত। আর পঞ্চগড়ে তৌহিদী জনতার ব্যানারে স্থানীয় মুসল্লিরা তা প্রহিতের চেষ্টা করে। ফলে উভয় পক্ষের পাল্টা পাল্টি অবস্থানের কারণে সংর্ঘষের ঘটনা ঘটে।