‘লাইলাতুল’ আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো রাত আর ‘কদর’ অর্থ সম্মান। লাইলাতুল কদর- এর অর্থ সম্মানিত বা মহিমান্বিত রাত।
পবিত্র কোরআনে লাইলাতুল কদরকে মহিমান্বিত রাত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ আল কোরআন লাইলাতুল কদরে নাযিল হয়। এই রাতের গুরুত্ব তুলে ধরে সূরা কদরে বলা হয়েছে, এই রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।
মুসলমানদের কাছে এই রাত অত্যন্ত পবিত্র ও মহিমান্বিত রাত। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সারা রাত নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, জিকিরে মগ্ন থাকেন।
রমজানের কদরের রাতেই ১৪শ’ বছর আগে এ গৌরবময় অধ্যায় সূচিত হয়েছিল প্রিয় নবীজির (সা.) জীবনে। সেই থেকে সুফি দরবেশদের মাধ্যমে দেশে দেশে মুমিন বান্দারা শবেকদর পালন করে আসছেন, যা আজও পালিত হচ্ছে।
ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায় শুধু ২৭-এর রাতকেই শবেকদর মনে করে এ রাতটি এবাদত-বন্দেগিতে কাটিয়ে দেন। এ রাতেই প্রতিটি মসজিদে খতম তারাবির সমাপ্তি হয়। আজ রাতভর মসজিদগুলো থাকবে এবাদতমুখর এবং কানায় কানায় ভরপুর মুসল্লিতে। চোখের জলের মোনাজাতে বুক ভাসাবে লাখো রোজাদার। সহি হাদিসগুলো থেকে জানা যায়, নবী (সা.) ২০ রমজানের পর থেকেই বেজোড় রাতগুলোয় শবেকদর খোঁজ করতে বলেছেন। যার তালাশে তিনি শেষ দশকে ইতেকাফে বসতেন মসজিদে নববীতে।
যাতে বেজোড় রাতগুলোর আমলের মাধ্যমে শবে কদর খুঁজে পাওয়া যায়, এবং পরবর্তী সময়ে তার উম্মতরাও যেন একই রকম আমল করে মহিমান্বিত রাত শবেকদর পেয়ে ধন্য হয়।
মহান এ রাত সম্পর্কে আল্লাহপাক তার পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআনে বলেন, ‘এবং তোমাকে কিসে অবহিত করবে যে, লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হচ্ছে হাজার মাস থেকে উত্তম। ওই রাতে ফেরেশতারা এবং কামেল রুহ সব তাদের মাবুদের হুকুম অনুযায়ী যাবতীয় বিষয়সহ নাজিল হয়’ (সূরা কদর)। এ রাত কখন আসে, কীভাবে আসে এবং কেমন আরাধ্য আত্মার কাছে মহিমান্বিত এ রজনী ধরা দেয়, সে বিষয়ে জানতে আমাদের সাধনা করা জরুরি। হজরত রাসূলে পাক (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের জীবনে আগত প্রতিটি রমজানের শেষ দশকের কোনো এক বেজোড় রাতে এ সম্মানিত রজনীকে সন্ধান করো’ (বোখারি)। অর্থাৎ রমজানের ত্রিশটি দিবস অসম্ভব কঠোর সাধনায় অবিরাম আরাধনার পর এ মাসের প্রায় শেষ প্রান্তে এসেই কেবল একজন সায়েম সাধক তার কাক্সিক্ষত রাতের সন্ধান লাভ করতে পারেন। আর এটাই হল রমজানের নিবিড় এবাদতের মর্মকথা। নদীর জলের মাছগুলো যেমন জেলের ছড়ানো জালের শেষ প্রান্তে এসে জমা হয়, তেমনিভাবে রমজানের যতসব কল্যাণ তার সবটুকুই এ মাসের শেষ দশকে এসে সঞ্চিত হয়। আর সেই অংশের কোনো বেজোড় রাতেই আত্মগোপন করে থাকে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম ওই রজনী, ঐশী জগতে যার নাম ‘লাইলাতুল কদর’।
আল্লাহর পক্ষ থেকে তার অনুমতিক্রমে কোরআন বহনকারী জিবরাইলসহ (আ.) অন্য বহু ফেরেশতার নাজিল হওয়া এবং এ রাতেই তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আর তারপরই আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে সৃষ্টি ও স্রষ্টার যোগাযোগ স্থাপনের চিত্র কদর নামক সূরাটির মধ্যে আঁকা হয়েছে। এ সবকিছু মিলে আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে এর মাধ্যমে এক অভাবনীয় উপহার দান করেছেন।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ এ উপহারের কথা এভাবে ঘোষণা করছেন, ‘নিঃসন্দেহে আমি মহিমান্বিত রজনীতে কোরআন অবতীর্ণ করেছি। আপনার কি জানা আছে যে, মহিমান্বিত রজনী কী? মহিমান্বিত রজনী হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। সে রাতে ফেরেশতারা এবং রুহুল কুদুস জিবরাইল (আ.) প্রতিপালকের নির্দেশে প্রত্যেক মঙ্গলময় বস্তু নিয়ে অবতরণ করেন। এটি শান্তিময় রজনী, ফজর হওয়া পর্যন্ত তা থাকে।’
আজ বহু বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর আমরা যখন সে পবিত্র ও সৌভাগ্যময় রাতের দিকে তাকাই তখন আমরা অবশ্যই সে ঐশী দূতের মধুর পরশকে স্মরণ করি, কল্পনা করি অপরূপ সেই ওহির বার্তাজনিত আনন্দ উৎসবের দৃশ্যটিকে, যা সে মধুর রাতে বর্ষিত হয়েছিল। তাই তো আল্লাহর পক্ষ থেকে জিজ্ঞাসার সুরে বলা হচ্ছে, তুমি কি জান লাইলাতুল কদর কী? এ রাতে বিজ্ঞানময় প্রতিটি কাজ, যুক্তিভিত্তিক কথা ও জ্ঞানপূর্ণ বার্তা পৃথকভাবে বিবৃত হয়।
সবকিছু যথাযথ মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বরকতময় এ রাতেই উন্মোচিত হয়েছে। মানুষের প্রকৃত মূল্যায়নে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা এবং অবিচার-অনাচারে ভরা ধরায় প্রতিষ্ঠিত হল সুবিচারের মানদণ্ড। মানুষ তার বঞ্চিত অধিকার ফিরে পেল, মানবতা খুঁজে পেল পৃথিবীতে ঠিকানা। সমাজের বুকে প্রত্যেকেই যথাস্থানে প্রতিষ্ঠিত হল।
ইবনে আবী হাতেমের (রা.) রেওয়ায়েতে আছে, রাসূল (সা.) একবার বনি ইসরাইলের একজন মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। সে ব্যক্তি সারারাত ইবাদতে মশগুল থাকত আর সকালে জিহাদের জন্য বের হয়ে পড়ত এবং সারাজীবন জিহাদ করেই অতিবাহিত করত। এভাবে এক হাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম সে দিনে জিহাদ ও রাতে ইবাদতে কাটিয়েছিল। সাহাবারা এ কথা শুনে বিস্মিত হলে সূরা কদর নাজিল হয়। এতে এ উম্মতের জন্য শুধু এক রাতের ইবাদতই সেই মুজাহিদের এক হাজার মাস ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়েছে।
ইবনে জারীর (রা.) অপর একটি বর্ণনায় লেখেন, পূর্ববর্তী যুগের দীর্ঘায়ু ধার্মিকরা বহু বছর পর্যন্ত ইবাদত-বন্দেগি করে এবং তাদের দীর্ঘ জীবনে বহু সৎকর্ম করে অশেষ পুণ্যের অধিকারী হয়ে গেছেন। সুতরাং রাসূলের (সা.) সমসাময়িক অথবা পরবর্তী যুগের অল্পায়ু মুমিনদের পক্ষে প্রার্থনা বা ইবাদত-বন্দেগি ও পূর্ণ কাজে তাদের সমকক্ষ হওয়া সম্ভব হবে কী?
এক সময় নবীর (সা.) মনে এ চিন্তা উদিত হওয়ায় আল্লাহতায়ালা এ সূরা অবতীর্ণ করে তাঁকে সুসংবাদ প্রদান করলেন- হে রাসূল! আমি আপনার এবং আপনার অনুসারীদের জন্য এমন এক মহামহিমান্বিত রজনী নির্ধারিত করে দিয়েছি, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। তাদের এক রজনীর উপাসনা হাজার মাসের উপাসনার চেয়েও উত্তম। এ রজনী আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে উম্মতে মুহাম্মাদীকে বিশেষ দান। এবং এটি এ উম্মতেরই বৈশিষ্ট্য।
তাই হে সিয়াম সাধক, হে নবীর আদরের উম্মত, আসুন আমরা আল্লাহর এ বিশেষ উপহার কাজে লাগিয়ে নিজের ভাগ্য বদল করি। সুন্দর এক আগামীর প্রত্যয়ে আজ থেকেই শুরু হোক আমাদের পথচলা। মোবারক এ রাতে সৌভাগ্য প্রদীপ জ্বেলে পাপ-পঙ্কিলতায় ভরা আমাদের জীবনকে ধুয়ে সাফ করি, খোদার রহমতের চাদরে আবৃত করি মনকে ও জীবনকে।