বাংলাদেশি সার্ফার কিশোরী নাসিমার বিজয়গাথা নিয়েই এই লেখা। বাংলাদেশে ইসলামী সমাজব্যবস্থায় নারীদের যেখানে বহু বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়, সেখানে পারিবারিক ও সামাজিক বহু প্রতিবন্ধকতাকে দূরে ঠেলে সামনে এগিয়ে গেছেন ১৮ বছর বয়সী দুরন্ত এক কিশোরী। সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে গৌরবের পথে দৃপ্ত পায়ে এগিয়েছেন।
‘পোস্টার গার্ল’ বা বিজ্ঞাপনের মুখ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। ব্রিটেনভিত্তিক অনলাইন পত্রিকা ‘দ্য সানডে টাইমস’-এ ‘বাংলাদেশি সার্ফার গার্ল সিঙ্কস মুসলিম ট্যাবুজ’ শিরোনামে বাংলাদেশী এই তরুণীকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে উঠে এসেছে নাসিমা আক্তার নামে সংগ্রামী ওই কিশোরীর অসামান্য গৌরবগাথার গল্প।
নাসিমা বাংলাদেশের একজন সার্ফার। বঙ্গোপসাগরের বিশাল বিশাল ঢেউয়ের সঙ্গে তার সখ্যতা। মিতালি গড়ে উঠেছে সমুদ্রের সঙ্গে। তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায় বিশ্বের দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্র সৈকতগুলোর একটি অবস্থিত। এ তরুণী বাংলাদেশের রক্ষণশীল মুসলিম সমাজের প্রচলিত প্রথা ভেঙে অন্য তরুণীদের সার্ফিং শেখাচ্ছেন। তাদের অনুপ্রেরণা, উৎসাহ দিয়ে আগ্রহী করে তুলছেন। বাংলাদেশে সার্ফিং প্রতিযোগিতায় তিনি নিয়মিত কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। আর, তিনি হারিয়ে চলেছেন একের পর এক পুরুষ সার্ফার প্রতিযোগীদের। সমাজ কি বলবে, সেই ভয়ে যে মেয়েরা সার্ফিংয়ে আসতো না, তাদেরও উদ্বুদ্ধ করে এই খেলায় নিয়ে এসেছেন তিনি। এমন মন্তব্য করছিলেন মার্কিন সাংবাদিক জায়মাল ইয়োগিস।
নাসিমা আক্তারের সঙ্গে ইয়োগিসের পরিচয় ৪ বছর আগে। তিনি বলছিলেন, নাসিমা তাদের বাইরে বেরিয়ে তাদের পছন্দের কাজ করার সাহস যুগিয়েছে। একটি ভ্রমণ বিষয়ক ম্যাগাজিনে ইয়োগিস নাসিমার ওপর একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। ক্যালিফোর্নিয়ার এক চলচ্চিত্র নির্মাতা হিদার কেসিঞ্জার বড় পর্দায় নাসিমার গল্পটি তুলে ধরতে চাইলেন।এ বছরের শেষ ভাগে একটি চলচ্চিত্র উৎসবে নতুন প্রামাণ্যচিত্র ‘দ্য মোস্ট ফিয়ারলেস’ প্রদর্শন করা হবে। এ ডকুমেন্টারিতেই উঠে এসেছে নাসিমার অসামান্য এগিয়ে চলার গল্প। মাত্র ৯ বছর বয়সে বাড়ি থেকে জোর করে বেরিয়ে এসে কিভাবে একটি সার্ফ ক্লাবে নিজের দ্বিতীয় পরিবার খুঁজে পেলেন নাসিমা, সে কাহিনী উঠে এসেছে। একটি অ্যামেরিকান ক্রিশ্চিয়ান সংগঠন এ সার্ফিং সংগঠনটির পৃষ্ঠপোষক। বাংলাদেশ সার্ফ ক্লাবের সদস্য নাসিমার সঙ্গে এখন আরও নারী সার্ফার রয়েছেন। তিনিই তাদের এ পথ দেখিয়েছেন। তাদের সবাইকেই নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে সামনে এগোতে হয়েছে। নাসিমাও মানুষের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এগিয়ে গেছেন। যখনই নাসিমা সমুদ্র সৈকতে গেছেন, আশপাশের লোকজনরা তাকে ‘বেশ্যা’ বলে বিদ্রুপ করেছেন।
বিশ্বের যে দেশগুলোতে সার্ফিংয়ের সুযোগ রয়েছে, সেসব দেশেও কিন্তু পুরুষ সার্ফারদের সংখ্যা নারীদের তুলনায় অনেক বেশি। অবশ্য, বাংলাদেশ এখনও সার্ফিংয়ে একেবারেই নতুন। অথচ, এ দেশে নারী সার্ফারের সংখ্যা পুরুষ সার্ফারদের তুলনায় বেশি। নাসিমাকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রের নামকরণ ‘দ্য মোস্ট ফিয়ারলেস’ করার কারণ ব্যাখ্যা করলেন পরিচালক। ইয়োগিস বললেন, তার মধ্যে যেমন ছিল চারিত্রিক ঔজ্জ্বল্য, পাশাপাশি ছিল দাঁতে দাঁত চেপে কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা। সে কারণেই শেষ পর্যন্ত আমরা চলচ্চিত্রের নাম ‘দ্য মোস্ট ফিয়ারলেস’ The Most Fearless রাখলাম।
এদিকে নাসিমা সার্ফিংয়ে যতো উন্নতি করতে লাগলো, তার পুরস্কারের অর্থও সমানতালে বাড়তে লাগলো। তারপরও শুধু সেই অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব ছিল না। তাই সমুদ্রের পানিতে ভেসে আসা নানা ধরনের মহোহর বস্তু ও শামুক-ঝিনুকের খোলস সংগ্রহ করে সেগুলো স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতো এবং কখনও কখনও উল্টো করে শুইয়ে রাখা নৌকার তলায় ঘুমাতো। প্রামাণ্যচিত্রটিতে সালোয়ার-কামিজ ও উরু-সমান শার্ট পরিহিতা নাসিমাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। নাসিমা আক্তার শুধু বাংলাদেশে নারীদের সার্ফিয়ের সূচনার পথিকৃৎ নন, তিনি কক্সবাজারের লাইফসেইভিং অ্যান্ড সার্ফিং ক্লাবে বাংলাদেশের প্রথম নারী লাইফগার্ড বা প্রাণ রক্ষাকারী ব্যক্তির প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এতো অর্জন আর সাফল্য সত্ত্বেও, সমাজের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া নিয়ে সংগ্রাম করতে হচ্ছে নাসিমাকে।
১৬ বছর বয়সে যে তরুণের সঙ্গে তার বিয়ে হয়, তিনিও এটা মেনে নিতে পারেন না। সমাজের মানুষ বিষয়টাকে মোটেও ভালো চোখে দেখছে না বলে নাসিমাকে সতর্ক করেন স্বামী। ওই চলচ্চিত্রের বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
কেসিঞ্জার ২ বছর আগে প্রামাণ্য চিত্রটি নির্মাণের কাজে হাত দেন। সে সময় নাসিমাই ছিল বঙ্গোপসাগরের বুকে দাপিয়ে বেড়ানো একমাত্র কিশোরী। সে সংখ্যা পরে ক্রমেই দীর্ঘায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে। গত বছর ১০ থেকে ১৩ বছর বয়সী ৮ জন সার্ফিং ক্লাবে ভর্তি হয়। এই তরুণী সার্ফারদেরকেও ডকুমেন্টারিতে দেখানো হবে। নাসিমার সংগ্রাম ও সাফল্যগাথা তাদের ভিন্নভাবে ভাবতে অনুপ্রাণিত করবে এবং তাদের স্বপ্নের পথে এগোতে সাহায্য করবে। এ কথা বলছিলেন, কেসিঞ্জার। বাংলাদেশের একটি মোবাইল ফোন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে তাদের মধ্যে একজনের স্থান করে নেয়াটাকে সমাজের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ইঙ্গিত বলেই মনে করা হচ্ছে। কেসিঞ্জার বলছিলেন, জীবনে বহু সংগ্রামের পথ পেরিয়েও নাসিমা হাল ছাড়তে আগ্রহী নন এবং তিনি অন্য মেয়েদের জন্য পথ তৈরি করে দিয়েছেন। তিনি বলছিলেন, যে কোন স্থানের পথিকৃৎদের কথা ভাবুন। কখনও কখনও তারা নিজের কাজের স্বীকৃতি পান এবং সমাজ তাদের বুঝতে পারে, কখনও হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম তাদের চিনতে পারে। তিনি বললেন, নাসিমার গল্প এখনও শেষ হয়নি।