:: শুভ ::
কতটা বিচিত্র হতে পারেন একজন মানুষ? কতটা বৈচিত্র্যময় হতে পারে একজন কিংবদন্তীর জীবন? সেই কিশোর বয়সে খাবারের লোভে সিলেটের মীরাবাজারের অচেনা এক বাড়িতে হাজির হতেন নিয়মিত। সেই বাসার মহিলা তাকে মিষ্টি খাওয়াতেন, আদর করতেন। একবার তাকে মা বলে ডাকতে বললেন। সেদিনের পর খাদ্যলোভী কিশোর আর গেলেন না ওই বাসায়।
এই কিশোর যখন বড় হয়ে নর্থ ডাকোটায় পিএইচডি করতে গিয়ে ভাড়া বাসায় থাকছিলেন তখন মায়া মমতার জালে আটকা পড়ে সেখানকার এক বৃদ্ধাকে খুশি করতে ‘মা’ বলে ডাকলেন।
কিশোর বয়সে প্রথম কবিতা মুখস্থ করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা। সাহিত্য প্রেম থেকে নয়, তাঁর ভাষায় বলতে হয় এর পেছনে কাজ করেছে অর্থ প্রেম। বাবা বলেছিলেন যে কবিতা মুখস্থ করবে তাকে পুরস্কার হিসেবে টাকা দেয়া হবে।
ক্লাস সিক্সে ড্রয়িং ছাড়া বাকী সব সাবজেক্টে ফেল করা ছাত্রটা এসএসসিতে ঢাকা বোর্ডের মধ্যে দ্বিতীয় হলেন! এরকম ঘটনা পরেও ঘটেছে। নর্থ ডাকোটায় পলিমার কেমিস্ট্রির উপর পিএইচডি করতে গিয়ে একটা কোর্সে শূন্য পেলেন। সেই কোর্সে সেবার হাইয়েস্ট মার্ক পেলো অন্ধ এক ছাত্র। এই ঘটনা থেকে জিদের বশে আবারো পরের বছর একই কোর্স নিলেন। হোটেল রুমে দিন রাত একাকার করে ক্যালকুলাস শিখলেন, গ্রুপ থিওরি শিখলেন এবং পরের বার সেই কোর্সে নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটির ইতিহাসে রেকর্ড মার্ক পেলেন, ১০০ তে ১০০!
ঢাকা কলেজে পড়ার সময় পথে ঘাটে ঘুরতেন। পথে দেখানো এক ম্যাজিকওয়ালার ম্যাজিক দেখে এতোটাই মুগ্ধ হলেন যে জীবনভর সবাইকে ম্যাজিকে বুঁদ রাখলেন।
দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় কবিতা পাঠাতেন তিনি। নিজের নামে কবিতা লিখতে লজ্জা করতো বলে ছোটবোন শেফুর নামে কবিতা পাঠাতে লাগলেন, ছাপানোও হতে লাগলো। ভার্সিটিতে পড়ার সময় কবি ও সম্পাদক হুমায়ূন কবিরের কাছে কবিতা ছাপাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে এসে কবিতা কুঁচি কুঁচি করে ছেড়ে রসায়ন পড়া শুরু করলেন। অথচ সেই বয়সেই তিনি লিখেছেন-
‘দিতে পারো একশ ফানুস এনে-
আজন্ম সলজ্জ সাধ,
একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই’
চারটা মাত্র বই লিখে বিদেশ গেলেন পিএইচডি নিতে। সেখানেই খবর পেলেন দেশে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন! পুরস্কার পাওয়া এই লেখক পিএইচডি চলাকালীন পরবর্তী ৭-৮ বছর কিছুই লিখতে পারলেন না! কিছুই না!
দেশে তাঁর অভাবের দিন। ঢাকা ইউনিভার্সিটির টিচার। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। শুনলেন সেবা প্রকাশনীর কাজী আনোয়ার হোসেন নাকি অনুবাদ করলেই নগদ টাকা দেন। এক রাতেই অনুবাদ করলেন দ্যা এক্সসরসিস্ট। কাজীদা তাকে নগদ ২ হাজার টাকা দিলেন।
বাসায় দুইটা ছোট ছোট মেয়ে। টিভি দেখতে ভালোবাসে। টিভি নাই। পাশের বাড়িতে গিয়ে দেখে। সব সময় তারা দেখতেও দেয় না। মেয়েদের মন খারাপ থাকে। টিভি কেনার জন্য লেখা শুরু করলেন ধারাবাহিক নাটক- ‘এইসব দিনরাত্রি’। যে কয় পর্ব লিখে টিভির টাকা ম্যানেজ হলো তার পরের পর্বে নাটকের প্রধান একটা চরিত্র ছোট বাচ্চাটাকে মেরে ফেলে ধারাবাহিক নাটক শেষ করে দিলেন!
ঢাকা ভার্সিটির টিচার! এতো বড় একটা সম্মানের পদ-পেশা ছেড়ে বানানো শুরু করলেন সিনেমা। প্রথম সিনেমা ‘আগুনের পরশমণি’তেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার! এরপর শুধু সিনেমাই নয়, শুরু হলো নুহাশ চলচ্চিত্রের ব্যানারে একের পর এক নাটক, সিনেমা বানানো। হাবলঙ্গের বাজারে নাটকের শ্যুটিং দেখতে এসেছিলেন একজন। এদিকে নাটকের নাপিত আসেনি। জোর করে নাপিতের চরিত্রে নামিয়ে দিয়েছিলেন তাকে। দেশের মানুষ এখন তাকে এক নামে চেনে- চ্যালেঞ্জার।
পরিচালকদের জীবনে যা আসে তাঁর জীবনেও এলো। পর্দার নায়িকা বাস্তব জীবনে নায়িকা হয়ে গেলো। সমাজে ছিঃ ছিঃ উঠলো। কোন ব্যাখার ধার দিয়ে গেলেন না। শামুকের খোলে গুটিয়ে নিলেন নিজেকে। মা, ভাই বোন সবাই তাঁকে বর্জন করলো, মিডিয়া ধুয়ে দিলো। তিনি চুপ থাকলেন। পত্রিকায় লেখা দিতে লাগলেন, টিভিতে নাটক দিতে লাগলেন।
এক শহরে থেকেও তিন কন্যা দূরে থেকে গেলেন। পুত্র নুহাশ আসতো মাঝে মাঝে। বাসার নিচে এসে বাবার মোবাইলে এসএমএস পাঠাতো-‘ আমি গ্যারেজে অপেক্ষা করছি।’ বাবা নামতেন। ছেলেকে নিয়ে গাড়িতে ঘুরতে ঘুরতে একটু সঙ্গ পাওয়ার চেষ্টা করতেন।
ক্যান্সার ধরা পড়ার পর ডাক্তার বললো সিগারেট ছাড়তে হবে। দুইদিন বেশি বাঁচার জন্য সিগারেট ছাড়তে পারবেন না-সাফ জানিয়ে দিলেন। সে-ই তিনিই এক কথাতেই সিগারেট ছাড়লেন। ছোট ছেলে নিনিত মাত্র হাঁটা শিখেছে। এই শিশুটার সাথে আরো কিছুদিন থাকার জন্য এক কথাতেই ছাড়লেন ত্রিশ বছরের পুরনো বন্ধু সিগারেটকে।
চিকিৎসায় একটু সুস্থ হওয়ার পরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দেশে ফিরেই বানাবেন অত্যাধুনিক ক্যান্সার ইন্সটিটিউট। যে লোক গাঁও গ্রামে অত্যাধুনিক স্কুল বানাতে পারেন তাঁর পক্ষে ক্যান্সার ইন্সটিটিউটও সম্ভব। কিন্তু তার আগেই সব শেষ হয়ে গেলো। হঠাৎ এক ১৯ জুলাইয়ের রাতে ব্রেকিং নিউজ হলো তাঁর মৃত্যুর খবর- ‘নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ আর নেই।’
নিউটন, আইনস্টাইন, মাইকেল জ্যাকসন, রবার্ট ফ্রস্ট, তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর… পৃথিবী জুড়েই কিংবদন্তীদের বাস। হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া আর কোন কিংবদন্তীর সাথে দেখা না হওয়ার জন্য আফসোস হয় না আমার। হুমায়ূন আহমেদ- আমার কিংবদন্তী, আমাদের কিংবদন্তী। তাঁকে এক নজর দেখতে না পারার তৃষ্ণা, একবারের জন্য না ছুঁতে পারার আফসোস, তাঁর কতটা গুণমুগ্ধ ভক্ত- এই তথ্য জানাতে না পারার আক্ষেপ আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। বুকের ভেতর হাহাকার তৈরি করে। হাহাকারের রাতগুলোয় আমি জ্যোৎস্নাহত হই তাঁর দেখানো পথে। অতৃপ্তি নিয়ে রিভিশন দিই তাঁর বই, দেখি কয়েক বার দেখা পুরনো নাটক।
হুমায়ূন আহমেদ এক আশ্চর্য অতৃপ্তির নাম। মিডিয়া আর ক্যান্সার কাউকেই অভিযোগ না করে যিনি চলে গেছেন নীরবে, নিভৃতে। ‘মেঘের ওপর বাড়ি’তে ভালো থাকুক প্রিয় মানুষ, প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ।