:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
ভোলার ইলিশা-১ কূপটি দেশের ২৯তম গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে। শিগগিরই সরকার এ ঘোষণা দেবে বলে জানা গেছে। এটি হবে ভোলা জেলার তৃতীয় গ্যাসক্ষেত্র। অন্য দুটি হলো শাহবাজপুর ও ভোলা নর্থ গ্যাসক্ষেত্র।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম বাপেক্সের হয়ে কূপটি খনন করে। গত মার্চে ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের মালের হাটসংলগ্ন এলাকায় খননকাজ শুরু হয়। তিন হাজার ৪৭৫ মিটার গভীর পর্যন্ত খননকাজ শেষ হয় ২৪ এপ্রিল। এই কূপের তিন স্তরে ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুত আছে বলে ধারণা করছে বাপেক্স।
বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী জানান, এই কূপ থেকে দিনে ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে। ২৫ থেকে ২৭ বছর ধরে এই গ্যাস উত্তোলন করা যাবে বলে দাবি তাঁর। জানতে চাইলে ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, ভূতাত্ত্বিক গঠন বলছে, নতুন কূপটি ভোলা নর্থ থেকে পৃথক কাঠামোতে অবস্থিত। তাই এটিকে নতুন গ্যাসক্ষেত্র বলা যেতে পারে।
বাপেক্স জানিয়েছে, নিকটবর্তী গ্যাসক্ষেত্র ভোলা নর্থ থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে অবস্থান ইলিশা-১ কূপের। এখানে পাওয়া গ্যাস স্তরের সঙ্গে ভোলা নর্থের কাঠামোগত কোনো সংযোগ নেই। ভূগর্ভের একটি ফাটলের মাধ্যমে একটি ক্ষেত্র থেকে অপরটি বিচ্ছিন্ন। তাই ইলিশা একটি নতুন গ্যাসক্ষেত্র। এই তথ্য-উপাত্ত পেট্রোবাংলার মাধ্যমে জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলে এটিকে দেশের ২৯তম গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হবে।
বাপেক্স সূত্র জানিয়েছে, ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রের পূর্ণাঙ্গ কাঠামো চিহ্নিত করতে আরও কূপ খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখানে পাওয়া গ্যাসের গ্রাহক পর্যায়ে আনুমানিক মূল্য প্রায় ৬ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। এলএনজি আমদানি বিবেচনায় দাম প্রায় ২৪ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।
বর্তমানে ভোলার তিনটি গ্যাসক্ষেত্রের নয়টি কূপের দৈনিক ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে।
অভ্যন্তরীণ গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে এবং দেশে জ্বালানি সংকট কাটিয়ে উঠতে সরকার নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তারই অংশ হিসেবে বাপেক্স ভোলায় ইলিশা-১-এর খনন শুরু করে।
গত ৮ মার্চ ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের মালের হাট সংলগ্ন এলাকায় ইলিশা-১ কূপের খনন কাজ শুরু হয়। তিন স্তরে ডিএসটির মাধ্যমে ৩,৪৭৫ মিটার গভীরে সফলভাবে খননকাজ সম্পন্ন হয় ২৪ এপ্রিল।
সূত্র অনুযায়ী, বাপেক্সের সঙ্গে নকশা ও নির্দেশনা চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়ার গ্যাজপ্রম খননকাজ চালাচ্ছে।
১৯৯৩-৯৪ সালে ভোলার বোরহানউদ্দিনে শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রে আবিষ্কারের পর একে একে সদর ও বোরহানউদ্দিন উপজেলায় শাহবাজপুর ও ভোলা নর্থ নামের আলাদা দুটি গ্যাসক্ষেত্রে ৮টি কূপ খনন করা হয়। এসব কূপে মোট গ্যাস মজুদের পরিমান ১ দশমিক ৭ টিসিএফ ঘনফুট বলে জানা গেছে।
দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩৮০০ এমএমসিএফ।
পেট্রোবাংলার সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উৎপাদন হয় দৈনিক গড়ে প্রায় ২১০০ এমএমসিএফ। এলএনজি আমদানি হয় দৈনিক গড়ে প্রায় ৭৫০ এমএমসিএফ। এরপরও প্রতিদিন ৯০০ থেকে ১০০০ এমএমসিএফ গ্যাস স্বল্পতা থেকে যায়। এতে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হয়। করতে হয় লোডশেডিং। বাধাগ্রস্ত হয় শিল্পোৎপাদন। অনেক সময় বন্ধ রাখা হয় সার কারখানা।
বর্তমানে দেশে প্রতিবছর গ্যাস ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় ১ টিসিএফ। এই চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। অবশিষ্ট যা গ্যাস আছে তাতে আর সাত থেকে নয় বছরের মতো চলবে বলে ধারণা করা হয়।
ভূ-তত্ত্ববিদ এবং এ খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্যাসের চেয়ে অনাবিষ্কৃত মজুত বেশি। তারা বলছেন, বেঙ্গল বেসিনের অন্তর্গত ভোলা অঞ্চলে গ্যাসের বিপুল মজুত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারের অবহেলার কারণে এসব গ্যাস অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে। তাদের মতে, বেঙ্গল বেসিনভুক্ত ভোলা এবং এর আশপাশের মনপুরাসহ অন্য দ্বীপাঞ্চল, মেঘনা নদীবক্ষ প্রভৃতি অঞ্চলে গ্যাসের সম্ভাব্য মজুত দেশের জ্বালানি খাতের চেহারা বদলে দিতে পারে; প্রয়োজন শুধু অনুসন্ধান করে আবিষ্কার।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, ‘আমার (ভূ-তাত্ত্বিক) মতো অনেকেই বলে আসছেন, আমাদের দেশ বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ হওয়ায় সমুদ্র উপকূল এবং সাগরে প্রচুর পরিমাণে গ্যাস রয়েছে। প্রয়োজন অনুসন্ধান। তবে বেশ কয়েক বছর আগে সরকারের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি বলতে শুরু করেছিলেন আমাদের দেশে গ্যাস নেই এবং আমাদের মজুদ ফুরিয়ে যাচ্ছে। ‘তারা অনুসন্ধান বন্ধ করে দেয় এবং আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে। অথচ এখন বেঙ্গল বেসিনে একের পর এক গ্যাসের সন্ধান মিলছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের আরও বেশি করে গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান করা প্রয়োজন যাতে আমরা এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি কমিয়ে ডলার বাঁচাতে পারি।’