:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::
ইংরেজিতে ‘ curse of 8th decade’. বাংলায় অষ্টম দশকের অভিশাপ। আরবিতে বলে ‘লানাতুল আকদিস সামিন’। এর জন্ম হয়েছে ইহুদিদের ধর্মীয় ন্যায়শাস্ত্র তালমুদ-এর ভবিষ্যদ্বাণী থেকে। তালমুদ কিন্তু ইহুদি সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ ‘তাওরাত’ নয়।
এটি তাওরাতের আলোকে ইহুদি পণ্ডিতদের রচিত নীতি ও আইন শাস্ত্র— যা ইহুদিদের প্রাত্যহিক জীবনের করণীয়, পালনীয়, পরিত্যাজ্য বিষয়গুলিকে বাতলে দেয়।
এই তালমুদের ভবিষ্যদ্বাণী হল: কোনও ইহুদি রাষ্ট্র আট দশকের বেশি টিকবে না। ভেঙে যাবে। আর সেই ভাঙন। বাইরের কোনও শক্তির কারণে হবে না। হবে নিজেদের মধ্যে জাতি-উপজাতির কোন্দল থেকে। বাস্তবে দেখাও গিয়েছে তাই। ইতিহাস বলছে, গত দুই হাজার বছরে বিভিন্ন জায়গায় ছোট বড় সার্বভৌম ইহুদি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর মধ্যে কিং ডেভিডের। রাজত্ব আর হাসমোনিয়ান রাজত্ব ছাড়া । আজ পর্যন্ত কোনও ‘ইহুদি রাজ্য’ ৮০ বছরের বেশি টেকেনি। কিং ডেভিডের রাজত্ব ও হাসমোনিয়ান রাজত্ব ৮০ বছরের বেশি টিকে থাকলেও এই দুই রাজত্বের ভাঙন ধরেছিল ঠিক ৮০ বছরের মাথায়। এরপর সেই দু’টি রাজত্ব ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল।
একটু ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো যাক। ইতিহাস বলছে, গত দুই হাজার বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছোট বড় অনেক ইহুদি রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু কিং ডেভিডের রাজত্ব আর হাসমোনিয়ান রাজত্ব ছাড়া আজ পর্যন্ত কোনো ইহুদি রাজ্য ৮০ বছরের বেশি টেকেনি। কিং ডেভিডের রাজত্বকাল ছিল খ্রিস্টপূর্বাব্দ ১০৫০ থেকে ৯৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। আর হাসমোনিয়ানের রাজত্ব ছিল খ্রিস্টপূর্ব ১৪০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৬৭ পর্যন্ত।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৪০ থেকে ৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত যখন পম্পেই জেরুজালেম দখল করে, তখন হাসমোনিয়ান রাজবংশ প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনভাবে শাসন করছিলো, যার মেয়াদ ছিল ৭৭ বছর। কোনো রাষ্ট্রই বিদেশি শত্রুদের মাধ্যমে নয়, অভ্যন্তরীণ অন্তর্দ্বন্দ্ব দ্বারা ধ্বংস হয়েছিলো, যা আজকের ঘটনার সঙ্গে তুলনীয়। ৭০ থেকে ৮০ বছর, প্লাস বা মাইনাস দুই বা তিন, সর্বজনীনভাবে তিন প্রজন্মের আয়ুষ্কাল হিসেবে বিবেচিত। তাদের ক্রম একটি নিয়মিত ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে বলে মনে করা হয়। প্রথম প্রজন্ম সৃষ্টি করে বা সম্পদ গড়ে তোলে, দ্বিতীয় প্রজন্ম সে ধারা বজায় রাখে এবং তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্ম সেগুলো ধ্বংস করে। আরব ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬) অনুমান করেছেন যে, সভ্যতাগুলো প্রথম রাজ বংশের দ্বারা তৈরি হয়েছে, দ্বিতীয় রাজবংশ এটির রক্ষণাবেক্ষণ করেছে এবং তৃতীয় রাজবংশ এটি ধ্বংস করেছে। টমাস মানের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বই ‘ব্রুডেনবুকস’ (১৯০১) একটি বণিক পরিবারের গল্প বলে, যেটি এক প্রজন্মে সম্পদ এবং খ্যাতি অর্জন করে, দ্বিতীয় সময়ে তার সংরক্ষণ করে, তৃতীয় বা চতুর্থটিতে পতন ঘটে। ইহুদি ইতিহাসের নজিরগুলো হারজগের অনুসন্ধান সমসাময়িক বিশ্বের ইতিহাসে সমান্তরাল অনুসন্ধানকে উৎসাহিত করে। বিংশ শতাব্দীতে অনেক নতুন জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯২২), তুর্কি প্রজাতন্ত্র (১৯২৩), ভারতীয় প্রজাতন্ত্র (১৯৪৭), গণপ্রজাতন্ত্রী চীন (১৯৪৯) এবং ইসরাইল (১৯৪৮)। পাঁচটি রাষ্ট্রই প্রায় তিন প্রজন্মের পর একটি ঐতিহাসিক মোড় পৌঁছেছে। এর মধ্যে দুইটি সফল হতে পারেনি। ৬৯ বছর পর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা ইউএসএসআর ভেঙে যায়। ৮০ বছর পর ২০০৩ সালে ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ক একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং সংগ্রাম চালিয়ে যায়। দুইটি রাষ্ট্র টার্নিং পয়েন্ট অতিক্রম করছে এবং ভালো করছে। ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রের ৬৭ বছর পর ভারত ২০১৪ সালে একটি প্রকৃত হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হতে শুরু করে। চীন ২০২২ সালে সীমাহীন মেয়াদের জন্য তার ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে পুনর্নির্বাচিত করে। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠার ৭৩ বছর পর চীনারা এটি করতে সক্ষম হয়। ইসরাইল তার ৭৬তম বছরে তার গভীরতম রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে।
১৪ মে ২০২৮ সালে ইসরায়েলের ৮০ বছর পূরণ হবে। তার মানে হাতে আর চার বছর। তালমুদের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হলে, আর তিন-চার বছরের মধ্যে ইসরায়েল রাষ্ট্রটি ভেঙে যাওয়ার কথা। ইসরায়েলিদের অনেকের মনে ভয়, তা হলে কি সেটাই ঘটতে চলেছে? শুধুমাত্র ধর্ম কিংবা ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাসী সাধারণ মানুষের মধ্যে যদি এই প্রশ্ন সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে হয়তো এ নিয়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কোনও চর্চাই হতো না। কিন্তু ‘অষ্টম দশকের অভিশাপ’ কথাটি এমন সব নেতাদের মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে, যার প্রবল রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। আজকের আধুনিক ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ ইসরায়েলের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৮
ইসরায়েলের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইহুদ বারাক ইসরায়েলের ‘ইয়েদিয়ত আহরোনত’ পত্রিকায় এক। নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘ইহুদিদের ইতিহাসে দু’টি ছাড়া ৮০ বছরের বেশি স্থায়িত্বকালের কোনও রাষ্ট্র ছিল না। সেই দু’টি, কিং ডেভিডের রাজত্ব ও হাসমোনিয়ান রাজত্ব। উভয় রাজত্বকালের ভাঙনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল অষ্টম দশকে। অষ্টম শতকের দ্বারপ্রান্তে এসে ফিকে হতে থাকা আগেকার সেই ইহুদি রাজ্যগুলিকে যে বিভাজন জর্জরিত করছিল, সেই বিভাজন থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।’ ইহুদ বারাক সতর্ক করে দিয়েছেন, ইজরায়েল সমাজে বিভাজন ও বিভেদ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গিয়েছে। বামপন্থী বনাম ডানপন্থী, ধর্মীয় গ্রুপ বনাম সেক্যুলার গ্রুপ, ধর্মীয় জায়নবাদী বনাম ধর্মীয় ইহুদিবাদী— গোটা ইসরায়েলি সমাজকে বিভক্ত করে দিয়েছে। যা ইসরায়েলের জন্য বিপদসঙ্কেত।
ইহুদ বারাকের মতোই বিভক্তি নিয়ে তারও আগে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছিলেন, ইসরায়েলের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রিউভেন রিভলিন। ২০১৭ সালে তিনি হার্জলিয়া কনফারেন্সে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, ‘ইসরায়েলে ৩৮ শতাংশ সেক্যুলার ইহুদি, ১৫ শতাংশ জায়নবাদী ইহুদি, ২৫ শতাংশ আরব এবং জায়নবাদী নয় এমন উগ্র অর্থোডক্স মৌলবাদীরা আছে ২৫ শতাংশ। রিউভেন বলেছিলেন, এরা নিজেদের মধ্যে যেভাবে বিবাদে জড়াচ্ছে তা উদ্বেগের। আমরা কি এই বাস্তবতা মেনে নিতে পারি, ইসরায়েলের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক (আরব ও ফান্ডামেন্টালিস্ট ইহুদি) নিজেদের জায়নবাদী মনে করে না এবং আমাদের জাতীয় সঙ্গীত গায় না?
২০১৭ সালে ইসরায়েলের হারেৎজ পত্রিকায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ইসরায়েলকে অবশ্যই অস্তিত্বের কথা মাথায় রেখে এক হয়ে থাকতে হবে। চলতি দফায় প্রধানমন্ত্রিত্ব নেওয়ার আগে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ইসরায়েলকে আট দশকের অভিশাপ থেকে মুক্তি দেওয়ার নিশ্চয়তা তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারই দিতে পারে। অর্থাৎ ‘অষ্টম দশকের অভিশাপ’ নিয়ে একটা ধারণা ইহুদিদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে রয়েছে, সেটা এই নেতাদের কথাতেই বোঝা যায়।
অবশ্য ইতিহাসবিদদের অনেকে বলছেন, ৮০ বছরে তৃতীয় প্রজন্মের উদ্ভব হয়। তাঁরা বলছেন, একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর প্রতিষ্ঠাকালীন প্রজন্ম সাধারণত ঐক্যবদ্ধ থাকে। তাঁদের সন্তানদের মধ্যে, অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে কিছুটা বিরোধ তৈরি হয়। আর দ্বিতীয় প্রজন্মের সন্তানদের মধ্যে, অর্থাৎ তৃতীয় প্রজন্মের মধ্যে সেই বিরোধ চূড়ান্ত রূপ নেয়। এতে মোটামুটি ৮০ বছর সময় লেগে যায়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ইসরায়েলের নাগরিকদের পারস্পরিক মতানৈক্য হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ২০২৮ সালের মধ্যে ইসরায়েল নামে শক্তিশালী রাষ্ট্রটি অন্তর্কোন্দলে ভেঙে যাবে, তা কোনও যুক্তির কথা নয়। তাঁরা এই অভিশাপের ধারণাটিকে ধর্মীয় কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিতে চান। কিন্তু ইসরায়েলের জনগণের মনে আতঙ্ক কাটাবে কে? হামাসের সর্বশেষ এই হামলাকে তাঁদের অনেকে ‘অষ্টম দশকের অভিশাপের’ সঙ্গে মিলিয়ে ফেলছেন। এজন্য ইসরায়েলিরা প্রচণ্ড ভীত। হয়তো সেই আতঙ্ক কাটাতে ইসরায়েল সরকার ফিলিস্তনীদের উপর দানবের মতো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।