:: ধ্রুপদী শামীম টিটু ::
আমি যেদিন জন্মগ্রহণ করি সেদিন আব্বা অনেক খুশি হয়েছিলেন। দুই ভাইয়ের পরে তিন বোন তারপর আমার জন্ম। আব্বা পরদিন অনেককেই বাজার থেকে বাতাসা, খই আর জিলাপি এনে খাইয়েছেন। আমাদের তখন বেশ বড় পরিবার। পরিবারের মোট ৬ ভাইবোন। আমার পরে আমার আরেক ছোট ভাই সহ মোট সাত ভাইবোনের পরিবার। সাথে বাবা মা। মোট নয়জন। এতবড় পরিবারের ভরণপোষণের জন্য যে সামর্থ্য দরকার তা আমাদের তখন ছিল না। মোটামুটি টিনের একটা ঘরে একটি চৌকি ছিল। আর পাটি বিছিয়ে নিচে ঘুমাতাম। বাবা বাজারে দুধ বিক্রি করতেন। একজনের কাছ থেকে ক্রয় করে অন্যদের কাছে বিক্রি করতেন। পাশাপাশি বাজারের অন্যান্য কাজ করতেন। যদি উনার এই জীবন প্রত্যাশিত ছিল না।
আব্বা কোথাও গেলে আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসতেন। দই-মিষ্টি তখন খুব পছন্দের ছিল। আব্বা বাজার থেকে আলু নিয়ে আসতেন। মা আলুর সাথে লাউ কিংবা কুমড়া শাক দিয়ে ঝোল রান্না করতেন। আমরা সবাই মিলে আটার রুটি দিয়ে খেতাম। আহ! কি শান্তির দিন ছিল। মাঝে মধ্যে আব্বা আমাদের নিয়ে স্লুইসগেটের মেলায় নিয়ে যেতেন। কত মজার ছিল সেই দিন।
ধামুরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আব্বা যে ব্যাচের ছাত্র ছিলেন সে ব্যাচে আব্বার চেয়ে কেউ অংক ভালো পারতো না। আব্বার রোল নম্বর ছিল সবসময় শুরুর দিকে। আব্বা তখন নাইনে/টেনে পড়েন। হঠাৎ আমার দাদি মারা গেলেন। আমার আব্বার জীবন ছিল আমার দাদি। আব্বা শোক সহ্য করতে পারলেন না। দীর্ঘদিন দাদির কবরে উপরে শুয়ে থাকলেন। পড়াশুনা বাদ দিয়ে দিলেন। সেই পড়াশুনা আর হয়ে উঠলো না। সাপোর্ট দেয়ার কেউ একজন থাকলে হয়তো এমনটা হতো না।
যাই হোক। পরিবারের ভরণপোষণের জন্য যা যা করা দরকার আব্বা সেই কষ্ট ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আব্বা যা করেছেন শুধুমাত্র পরিবারের ভালোর জন্যই। বাজারে গেলে আব্বার সাথে যেতাম। আব্বা সুশীল দা, সুনীল দা কিংবা গোপাল ঘোষের দোকান থেকে গরম ভাজা পরোটা এনে দিতেন। কী যে মজা করে খেতাম! আমিও আব্বার সাথে দীর্ঘদিন বাজারে দুধ বিক্রি করেছি। রাখাল ডাক্তারের দোকানের সামনে তখন দুধের বাজার ছিল। পাইকারিভাবে দুধ বিক্রি করতেন পরিমল কাকা, আমির আলী কাকা আর আব্বা। এদের মধ্যে পরিমল কাকা অসাধারন লোক ছিলেন। আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আর আমির আলী কাকাও ভালো মানুষ ছিলেন। দুজনেই আজ প্রয়াত। আমি দুধের জগ নিয়ে বসে থেকে থেকে পত্রিকা পড়তাম৷ আমার পত্রিকা পড়ার অভ্যাসের সেই শুরু। তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি৷ আন্তর্জাতিক আর খেলাধুলার পাতা বেশি বেশি পড়তাম। বাজারে দুধ বিক্রি ভালো হলে আব্বা আমাকে ৫-১০ টাকা দিতেন। আমি যে সময়ের কথা বলছি সেটা ১৯৯৭-৯৮ সালের কথা। তখন দশ টাকা মানে অনেক কিছু। একটা পরোটার দাম দুই টাকা, সিঙ্গারা দুই টাকা। আমি টাকা খরচ করতাম না। মায়ের হাতে টাকাটা দিতাম। মা টাকাগুলো সংসারের প্রয়োজনে খরচ করতেন। মাঝে মাঝে আমাকেও দিতেন।
আব্বা কোথাও গেলে আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসতেন। দই-মিষ্টি তখন খুব পছন্দের ছিল। আব্বা বাজার থেকে আলু নিয়ে আসতেন। মা আলুর সাথে লাউ কিংবা কুমড়া শাক দিয়ে ঝোল রান্না করতেন। আমরা সবাই মিলে আটার রুটি দিয়ে খেতাম। আহ! কি শান্তির দিন ছিল। মাঝে মধ্যে আব্বা আমাদের নিয়ে স্লুইসগেটের মেলায় নিয়ে যেতেন। কত মজার ছিল সেই দিন।
সন্ধ্যাবেলা আজান দেয়ার আগেই বাসায় ফিরতাম। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছু হালকা খাবার খেয়ে পড়তে বসতাম। এই নিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত ছিল। আব্বা মাঝে মধ্যে কাছে আসতেন। বলতেন কি আস্তে আস্তে পড়ো, এভাবে পড়লে পড়া মনে থাকবে না। অনেক পরমর্শ দিতেন। তারপর অংক বলতেন মুখে মুখে, ‘একটি বানর তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে এক লাফে…. “। আব্বা অঙ্ক বলতেন, আমি করতাম কিন্তু মিলতো না৷ আব্বা বলতেন, ‘কি যে অঙ্ক করো, পাশই তো করবি না!’
তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। স্কুলের মাঠে দুপুরবেলা খেলা করছি। তখন প্রায় ১২ টা বাজে। হঠাৎ একজন দৌড়ে এসে বললো, ‘আপনার আব্বায় এক্সিডেন্ট করছে!’ আমি দিলাম দৌড়। গিয়ে দেখি হারুন কাকার(গ্রাম্য ডাক্তার) চেম্বারে আব্বা শুয়ে আছেন আর চিৎকার করছেন। শুনলাম আব্বা মোটরসাইকেলে এক্সিডেন্ট করেছেন। মেরুদন্ডে আঘাত পেয়েছেন। পায়ের জয়েন্ট আলাদা হয়ে গিয়েছে। যতদূর সম্ভব চেষ্টা করেছি। কিন্তু আব্বা আর ঠিকভাবে দাঁড়িয়ে পায়ে ভর দিয়ে হাটতে পারেননি। লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়াতেন, চেয়ারে বসে থাকতেন। ধীরে ধীরে অসুস্থতা বাড়তে লাগলো। আব্বা শয্যাশায়ী হলেন। ২০০৫ সালের আজকের দিনে আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে যান।
আজ ১৫ বছর হলো আব্বা ডাকতে পারি না৷ খুব কষ্ট হয়। বোঝানো যাবে না। আব্বার জন্য কিছুই করতে পারিনি। আব্বা তুমি ক্ষমা করো, আব্বা।