:: সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু ::
দীর্ঘ শিক্ষক জীবনে আমি আমার অসংখ্য শিক্ষার্থীকে খুব কাছ থেকে দেখেছি।
দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ-বেদনা, সাফল্য, ব্যর্থতার নানা রঙে রাঙানো আমার ছাত্র-ছাত্রীদের জীবন। যে জীবনের খবর অধিকাংশ শিক্ষকই রাখি না।
আমাদের এই সন্তানেরা কেউ অনার্স শেষ করে ক্যাম্পাস ছেড়েছে, কেউ ডিগ্রি শেষে, অধিকাংশই ছেড়েছে এইচএসসির পর। আমাদের কলেজের ছোট্ট ক্যাম্পাস ছেড়ে যাবার পর ওদের অনেকেই নক্ষত্রের মত আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে, কেউবা পূর্ণিমার চাঁদের মত চারপাশ জোসনার স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে রাখছে ।
কিন্তু আমাদের আলভী আক্তার অন্য দশজনের মত না। নিঃশব্দে মাটি কামড়ে লড়াই করে যাওয়া মেয়ে আলভী। এখনও লড়ে যাচ্ছে।
মাস্টারি করে জীবন পার করলেও একসময় মাঠের মানুষ ছিলাম বলে আলভীকে ঠিকই চিনেছিলাম। ইন্টার ফাস্টইয়ারে ও যখন ভর্তি হয়, তখনই ওর মাঝে খেলাপাগল, বড়মাপের একজন মানুষকে দেখেছিলাম।
নেতৃত্ব দেবার অসাধারণ দক্ষতা, সরলতা, আর লক্ষ্যে পৌঁছানোর দৃঢ়তা দিয়ে আন্ত:কলেজ মহিলা ক্রিকেট, ভলিবল, হ্যান্ডবল, ব্যাডমিন্টন টুর্ণামেন্টে আমাদের জেলার বাঘাবাঘা কলেজকে ধরাশায়ী করে পরপর দুবার চ্যাম্পিয়ন করেছে আলভী । খেলা চলার সময়, প্র্যাকটিসের সময়, কোনদিন ওকে বলতে শুনিনি স্যার, এটা লাগবে ওটা লাগবে, এটা না হলে হবে না, ওটা দিতেই হবে। কিচ্ছু না। টিমের নাস্তার টাকা দিতে ভুলে গেলেও কিচ্ছু বলতো না। নিজেরাই সেদিনের মত সবাইকে বুঝিয়ে চালিয়ে নিতো।
টিমের চাহিদার কথা হয় আমাদের ক্রীড়া শিক্ষক বদরুজ্জামান চুন্নু ভাইকে নয়তো আমাকে চুপচাপ বলতো। আমরা কলেজ ম্যানেজমেন্টকে বুঝিয়ে সাধ্যমত যা পারতাম করতাম। শান্ত স্বভাবের মৃদুভাষী এই মেয়েটি তা দিয়েই টিমের সবাইকে হাসিমুখে ম্যানেজ করতো। প্রসঙ্গত আরেকটি নাম বলতেই হয়, আমাদেরই ছাত্রী তাসলিমা। এক ক্লাস নীচে পড়লেও খেলাপাগল তাসলিমা ছিল আলভীর নিত্যসঙ্গী, ঘনিষ্টতম বন্ধু । তাসলিমার সঙ্গ আলভীর চলার পথকে সহজ করেছে। ওদের এই বন্ধুত্ব যুগ পেরিয়ে এখনও তেমনি আছে।
আমাদের আলভী এখন ফিফা ব্যাজধারী রেফারি। গ্রামের খোলা মাঠ থেকে শুরু করে ঢাকা স্টেডিয়ামেও হয় বাঁশি নয়তো পতাকা হাতে খেলা চালিয়েছে।
নিখাদ গ্রাম থেকে এ পর্যায়ে আসতে বহু কঠিন পথ, বহু বাধাবিপত্তি পেরুতে হয়েছে আলভীকে। সোনার চামচ মুখে নিয়ে ওর জন্ম হয়নি। মানিকগঞ্জ জেলাসদর থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে, শিবালয় উপজেলার কয়ড়া গ্রামে জন্ম। সে গ্রামেই তার বড় হওয়া। আর্থিক টানাপোড়েন সয়ে সয়ে কয়ড়া গ্রাম থেকেই প্রতিদিন হয় বাসে চড়ে নয়তো সাইকেল চালিয়ে কলেজে আসতো। ক্লাস শেষে ট্র্যাকস্যুট পরে শহরের মেইনরোডগুলো হেঁটে হেঁটে পার হয়ে মানিকগঞ্জ স্টেডিয়ামে, নয়তো বিজয়মেলার মাঠে চলে যেতো প্র্যাকটিসের জন্য।সমাজের রক্ষণশীলতা, মন্দ মমানুষের ভ্রুকুটি ছিল চারপাশে কিন্তু আলভী কোনদিন থমকে যায়নি। নিরবে নিজের সাথে, সমাজের সাথে, বরফের মত শক্ত অথচ ঠাণ্ডা চিত্তে লড়াই করতে করতে পথ পেরিয়েছে।
এর মাঝেই পারিবারিক বিপর্যয়ও সামলেছে মেয়েটি । ইন্টার শেষ করে আমাদের কলেজেই ডিগ্রিতে ভর্তি হয়।
বড় কিংবা ছোট কোন ভাই নেই, আলভীরা তিন বোন। ও মেঝ। বড়বোন আর ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে। পরিবারের একমাত্র অবলম্বন বাবা হটাৎ অসুস্থ হয়ে পরলে, তাঁকে নিয়ে যখন যেখানে দৌড়ানো প্রয়োজন আলভী পাগলের মত দৌড়েছে। ক্যান্সারে আক্রান্ত বাবাকে নিয়ে একা ভারতে যেতেও পিছপা হয়নি। কিন্তু আর্থিক সামর্থের কাছে পরাজিত হয়ে অসুস্থ বাবাকে নিয়ে দেশে ফিরে এসেছে। মন ভার করে সেসব কথা নিঃসঙ্কোচে বলেছে। কিন্তু ভেঙে পড়েনি কোন দিন। ডিগ্রিতে পড়ার সময়ই আলভী ওর বাবাকে হারায়। এমন বিপন্ন সময়েও হাল ছাড়েনি, মাঠ ছাড়েনি, লেখাপড়াও ছাড়েনি। বাবার অবর্তমানে সংসারের হাল ধরেছে, যথারীতি বিএ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাশও করেছে । টার্গেট ছিল বিপিএড ডিগ্রিটা নেয়া। সেটাও পূর্ণ করেছে আলভী, রেজাল্ট- প্রথম শ্রেণি।
একটি কথা না বললে অপরাধ হবে। আমাদের কলেজের শরীরিক শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক বদরুজ্জামান চুন্নু ভাই আলভীকে নিজের সন্তানের মত গাইড করেছেন, সাহস জুগিয়েছেন সবসময়।
আমাদের আলভী গাজীপুরে অবস্থিত টেলিযোগাযোগ স্টাফ কলেজের
ফিজিক্যাল ইন্সস্ট্রাকটর হিসেবে কর্মরত।
ভাল বেতন পেলেও ওর এই চাকুরি স্থায়ীও নয়, নিয়মিতও নয়। আমার আকাঙ্ক্ষা, আমাদের আলভী সরকারি অথবা বেসরকারি কোন কলেজ অথবা ভাল কোন স্কুলে ক্রীড়া শিক্ষক হিসেবে আলভীর চাকুরি হোক। যদি হয় আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আলভী একটি পরশপাথর ও বদলে দিতে পারবে হাজারও শিক্ষার্থীর জীবনবোধ, দৃষ্টিভঙ্গী।
স্যালুট তোমাকে আলভী। সাহস হারিও না। তোমার জন্য ভালবাসা আর দোয়া থাকবে আমৃত্যু, প্রার্থনা করি তুমি সফল হও ।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ
খান বাহাদুর আওলাদ হোসেন খান কলেজ, মানিকগঞ্জ।