ঈদুল ফিতর নেক বান্দাদের জন্য খুশির দিন। যারা রোজা পালন করেছেন তাদের জন্য আনন্দ ও উৎসবের দিন হচ্ছে ঈদুল ফিতর। আর পাপী-তাপীদের জন্য এই দিনটি হলো শাস্তি ও আজাবের। সাহাবি হজরত ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বিহ (রা.) ঈদের দিন কাঁদছিলেন। কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আজ খুশির দিন ওই ব্যক্তির জন্য, যার রোজা কবুল হয়েছে।
তাই প্রত্যেকের জন্য দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে- ঈদের রাতে ও দিনে দোয়া-দুরূদ শরীফ, মীলাদ শরীফ-ক্বিয়াম শরীফ, যিকির-ফিকির, তওবা-ইস্তিগফার ইত্যাদি ইবাদত-বন্দিগীর মাধ্যমে মহান আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের খাশ রেযামন্দী হাসিলের চেষ্টা করা।
ঈদুল ফিতরের দিন হলো পুরস্কার লাভের দিন। এদিন একদল ফেরেশতা দাঁড়িয়ে যান এবং বলতে থাকেন, ‘হে মুসলিম সম্প্রদায়! তোমরা দয়াময় প্রভুর দিকে ছুটে চলো। তিনি তোমাদের কল্যাণ দান করবেন। তিনি তোমাদের পুরস্কার দেবেন।’ ঈদের পূর্ণাঙ্গ আনন্দ-খুশি ও কল্যাণ অর্জন করতে হলে আরো ঘনিষ্ঠ করতে হবে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক, ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ করতে হবে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে হৃদ্যতা ও ভালোবাসার সম্পর্ক। উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে বন্ধু-বান্ধব স্বজনদের সঙ্গে সহমর্মিতা ও সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে।
হাদিসে ঈদের দিনে বেশ কয়টি করণীয়ের কথা উল্লেখ আছে- ১. প্রত্যুষে ঘুম থেকে ওঠা, ২. মিসওয়াক করা, ৩. নামাজপূর্ব গোসল, ৪. সুগন্ধি ব্যবহার, ৫. চোখে সুরমা লাগানো ৬. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান ৭. আগেভাগে ঈদগাহে গমন ৮. অসহায়দের দান ৯. নামাজপূর্ব মিষ্টিদ্রব্য গ্রহণ ১০. নামাজপূর্ব সদকা আদায় ১১. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া ১২. এক পথে যাওয়া ও ভিন্ন পথে ফেরা ১৩. ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ’ বেশি বেশি পড়া।
ঈদকে একটি পবিত্র উৎসব হিসেবে পালন করতে হবে। এর সুন্নত তরিকা হলো ঈদের নামাজের আগে গোসল করে নেয়া, ভালো পোশাক পরে আতর-সুগন্ধি মেখে ঈদগাহে যাওয়া, সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হলে ঈদের নামাজের আগে তা আদায় করে দেয়া, পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া, সম্ভব হলে এক রাস্তায় যাওয়া, অপর রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা, ঈদগাহে যাওয়ার আগে মিষ্টিমুখ করে নেয়া, ঈদগাহের দিকে ধীরস্থিরভাবে যাওয়া, নামাজ শেষে আত্মীয়-স্বজনের কবর জিয়ারত করা, ঘরে ফিরে চার রাকাত নফল নামাজ পড়া। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা তোমাদের ঈদকে তাকবির দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত কর।’
রাসুল (সা.) আরো ইরশাদ করেছেন, পাঁচটি রাত জেগে যে ব্যক্তি ইবাদত করবে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হবে। রাতগুলো হলো—১. জিলহজের রাত, ২. আরাফার রাত, ৩. ঈদুল আজহার রাত, ৪. ঈদুল ফিতরের রাত, ৫. মধ্য শাবানের রাত। সুতরাং ঈদুল ফিতরের রাতে ইবাদত করা খুবই পুণ্যময় কাজ। ঈদের অনাবিল সুখ-আনন্দ শুধু রোজাদারদের জন্য। যারা ইচ্ছাকৃত রোজা ছেড়ে দিয়েছেন তাদের জন্য এ আনন্দ নয়।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য এ রমজানের শেষে কিছু ইবাদত নির্ধারণ করেছেন, যা আল্লাহর নৈকট্য বাড়িয়ে দেবে, ঈমানি শক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং আমলনামায় অধিক সওয়াব লেখা হবে।
*আল্লাহ আমাদের জন্য প্রবর্তন করেছেন জাকাতুল ফিতর, যা আদায় করতে হবে।
*’তাকবির’ দেয়া। রমজানের সময় পূর্ণ হওয়ার পর সূর্য ডোবার পর ঈদের চাঁদ ওঠা থেকে শুরু করে ঈদের সালাত আদায় পর্যন্ত তাকবির পাঠ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যাতে তোমরা গণনা পূরণ করো এবং তোমাদের হেদায়াত দান করার দরুন আল্লাহ তায়ালার মহত্ত্ব বর্ণনা করো (তাকবির বলো) আর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে পারো।’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)।
*আর সুন্নাত হচ্ছে, পুরুষরা মসজিদে, বাজারে এবং ঘরে সব জায়গায় উচ্চৈঃস্বরে তাকবির দেবে, আল্লাহর মহত্ত্বের ঘোষণা দেয়া, তাঁর ইবাদত ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য। আর মহিলারা তাদের স্বর নিচু করে তাকবির দেবে। যেহেতু তাদের কণ্ঠস্বরকে গোপন করার জন্য আদেশ হয়েছে।
*আল্লাহ তায়ালা ঈদের দিন তাঁর বান্দাদের জন্য ঈদের সালাত প্রবর্তন করেছেন; যা মহান আল্লাহর জিকির বা স্মরণকে পূর্ণতা প্রদান করে। তাছাড়া রাসূল (সা.) তাঁর উম্মতের নারী-পুরুষ সবাইকে এ আদেশ দিয়েছেন। আর নির্দেশ শিরোধার্য। কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো। তোমাদের আমলগুলোকে নষ্ট করো না।’ (সূরা মুহাম্মাদ : ৩)।
*সুন্নাত হচ্ছে, ঈদুল ফিতরের সালাতে যাওয়ার আগে খেজুর খাওয়া। তিন, পাঁচ বা ততোধিক বেজোড় সংখ্যায়। কারণ আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, ‘রাসূল (সা.) ঈদুল ফিতরের সালাতে খেজুর না খেয়ে বের হতেন না এবং তিনি বেজোড় সংখ্যায় হিসাব করে খেতেন।’ (সহিহ বোখারি : ৯৫৩)।
*অনুরূপ আরও সুন্নত হচ্ছে, ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া। কেননা, আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) বলেন, ‘সুন্নত হলো, ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া।’ (তিরমিজি : ১২৯৬)।
*আরও সুন্নাত হচ্ছে, পুরুষরা সৌন্দর্য অবলম্বন করবে এবং সবচেয়ে সুন্দর পোশাক পরে সজ্জিত হবে। যেমন, সহিহ বোখারিতে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘ওমর (রা.) একটি রেশমি পোশাক বাজার থেকে এনে রাসূল (সা.) এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এটা ক্রয় করে ঈদের দিন এবং মেহমানের উপস্থিতিতে ব্যবহার করুন। রাসূল (সা.) রেশমি কাপড়ের দরুন অসন্তুষ্ট হলেন এবং বললেন, রেশমি পোশাক ওইসব ব্যক্তিদের জন্য যারা আখেরাতের কিছুই পাবে না।’ (সহিহ বোখারি : ৯৪৮)। পুরুষের জন্য রেশমি পোশাক বা স্বর্ণালঙ্কার ব্যবহার বৈধ নয় বিধায় রাসূল এ কথা বলেছেন। এর থেকে বোঝা যায়, অন্য সুন্দর পোশাক পরা সুন্নত।
ঈদের সালাত বিনয়াবনত ও একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ভয়ভীতি সহকারে আদায় করবে। বেশি বেশি করে আল্লাহর জিকির করবে এবং দোয়া পড়বে। তাঁর রহমতের আশা ও আজাবের ভয় করবে। ঈদগাহে সবাই একত্রিত হওয়ার বিষয়টিকে কেয়ামতের দিন মহান আল্লাহর সামনে হাশরের মাঠে মহা অবস্থানস্থলে একত্রিত হওয়ার সঙ্গে তুলনা করে তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে। আর এ ঈদগাহ মাঠে মানুষের মধ্যকার মর্যাদার তারতম্যকে আখেরাতের সেদিন বড় ধরনের তারতম্য হবে, সেটাও স্মরণ করবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে নবী! আপনি লক্ষ্য করুন, আমরা কীভাবে তাদের একদলকে অন্যের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি, আখেরাত তো অবশ্যই মর্যাদায় মহত্তর ও শ্রেষ্ঠত্বে বৃহত্তর।’ (সূরা আল ইসরা : ২১)।
আর প্রত্যেকে যেন রমজানের মতো আল্লাহর বড় নেয়ামত প্রাপ্তি এবং তিনি যে এতে বান্দাকে সালাত, সিয়াম, কোরআন তেলাওয়াত, সদকা ইত্যাদি ইবাদত করা সহজ করে দিয়েছেন সেজন্য আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করে। কারণ তা দুনিয়া ও তার মধ্যে যা আছে তা থেকেও উত্তম।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বলুন, এটা আল্লাহর অনুগ্রহে ও তাঁর দয়ায়; কাজেই এতে তারা যেন আনন্দিত হয়।’ তারা যা পুঞ্জীভূত করে তার চেয়ে এটা উত্তম।’ (সূরা ইউনুস : ৫৮)।