:: কামরুন নাহার মিশু ::
ঈদ আসলে আম্মা গতবছর উঠানো আমাদের ভালো জামাটা ট্রাঙ্ক থেকে বের করে জেট পাউডার দিয়ে ধুয়ে কড়কড়ে রোদে শুকাতে দিতেন। এরপর ধোয়া জামাটা শুকালে রোদ থেকে এনে গরম গরম ভাঁজ করে বালিশের তলায় চাপা দিয়ে রাখতেন।
আম্মার সেই ধোয়া, ভাঁজ করা জামাটাই হতো আমাদের জন্য ঈদের নতুন জামা। সেই জামা পরেই আমি আব্বার সাথে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম।
আমি পুরনো নতুন! জামা পরলেও আব্বা ঝলসে যাওয়া নিত্যদিনের সেই পাঞ্জাবি পরেই হাসি মুখে আমাকে নিয়ে কেন্দ্রিয় মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে নিয়ে যেতেন।
আমার একটা লাল শার্ট আর একটা সাদা পাজামা ছিল। আর নীলাপার ছিল থাক থাক একটা গোলাপী স্কার্ট। আম্মা আর আব্বা ঈদের জন্য আলাদা কিছুই ছিল না। শার্টটা আমার মামাতো ভাইয়ের। সে কয়েক বছর পরার পর ছোট হয়ে যাওয়ায় মামী আমার জন্য দিয়ে দিয়েছিলেন। স্কার্টটা মামাতো বোনের। সেটা অবশ্য নতুন, তার গায়ে না হওয়ায় মা মামীর থেকে অনেকটা জোর করেই আপার জন্য সেটা আদায় করে নিয়েছিলেন।
এত সুন্দর লাল শার্ট আমি জীবনেও দেখিনি। আমার জীবন আর কতইবা মাত্র এগারো বছর। চতুর্থ শ্রেনিতে পড়তাম।
মামারা বেশ ধনী, শহরে থাকেন। মামা গার্মেন্টসে সুপারভাইজারের কাজ করতেন। তাই মামার ছেলে মেয়েদের জামা কাপড়ের অভাব হতো না।
ওদের জন্য কেনা নতুন কাপড় পরতে পরতে ছোট হয়ে গেলে প্রায় সময় মামী দয়া করে সেগুলো পাঠিয়ে দিতেন।
আমার জন্য আর আমার বড়পা নীলার জন্য। ওই কাপড় পেলে আমাদের ঈদের আনন্দ হতো। সেই পুরনো কাপড় আম্মা যক্ষের ধনের মতো সংগ্রহ করে রাখতেন। আমাদেরকে বিশেষ বিশেষ দিনে পরানোর জন্য। যেমন ফুফুর শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে গেলে, নানি বাড়ি বেড়াতে গেলে আর দুই ঈদের সময়।
আমি প্রায় বায়না করতাম মায়ের কাছে কোথাও যাওয়ার জন্য। কোথাও যাওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য ছিল লাল শার্টটা পরা।
আম্মা এত নিষ্ঠুর ছিলেন। চাইলেও আমাকে লাল শার্টটা পরতে দিতেন না। এটা অবশ্য আম্মা নিষ্ঠুরতা নয়। আম্মার ভয় ছিল, যখন তখন পরে যদি আমি শার্টটা নষ্ট করে ফেলি, তাহলে ঈদের সময় কী পরব! এভাবে ট্রাঙ্কে জমিয়ে রাখতে রাখতে একসময় শার্টটা পরার অনুপযোগী হয়ে যায়।
বুক দিয়ে আসে না, বোতাম লাগানো যায় না, লম্বায়ও বেশ ছোট হয়ে যায়। সেবার ঈদের সময় আম্মার জেট পাওডার দিয়ে ধোয়া শার্টটা যখন আমি ছোট হয়ে যাওয়ার কারণে আর পরতে পারলাম না। আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি, কেঁদেছি। আমার চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছেন আম্মা। কেন আমাকে পড়তে দিলেন না, কেন ট্রাঙ্কে তুলে রেখে শার্টটা ছোট করে ফেললেন, সেই কষ্টে আম্মাও আমার মতো ভীষণ কেঁদে ছিলেন।
কত বছর আগের ঘটনা এটা। অথচ এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে। আনন্দের স্মৃতি যেমন ভোলা যায় না, কষ্টের স্মৃতিও তেমনি বেশ দগদগে হয়ে মনে গেঁথে থাকে।
নীলাপার বেশ বড়ো ঘরে বিয়ে হয়েছে। সে স্বামীর সাথে ঢাকা থাকে। তার নিজস্ব বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। তার বর অনেক বড় ব্যবসায়ী। সে টাকা, পয়সা দুই হাতে খরচ করে।
একমাত্র পোশাকের ক্ষেত্রে আসলেই নীলাপা কৃপণতা শুরু করে। কোনো ঈদে সে নতুন পোশাক কিনে না। আলমারী থেকে আগের কেনা একটা শাড়ি পরে ঈদের দিন সে হাসি মুখে কাটিয়ে দেয়। মায়ের এই অদ্ভুত অভ্যাসের কারণে নীলাপার ছেলে, মেয়ে তার উপর ভীষণ বিরক্ত। মায়ের বিরুদ্ধে আমার কাছে নালিশ নিয়ে আসে।
এসে দেখে আমার অবস্থা আরও শোচনীয়। আমি বছরের পর বছর একটা পাঞ্জাবি পরেই ঈদ করি।
আমি স্ত্রী -সন্তানকে পোশাক কেনার স্বাধীনতা দিয়েছি, পর্যাপ্ত অর্থ দিয়েছি। তারা তাদের পছন্দমতো যা খুশি কিনে, পরে।
কখনো কখনো বাজারের দামী পোশাকটাই ঈদ উপলক্ষ্য আমি তাদের উপহার দেই।
শুধু আমার নিজের জন্য নতুন কিছু কিনতে ইচ্ছে করে না। নতুন পোশাক কিনতে গেলে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে। সেই জং ধরা ট্রাঙ্ক, সেই ছোট হয়ে যাওয়া লাল শার্ট। সেই বুকে জড়ানো লাল শার্ট নিয়ে মায়ের অপরাধী মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠে।
বাবা- মা কখনো নতুন পোশাক পড়ে তাদের জীবদ্দশায় ঈদ করতে পারেননি। আজ আমাদের সব আছে শুধু বাবা- মা নেই। আমি আর নীলা আপা বুকের মাঝে সেই ক্ষত জমিয়ে রেখেছি সযতনে। তাই এত এত বছর পরও আমরা যত্ন করে সেই ক্ষত লালন করি।