:: ইমরুল কায়েস ::
৭/৮ বছর আগের কথা। একজ্যাক্ট তারিখ মনে নাই। নূরুল কবীর ভাইকে ফোন করলাম। নিউজের জন্য ইন্টারভিউ করব। অফিসে যেতে বললেন। নিউএজ অফিসে। বিকেলের দিকে তাঁর অফিসে গেলাম। গেটে ঢুকে বললাম সম্পাদকের রুম কোনদিকে? আমাকে একজন নিয়ে গেলেন। প্রথমেই বিস্মিত হলাম। ওমা, সম্পাদক সাহেবের রুমের একি অবস্থা? ছোটখাটো রুমে চেয়ার টেবিল পাতা দপ্তর। পুরোনো বইপত্র ভর্তি আর পত্রিকার স্তুপের মাঝে বসে বই পড়ছেন রোগাশোকা লোকটি। গায়ে হাফহাতা শার্ট থাকায় হাতের অর্ধেকটা বেরিয়ে। এক হাতে বই আর আরেক হাতে জলন্ত সিগারেট। একমনে বই পড়ছেন। হাতের সিগারেট পুড়ে ছাইয়ের অংশ দীর্ঘতর হচ্ছে।
সামনে যেতেই ইশারায় বসতে বললেন। কয়েক সেকেন্ড পর বই নামিয়ে তাকালেন আমার দিকে। নামধাম, পড়াশোনা, কতদিন সাংবাদিকতা করি এসব জানতে চাইলেন। সবই বললাম। এরপর সাংবাদিকতা সারা জীবন করতে চাই কিনা সেটাও জিজ্ঞেস করলেন। হ্যা-সূচক জবাব দিতেই আচমকা বলে উঠলেন, সারা জীবন সাংবাদিকতা করতে চান সাংবাদিক মাস্তান হতে পারবেন? অকস্মাৎ প্রশ্নে কি জবাব দিব বুঝতে পারছি না। কয়েক সেকেন্ড দেরি করে আবার প্রশ্ন করলেন, বউ কেমন? আমি তো লা জবাব। একেবারেই কিংকর্তব্যবিমুঢ়। বউ সুন্দরী, লম্বা, ফর্সা, কালো, বেঁটে না কি বলব বুঝতে পারছি না। আবার কয়েক সেকেন্ড পর শুরু করলেন। যদি মাস্তান সাংবাদিক হতে চান তাহলে আমার মতো বউ থাকতে হবে।
মনে মনে ভাবছি লোকটা পাগল নাকি? আগে কোনদিন দেখা সাক্ষাৎ নাই। প্রথম সাক্ষাতেই বউ-টউ নিয়া জানতে চাইছেন। আমার বউ কেমন তাতে তাঁর কি? আর তিনার যা বয়স তাতে তাঁর বউ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জানার আগ্রহ আমার নাই। সিগারেটে আরেকটা টান দিলেন।
তারপর বলা শুরু করলেন–
“এক-এগারোর সময় টকশোতে আমি যেন সরকারবিরোধী কথা না বলি সেজন্য নানাভাবে নানা কর্ণার থেকে আমাকে বলা শুরু হল, বোঝানো শুরু হল। কিন্তু আমিতো বুঝি না। আমার মতো বলে যেতে লাগলাম। তারাও নাছোড়বান্দা। কথায় যখন কাজ হয় না তখন ভয়-ভীতি দেখানো শুরু হল। একদিন রাস্তায় একটি গাড়ি আমাকে চাপা দেয়ার চেষ্টা করলো। কোনোমতে বেঁচে গেলাম। তারপরও যখন থামলাম না। তখন অন্য উপায় অবলম্বন করলো সেই সময়ের সরকার। আমার মাকে ম্যানেজ করার চেষ্টায় নামলো। এতে কাজ হলো। সন্তানের ভয় কার না থাকে? মা আমাকে ডেকে বললেন, বাবা, তুমি আর এভাবে (সরকারবিরোধী) কথা বলো না। এভাবে কথা না বললে হয় না? আমি কথা না বাড়িয়ে শুধু বললাম, মা তুমি তোমার সন্তানকে তো সৎভাবে মানুষ করেছো। আমার যা বলা উচিৎ তা যদি না বলি সেটা নৈতিকতা বিরোধী হবে। সেটা কি আমি করতে পারি? মা বুঝে গেলেন সুবিধা হবে না। এ ছেলেকে বলে কাজ হবে না। এবার মাও অন্য উপায় অবলম্বন করলেন। আমার বউকে দিয়ে চাপ দেয়ানো। আমার বউকে বোঝালেন, এখন সময় খারাপ। কবির যেভাবে কথা বলে তাতে যেকোন সময় বিপদ হবে। তুমি ওকে একটু বোঝাও। আমার বউ কথা না বাড়িয়ে মাকে বললো, আচ্ছা। মা কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন, এরপরও আমার গতি থামছে না, বরং আগের চেয়ে বেড়েছে। মা আবার আমার বউকে ডাকলেন। এবার একটু কড়া ভাষায় বলার চেষ্টা করলেন। সব শুনে আমার বউ স্থির কিন্তু দৃঢ় কন্ঠে কথা বলা শুরু করলেন। মাকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা মা! আপনার ছেলে দেখতে কি সুন্দর? চেহারা কি ভালো? অনেক টাকার চাকরি করে? মা জবাব দিলেন, না। বউয়ের পাল্টা প্রশ্ন, তাহলে আমি কেন আপনার ছেলের সাথে আছি? মা এর মুখে কোন কথা নাই। আমার বউ জবাব দিলেন আপনার ছেলের সাথে আছি তার এই গুণটার জন্য। সে সত্য বলতে, নৈতিকতার প্রশ্নে কাউকে ছাড়ে না। সৎ সাহসী একজন সাংবাদিক। তাঁর এই গুণটা যদি আপনি কেড়ে নেন তাহলে আমি আপনার ছেলের সাথে থাকব কেন? এই গুণটার জন্যই তো তাঁকে আমি ভালোবাসি।”
কবীর ভাই বললেন, বউয়ের কথা শুনে মা আর কোন কথা বলেন নাই। পরবর্তীতে এ নিয়ে তিনি (মা) আর কোন টু শব্দ করেননি।
কবীর ভাই আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আছে এরকম মাস্তান বউ? মাস্তান সাংবাদিক হতে চাইলে আগে লাগবে মাস্তান বউ। বলে চললেন, সকালে অফিসে গেছি, মতের অমিল হয়েছে, অনৈতিক কিছু দেখেছি, বিকেলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাসায় চলে এসেছি। আপনার ভাবি টু শব্দ করেনি। বাচ্চার দুধ কেনার পয়সা নাই, ঘরে চাল নাই। এমন হয়েছে, আপনার ভাবি অনেক দিন শুধু বিস্কুট খেয়ে হাসিমুখে দিন পার করেছে। তবুও আমাকে কোনদিন বাঁকা কথা বলেনি। শুধু একটাই কথা বলেছে, তুমি গাছতলায় থাকলে আমিও থাকব।
এতোক্ষণ তাঁর কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম। আমি যেন অন্য এক জগতে আছি। এতো সুন্দর বাচনভঙ্গি, নান্দনিক শব্দচয়ন যেন আর শুনি নাই।
আমার ঘোর কাটাতে তিনি বললেন, বলেন, আপনার প্রশ্ন কি? এরপর ইন্টারভিউ করে চলে আসলাম।
শুভ জন্মদিন মাস্তান সাংবাদিক নূরুল কবীর ভাই। আপনার মতো মাস্তান সাংবাদিক আরও দরকার।
লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, বাংলাভিশন