:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সপ্তাহের ব্যবধানে কমেছে ১২ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কমে ১ হাজার ৯৪০ কোটি ডলার বা ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়নে নেমে এসেছে।
আগের সপ্তাহের বুধবার যা ছিল ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। দেশের প্রকৃত রিজার্ভ ১৬ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের কম।
গত বুধবার মোট রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৫০২ কোটি ডলার। তবে রিজার্ভ থেকে গঠন করা রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ), লং টার্ম ফান্ড (এলটিএফ) ও গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ), বাংলাদেশ বিমানকে উড়োজাহাজ কিনতে সোনালী ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে দেওয়া অর্থ এবং পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচির রিজার্ভ বাদ দিলে, অর্থাৎ আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভ হচ্ছে ১ হাজার ৯৪০ কোটি ডলার। তবে এর পুরোটাই দায়হীন নয়। এর মধ্যে সাড়ে ৩ বিলিয়ন মানে ৩৫০ কোটি ডলারের ওপর দায় রয়েছে। যার মধ্যে আইএমএফের সদস্যদেশ হিসেবে বাংলাদেশকে দেওয়া ২ বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলারের কিছু বেশি ঋণ রয়েছে। আবার ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক দায় পরিশোধের জন্য ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটির কিছু বেশি ডলার আছে। পাশাপাশি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল পরিশোধের জন্য প্রায় ৫০ কোটি ডলার রয়েছে রিজার্ভে। ফলে নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ আছে ১৬ বিলিয়ন, অর্থাৎ ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের কম।
যুগপৎ ডলার ও টাকার সংকটে থাকা ইসলামী ব্যাংক বেশি দামে কিনে কম দামে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিক্রি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ বাড়াতে এসব ডলার কিনছে। তবে সরকারি আমদানির দায় মেটাতে এর চেয়ে বেশি পরিমাণ বিক্রি করছে। ফলে রিজার্ভে টান পড়ছে।
এদিকে ডলার সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে বিদেশ থেকে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহের সুযোগ দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, তিন মাস থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি ডলার রেখে ৭ থেকে ৯ শতাংশের বেশি সুদ দিতে পারবে ব্যাংকগুলো। অন্য দেশের সুদের হার এর চেয়ে কম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, গ্রস রিজার্ভ ও নেট রিজার্ভ খরচের মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয়েছে। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত রিজার্ভ কমেছে ১৩ কোটি ৯৯ লাখ ৩৭ হাজার ডলার। গত ২২ নভেম্বর যেখানে বৈদেশিক মুদ্রায় গঠিত তহবিলসহ গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৫ দশমিক ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা দুই হাজার ৫১৬ কোটি ১৩ লাখ ৪০ হাজার ডলার। এক সপ্তাহে কমে তা দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বা দুই হাজার ৫০২ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার।
বর্তমানে সরকারের জ্বালানি আমদানির মতো গুরুত্বপূর্ণ পূর্ণ কাজে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হয়। এতেই এক সপ্তাহে প্রায় ১৪ কোটি ডলার খরচ হয়েছে।
বাংলাদেশ সাধারণত রিজার্ভ থেকে গঠিত তহবিলসহ রিজার্ভের হিসাব করতো। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেওয়ার শর্ত অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে প্রচলিত ও বহুল ব্যবহৃত আইএমএফের ব্যালেন্স অব পেমেন্টস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম৬) অনুযায়ী হিসাব দেখানো শুরু করে।
সেই অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে রিজার্ভ গণনায় তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য বিদেশি মুদ্রায় গঠিত তহবিল, বিমানকে দেওয়া ঋণ গ্যারান্টি, পায়রাবন্দর কর্তৃপক্ষকে দেওয়া ঋণ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকে আমানত এবং নির্দিষ্ট গ্রেডের নিচে থাকা সিকিউরিটিতে বিনিয়োগ রিজার্ভ থেকে বাদ দেয়। অবশিষ্ট ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভকে নেট বলা হচ্ছে। পাশাপাশি মোট রিজার্ভও দেখানো হয়।
আইএমএফ জুনের মধ্যে দেশের গ্রস রিজার্ভ ২ হাজার ৯৯৬ কেটি ডলারে নেমে যাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল, যা মোট আমদানি ব্যয়ের সাড়ে ৩ মাসের সমান। একই সঙ্গে ওই সময়ে নিট রিজার্ভ ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ২০ লাখ ডলারে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা করেছিল।
গ্রস রিজার্ভ আইএমএফ-এর পূর্বাভাসের মধ্যে থাকলেও নিট রিজার্ভ ছিল কিছুটা কম। এই রিজার্ভ দিয়ে ২ দশমিক ৯ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। অর্থাৎ তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের চেয়ে কম।
চলতি অর্থবছরের জুনের মধ্যে গ্রস রিজার্ভ বেড়ে ৩ হাজার ৪২৩ কোটি ডলারে উঠতে পারে। নিট রিজার্ভ ২ হাজার ৮৭৩ কোটি ২০ লাখ ডলারে নামতে পারে, যা দিয়ে ৩ দশমিক ২ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। অর্থাৎ আইএমএফ-এর শর্তের মধ্যে রিজার্ভ ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তা আরও কমে যাচ্ছে।
৩০ জুন রিজার্ভ ৩ হাজার ১২০ কোটি ডলার ছিল। এ হিসাবে ২০ দিনের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে ১৩৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের দেনা বাবদ ১১০ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। সেপ্টেম্বরের আগে আর বড় ধরনের দেনা শোধ করতে হবে না।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ রয়েছে। যে কারণে রিজার্ভ স্বস্তিতে রাখাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত জুনে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে।
চলতি জুলাইয়েও রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা বেড়েছে। তবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত রপ্তানি আয় খুব একটা বাড়ছে না। প্রধান বাজারগুলোয় রপ্তানি কমে যাওয়ায় আয়ও কমে যেতে পারে। ফলে রিজার্ভ চলতি অর্থবছরেও চ্যালেঞ্জের মধ্যে থাকবে।
উল্লেখ্য, ১৯৮১-৮২ অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১২ কোটি ১০ লাখ ডলার।
পাঁচ বছর পর ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছর শেষে সেই রিজার্ভ বেড়ে হয় ৭১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ১৯৯১-৯২ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলার অতিক্রম করে ১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। পরের ১৯৯২-৯৩ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ২ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।
৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছর শেষে। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছর শেষে তা কমে ২ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে তা আরও কমে ১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
এরপর ১৯৯৭-৯৮ থেকে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর পর্যন্ত রিজার্ভ দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করে।
২০০০-০১ অর্থবছরে রিজার্ভ কমে ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে আসে। ওই অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার থাকলেও অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে তা ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল। তখনই আকুর বিল পুরোটা পরিশোধ না করে অর্ধেক করা হয়েছিল।
২০০১-০২ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ বেড়ে হয় ১ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার।
২০০৫-০৬ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা ১৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।
২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। পরের বছর ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১৬ সালের জুনে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।
দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর ২০২০ সালের মার্চ শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। মহামারির এই সময়েই রিজার্ভ বেড়েছে সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলার।
২০২০ সালের ৩ জুন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ২৪ জুন সেই রিজার্ভ আরও বেড়ে ৩৫ বিলিয়ন ডলার হয়।
২০২০ সালের ৩০ জুন রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। এক মাস পর ২৮ জুলাই রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়ন ডলারের ঘরও অতিক্রম করে। তিন সপ্তাহ পর গত ১৭ আগস্ট রিজার্ভ ৩৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়।
২০২০ সালের মাত্র দেড় মাসে ৩৪ বিলিয়ন ডলার থেকে রিজার্ভ ৪ বিলিয়ন ডলার বেড়ে ৩৮ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।
২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর রিজার্ভ ছাড়ায় ৩৯ বিলিয়ন ডলার। ৮ অক্টোবর ছাড়ায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। ২৯ অক্টোবর অতিক্রম করে ৪১ বিলিয়ন ডলার। ৪২ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায় ১৫ ডিসেম্বর।
২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর ৪৩ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে রিজার্ভ।
২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়।
২০২১ সালের ২৮ এপ্রিল অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। একই বছরের ৪ মে আকুর ১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে।