ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার ও মুজিবনগর দিবস

আজ ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। বাঙালি জাতির জীবনে একটি অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এদিনে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় এক আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণ করে।

পরে বৈদ্যনাথতলাকে মুজিবনগর হিসেবে নামকরণ করা হয়। অস্থায়ী সরকারের সফল নেতৃত্বে মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে যায় মেহেরপুরের মুজিবনগর।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বরোচিত হামলা চালানোর পর একই বছরের ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা

অস্থায়ী এ সরকারের রাষ্ট্রপতি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। অন্যতম ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তারা শপথ গ্রহণ করেন ১৭ এপ্রিল। সেদিন মুজিবনগরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম সরকার।

বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে করা হয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করা হয়। সরকারে আরো ছিলেন অর্থমন্ত্রী এ মনছুর আলী, স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পূনর্বাসন মন্ত্রী হিসাবে এ এইচ এম কামরুজ্জামান, পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী হিসাবে খন্দকার মোশতাক আহামেদ ।

অস্থায়ী সরকারের উপদেষ্টা হন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, কমরেড মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী অস্থায়ী সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার এবং মেজর জেনারেল আবদুর রব চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন।

১১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ দেশবাসীর উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেন। এই ভাষণ ভারতের সরকারি রেডিওস্টেশন ‘আকাশবাণী’ থেকে একাধিকবার প্রচারিত হয়। তাজউদ্দিনের ভাষণের মধ্য দিয়েই দেশ-বিদেশের মানুষ জানতে পারে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্যে একটি আইনানুগ সরকার গঠিত হয়েছে।

১৭ এপ্রিল সকালে মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ সরকার গঠনের ফলে বিশ্ববাসী স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামরত বাঙালিদের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে। মুজিবনগর সরকার গঠন বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য গৌরবগাথা ও সাফল্যের স্বাক্ষর।

মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদকে গার্ড অব প্রদান করেন তৎকালীন ঝিনাইদহ মহকুমায় পুলিশ প্রশাসক (এসডিপিও) মাহবুব উদ্দিন আহমদ ।

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসে ঘোষণা পত্র পাঠ করেন দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সদস্য ও আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির চীফ হুইফ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। বাংলাদেশের প্রথম সরকারকে শপথবাক্য পাঠ করান তিনি।
মুজিবনগর সরকার দেশকে ৬টি জোনাল কাউন্সিলে ভাগ করেছিল যা জনগনের সমস্যার দেখভাল করত। সে সময় মুজিবনগর হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের প্রেরণার উৎস এবং জাতির ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখতে যথাসম্ভব যা কিছু করার ছিল তাই করেছিল। মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন আমাদের মুক্তি সংগ্রামে এবং ইতিহাসে এক মাইল ফলক। যা বিশ্বকে সাহায্য করেছিল আমাদের মুক্তিযোদ্ধাকে সমর্থন করতে। পরবর্তীতে চুড়ান্ত ভাবে স্বীকৃত পেয়েছিল একটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে। মুজিবনগরে অস্থায়ীভাবে স্থাপিত হয়েছিল সেক্রেটারিয়েট যার ক্যাম্প অফিস স্থাপন করা হয়েছিল কলকাতার ৮ নং থিয়েটার রোডে।

এ অস্থায়ী সরকারের সফল নেতৃত্বে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। পরে এ বৈদ্যনাথতলাকেই ঐতিহাসিক মুজিবনগর হিসেবে নামকরণ করা হয়।

১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় হাজার হাজার মানুষের সামনে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ নেন। দেশি-বিদেশি প্রায় ৫০ সাংবাদিকের সামনে বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র পাঠ এবং মুক্তিবাহিনীর মার্চপাস্ট অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন আআম্রকানন লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। আনন্দ-আবেগে উদ্বেলিত শত শত কণ্ঠের ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, গগন বিদারী স্লোগানে স্লোগানে আম্রকাননের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। চৌকি পেতে তৈরি করা হয় শপথ মঞ্চ। মঞ্চের ওপর সাজানো ৬টি চেয়ার। আশপাশের বাড়ি থেকে চৌকি, চেয়ার ও বাঁশ আনা হয়। ওপরে শামিয়ানাও লাগানো সম্ভব হয়নি, ফলে খোলা আকাশেই মঞ্চ তৈরি করা হয়। বেলা ১টায় শুরু হয় শপথ অনুষ্ঠান।

মুজিবনগরের আম্রকাননে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার ভাষণে বলেন “আজ এই মুজিবনগরে একটি স্বাধীন জাতি জন্ম নিল। বিগত ২৪ বছর যাবৎ বাংলার মানুষ তাঁর নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব নেতাদের নিয়ে এগুতে চেয়েছেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদীরা তা হতে দেয়নি। তারা আমাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথে এগুতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তাতেও তারা বাধার সৃষ্টি করে আমাদের উপর চালালো বর্বর আক্রমণ। তাই আমরা আজ মরণপণ যুদ্ধে নেমেছি। এ যুদ্ধে জয় আমাদের অনিবার্য। আমরা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে বিতাড়ন করবোই। আজ না জিতি কাল জিতবো। কাল না জিতি পরশু জিতবোই। বাংলাদেশে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার ঘটনা দেখেও বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রবর্গ আজ যে নীরবতা অবলম্বন করছেন তার জন্য আমি গভীরভাবে দুঃখিত। আমি প্রশ্ন করতে চাই লক্ষ লক্ষ নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে বিনা কারণে হত্যা করাকে ইসলাম অনুমোদন করে কি? মসজিদ, মন্দির বা গীর্জা ধ্বংস করার কোন বিধান কি ইসলামে আছে? বাংলাদেশের মাটিতে আর কোন সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের মাতৃভাষাকে মুক্ত করতে যুদ্ধ করছে। নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে স্তব্ধ করা যাবে না। পৃথিবীর মানচিত্রে আজ যে নতুন রাষ্ট্রের সংযোজন হল তা চিরদিন থাকবে। এমন কোন শক্তি নেই যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বকে বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে পারে।”

শপথ অনুষ্ঠানের পর বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বলেন ‘শেখ সাহেবের অসহযোগ আন্দোলন আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। অসহযোগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি সৃষ্টি করলেন এক নতুন ইতিহাস। বাংলাদেশে ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন যেভাবে এগিয়ে গেছে মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে তার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। এত কার্যকরি অসহযোগ আন্দোলন কোথাও সাফল্য লাভ করেনি। পূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন চলেছে দেশের সর্বত্র। নতুন গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য পাওয়া গেল না হাইকোর্টের কোন বিচারপতি। পুলিশ এবং পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসসহ গণ-প্রশাসন বিভাগের কর্মচারিগণ কাজে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। জনগণ সেনাবাহিনীর সরবরাহ বন্ধ করে দিল। এমনকি সামরিক দপ্তরের অসামরিক কর্মচারিগণ তাদের অফিস বয়কট করলেন। কেবল কাজে যোগদান থেকে বিরত থেকে তারা ক্ষান্ত হলেন না, অসামরিক প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের লোকেরাও সক্রিয় সমর্থন ও নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করলেন শেখ সাহেবের প্রতি। তারা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করলেন যে, আওয়ামী লীগ প্রশাসনের নির্দেশ ছাড়া তারা অন্য কারো নির্দেশ মেনে চলবেন না।’

এ অবস্থার মুখোমুখি হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাসীন না হয়েও অসহযোগের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার দায়িত্ব স্বহস্তে গ্রহণে আওয়ামী লীগ বাধ্য হল। এ ব্যাপারে শুধু আপামর জনগণই নয়, বাংলাদেশের প্রশাসন ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন লাভ তারা করেছিলেন। তারা আওয়ামী লীগের নির্দেশাবলী সর্বান্তকরণে মাথা পেতে মেনে নিলেন এবং সমস্যাবলীর সমাধানে আওয়ামী লীগকে একমাত্র কর্তৃপক্ষ বলে গ্রহণ করলেন। অসহযোগ আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ফাটল ধরলে দেখা দেয় নানাবিধ দুরূহ সমস্যা। কিন্তু এসব সমস্যাবলীর মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দপ্তরের কাজ যথারীতি এগিয়ে যাচ্ছিল।’

এইচটি ইমাম ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-৭৫’ নামে যে তথ্যবহুল বইটি লিখেছেন, সেখানে বলেছেন, ‘বাংলাদেশকে হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কবলমুক্ত করতে মুক্তিযুদ্ধ তথা জনযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। এই ইতিহাসের সঙ্গে প্রথম বাংলাদেশ সরকার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, শরণার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা মেটানো, অধিকৃত বাংলাদেশে প্রশাসন ব্যবস্থাপনা সামলানো, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, খাদ্য রসদ সংগ্রহ, চিকিৎসাসেবা দান, পররাষ্ট্রবিষয়ক তৎপরতা সচল রাখা ইত্যাদি যাবতীয় রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় প্রথম বাংলাদেশ সরকারের যেসব মন্ত্রী, কর্মকর্তা, কর্মী, কর্মচারী সংশ্লিষ্ট ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে তাদের নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’

একনজরে মুজিবনগর সরকার
স্থাপিত : ১০ই এপ্রিল ১৯৭১
শপথ গ্রহণ : ১৭ই এপ্রিল ১৯৭১
অস্থায়ী সচিবালয় : মুজিবনগর
ক্যাম্প অফিস : ৮, থিয়েটার রোড, কোলকাতা
রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী)
উপ-রাষ্ট্রপতি : সৈয়দ নজরুল ইসলাম (অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি)
প্রধানমন্ত্রী : তাজউদ্দিন আহমেদ
অর্থমন্ত্রী : এম. মনসুর আলী
স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী : এম কামরুজ্জামান
পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী : খোন্দকার মোশতাক আহমেদ

মন্ত্রণালয় ও দফতরসমূহ
(১) প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়
(২) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
(৩) অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
(৪) মন্ত্রিসভা সচিবালয়
(৫) সাধারণ প্রশাসন বিভাগ
(৬) স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়
(৭) তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়
(৮) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
(৯) ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়
(১০) সংসদ বিষয়ক বিভাগ
(১১) কৃষি বিভাগ এবং
(১২) প্রকৌশল বিভাগ।

মুজিবনগর সরকারের উপরাষ্ট্রপতি,প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গ এবং প্রধান সেনাপতি
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এস.এ সামাদ প্রতিরক্ষা সচিব। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম.এ.জি ওসমানী, চীফ অব স্টাফ কর্নেল আবদুর রব, উপ-সেনাপতি এ.কে খন্দকার, এবং ডি.জি মেডিকেল সার্ভিস ও বিভিন্ন পদবীর স্টাফ অফিসার এ দপ্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যুদ্ধরত অঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে প্রতিটিতে একজন করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। তবে ১০নং বা নৌ সেক্টরে কোন সেক্টর কমান্ডার ছিল না, কমান্ডোরা যখন যে এলাকায় অভিযান করত সে সেক্টরের কমান্ডারের অধীনে থাকত। এ ছাড়াও জেড ফোর্স, কে ফোর্স ও এস ফোর্স নামে তিনটি ব্রিগেড গঠন করা হয়। ব্রিগেডগুলির কমান্ডার হলেন যথাক্রমে মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ এবং মেজর কে.এম সফিউল্লাহ।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

যুদ্ধের সময় বিদেশে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করে এবং বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে বহির্বিশ্বের সরকার ও জনগণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে এ মন্ত্রণালয়। এ লক্ষে কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, স্টকহোম প্রভৃতি স্থানে কূটনৈতিক মিশন স্থাপন করা হয় এবং জাতিসংঘ, আফগানিস্তান, সিরিয়া-লেবানন, নেপাল, শ্রীলংকা, বার্মা, থাইল্যান্ড, জাপান প্রভৃতি দেশের সমর্থন আদায়ের জন্য কূটনৈতিক প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে এ মন্ত্রণালয় থেকে পত্র প্রেরিত হয়। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোর প্রধান ছিলেন কলকাতায় হোসেন আলী, দিল্লিতে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, ইউরোপে বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, ওয়াশিংটনে এম আর সিদ্দিকী। স্টকহোমে আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশ মিশনের প্রতিনিধিত্ব করেন।

বাংলাদেশ সরকার প্রেরিত কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সিরিয়া-লেবাননে মোল্লা জালাল উদ্দীন এমএনএ ও ড. মাহমুদ শাহ কোরেশী, আফগানিস্তানে আবদুস সামাদ আজাদ, আশরাফ আলী চৌধুরী এমএনএ, মওলানা খায়রুল ইসলাম যশোরী ও এডভোকেট নূরুল কাদের। নেপালে প্রেরিত হন আবদুল মালেক উকিল, সুবোধচন্দ্র মিত্র ও আবদুল মোমিন তালুকদার। এডভোকেট ফকির শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে শামসুল হক ও জ্যোতিপাল মহাথেরো শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড ও জাপান গমন করেন। মাহবুব আলম চাষী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পররাষ্ট্র দপ্তর অবস্থিত ছিল কলকাতার ৯ সার্কাস এভিনিউতে।

অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
এম মনসুর আলী এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও খন্দকার আসাদুজ্জামান ছিলেন সচিব। যুদ্ধের সময় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উল্লেখযোগ্য কোন কাজ ছিল না। তবে অর্থ বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করে: সরকারের আয়-ব্যয়ের বাজেট প্রণয়ন; বাংলাদেশের অভ্যন্তর ও অন্যান্য উৎস হতে প্রাপ্ত সম্পদের হিসাব তৈরি; বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গকে অর্থ প্রদানের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন; আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা; রাজস্ব ও শুল্ক আদায়; এবং যেকোন আর্থিক অনিয়ম রোধের জন্য কমিটি গঠন।

বাংলাদেশ সরকার তার আয়ের উৎস ও ব্যয়ের খাত নির্ধারণ করে প্রথমে ছয় মাসের জন্য একটি বাজেট তৈরি করে। বাংলাদেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থ সংরক্ষণের জন্য ট্রেজারি স্থাপন করে এবং প্রবাসী বাঙালি ও বিভিন্ন বিদেশী নাগরিক ও সংস্থার তরফ থেকে প্রাপ্ত অর্থ বাংলাদেশ ফান্ড নামের একটি তহবিলে জমা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বেতন-ভাতা ছাড়া অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়ের প্রস্তাব প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপিত হত এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের কাছে সে অর্থ পৌঁছাত। সরকারি ব্যয়ের স্বচ্ছতার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়।

মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়

মন্ত্রিপরিষদের সভায় বিভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপন, সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ এবং এসব বিষয়াদি লিপিবদ্ধকরণ মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়ের আওতাভুক্ত ছিল। মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হবার পর পরিষদের প্রথম দুই মাসের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকাংশই তাজউদ্দীন আহমদ নিজ হাতে লিপিবদ্ধ করেন। এরপর এইচ টি ইমাম সচিব হিসেবে যোগ দেবার পর অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীদের সমনতয়ে সচিবালয় গড়ে ওঠে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজের সমন্বয় সাধনে মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সাধারণ প্রশাসন বিভাগ
নিয়োগ, বদলী, পদোন্নতি ও চাকরির বিধি প্রণয়নের নিমিত্তে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের আওতায় সাধারণ প্রশাসন বিভাগ সৃষ্টি করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রধানত দ্বিতীয় শ্রেণীর বিভিন্ন নিয়োগ এ বিভাগের আওতাধীন ছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তালিকা বহির্ভূত ব্যক্তিবর্গকে চিহ্নিতকরণ এবং বিভিন্ন নিয়োগের জন্য প্যানেল তৈরি করাও ছিল এ বিভাগের দায়িত্ব। নুরুল কাদের সংস্থাপন সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
জোনাল প্রশাসনিক কাউন্সিল

সাধারণ প্রশাসন বিভাগের আওতায় এ কাউন্সিল গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনের পক্ষে দেশের অভ্যন্তরে প্রতিটি জেলায় সরাসরি কাজ করা অসম্ভব বিধায় কয়েকটি জেলার সমন্বয়ে একটি করে প্রশাসনিক জোন গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৯টি জোন এবং পরবর্তী সময়ে আরও দু’টি জোন প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিটি জোনের একটি হেডকোয়ার্টার ছিল এবং একজন চেয়ারম্যান (এমএনএ বা এমপিএ) ও একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা জোনের দায়িত্ব পালন করেন। সংশ্লিষ্ট জোনের চেয়ারম্যান, সদস্য, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও অন্যান্য কর্মচারীদের সমন্বয়ে প্রশাসনিক কাউন্সিল গঠিত হয়।

দায়িত্ব ও কর্তব্য
মন্ত্রিসভা কর্তৃক জোনাল প্রশাসনিক কাউন্সিলের জন্য গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, জোনের ওপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব তথা জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা, উদ্বাস্ত্তদের ত্রাণ সহায়তা প্রদান, বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে ত্রাণ প্রদানের বিষয়টির সমন্বয় সাধন, যুবক্যাম্পগুলোকে সাধ্যমত সহায়তা প্রদান এবং সেক্টর কমান্ডকে সহায়তা করা জোনাল প্রশাসনিক কাউন্সিলের প্রধান কাজ ছিল। মুক্তাঞ্চলে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন যে কার্যকর রয়েছে তা জনগণকে বোঝানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করাও জোনাল প্রশাসনের দায়িত্ব ছিল। সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করে ৫ দিনের নোটিশে প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা সচিবকে মাসে কমপক্ষে একটি সভা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হত।

স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়
এ মন্ত্রণালয় একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে প্রথম কাজ শুরু করে। পরবর্তী সময়ে মহাপরিচালককে সচিবের মর্যাদা দেয়া হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের কাজ দুভাগে বিভক্ত ছিল: (ক) সেনাবাহিনী তথা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা ও (খ) বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ বা সরাসরি অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করে নি এমন জনগণকে চিকিৎসা প্রদান। এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল, চিকিৎসক নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ, ঔষধ-পথ্য সংগ্রহ, মাঠ পর্যায়ে চিকিৎসক দল প্রেরণ, শল্য চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, এবং আহত ও নিহতদের জন্য পরিবহণের ব্যবস্থা করা। ডা. টি হোসেন প্রথমে স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালক এবং পরে স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব নিযুক্ত হন।

তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে বসবাসরত বাঙালিদের মনোবল উজ্জীবিত রাখার প্রয়োজনে এ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এ মন্ত্রণালয় প্রধানত চারটি মাধ্যমে এর কর্মকান্ড পরিচালনা করত: (ক) বেতার (স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র), (খ) চলচ্চিত্র, (গ) প্রকাশনা, (ঘ) চারুকলা ও ডিজাইন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
মুক্তাঞ্চল, শরণার্থী ক্যাম্প ও ট্রেনিং ক্যাম্পে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা এ মন্ত্রণালয়ের প্রধান দায়িত্ব ছিল। মুক্তাঞ্চলে প্রশাসনিক কাঠামো তৈরির ব্যাপারে সরকারকে সহায়তা এবং যুদ্ধ এলাকা ও মুক্তাঞ্চলে গোয়েন্দা তৎপরতা পরিচালনার জন্য গোয়েন্দা বিভাগ গঠন করা হয়। এ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ পুলিশের পোশাক, ব্যাজ ও মনোগ্রাম নির্ধারণ করে। আবদুল খালেককে প্রথমে পুলিশের আই.জি ও পরে স্বরাষ্ট্র সচিব নিয়োগ দেয়া হয়। যুদ্ধের শেষদিকে বাংলাদেশকে ৪টি রেঞ্জে ভাগ করে চারজন ডিআইজি ও প্রত্যেক জেলায় এসপি নিয়োগ করা হয়। ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশী জনগণের ভ্রমণ ডকুমেন্ট ইস্যু করাও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল।

ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ
ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। শরণার্থীদের আবেদন বিবেচনা করে তাদের সাধ্যমত সহায়তা প্রদান করা হত। ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা হয়: (ক) ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি এবং (খ) উদ্বাস্ত্ত কল্যাণ বোর্ড।
সংসদ বিষয়ক বিভাগ পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ বিভাগ কাজ করে। প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদ সদস্যদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান এবং তাদের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করা এ বিভাগের প্রধান দায়িত্ব ছিল। মুক্তিযোদ্ধা বাছাই, শরণার্থীদের আবাসন ও যুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে পরিষদ সদস্যগণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এসব কর্মকান্ডের জন্য তাদের ভাতা প্রদান করা হত।

কৃষি বিভাগ
যুদ্ধপরবর্তী সময়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ এবং যুদ্ধকালীন ক্ষতির বিবেচনায় কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে কিভাবে খাদ্য সংকট কাটিয়ে উঠা যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নেবার জন্য এ বিভাগ কাজ করে। নুরুদ্দিন আহমদ কৃষি সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
প্রকৌশল বিভাগ যুদ্ধে সেক্টরগুলোতে প্রকৌশল বিষয়ক সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষ করে দ্রুত রাস্তা নির্মাণ ও মেরামত এবং সেতু মেরামতের জন্য কিছুসংখ্যক প্রকৌশলীকে এ বিভাগের অধীনে নিয়োগ করা হয়। এমদাদ আলী প্রধান প্রকৌশলী নিযুক্ত হন।

পরিকল্পনা সেল
আওয়ামী লীগের ছয়দফা এবং ১৯৭০-এর নির্বাচনে এ দলের ইশতেহারের পরিপ্রেক্ষিতে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে দেশকে গড়ে তোলার জন্য, বিশেষ করে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কিভাবে দ্রুত কাটিয়ে উঠা যায় সে বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য সরকার এ সেল গঠন করে। পাকিস্তান শাসনামলে উন্নয়নবঞ্চিত এলাকা চিহ্নিতকরণ ও প্রশাসনিক পুনর্গঠন বিষয়ে পরামর্শ দেয়াও এর কাজ ছিল। প্রাথমিকভাবে বাস্ত্তহারাদের পুনর্বাসন, খাদ্য সরবরাহ, স্বাস্থ্য, পানি-বিদ্যুৎ ও বন্ধ শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালুর বিষয়ে এ সেল সরকারকে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দান করে। এ সেলই পরবর্তী সময়ে পরিকল্পনা কমিশনে রূপান্তরিত হয়। ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী চেয়ারম্যন এবং ড. খান সারোয়ার মুর্শেদ, ড. মোশাররফ হোসেন, ড. এস.আর বোস ও ড. আনিসুজ্জামান পরিকল্পনা সেলের সদস্য ছিলেন।

যুব ও অভ্যর্থনা শিবির নিয়ন্ত্রণ বোর্ড
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী যুবকদের প্রথমে অভ্যর্থনা ক্যাম্পে এবং পরে সেখান থেকে যুবক্যাম্পে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হত। জোনাল প্রশাসনিক কাউন্সিলগুলোর আওতায় উভয় ক্যাম্প পরিচালিত হত। এ বোর্ডের চেয়ারম্যান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাহায্যে কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে মোট ১০৬টি যুব ক্যাম্প ও ১১২টি অভ্যর্থনা ক্যাম্প ছিল। বোর্ডের প্রস্তাবের ভিত্তিতে সরকারের বাজেটেই উভয় ক্যাম্প পরিচালিত হয়। অধ্যাপক ইউসুফ আলী যুব ও অভ্যর্থনা শিবির নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া প্রতিটি ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন একজন করে এমএনএ বা এমপিএ। [মোহাম্মদ ফায়েকউজ্জামান ]

মন্ত্রণালয়ের বাইরে আরও কয়েকটি সংস্থা ছিল, যারা সরাসরি মন্ত্রিসভার কর্তৃত্বাধীনে কাজ করত, যেমন-
(১) পরিকল্পনা কমিশন
(২) শিল্প ও বাণিজ্য বোর্ড
(৩) নিয়ন্ত্রণ বোর্ড, যুব ও অভ্যর্থনা শিবির
(৪) ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি
(৫) শরণার্থী কল্যাণ বোর্ড।

বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন
মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক হিসেবে নিম্নলিখিত বেসরকারি সংস্থা, দল, গোষ্ঠী, সমিতি, বাহিনী ইত্যাদি ভূমিকা পালন করেছে-
(১) যুব নিয়ন্ত্রণ পরিষদ ও প্রশিক্ষণ বোর্ড
(২) বাংলাদেশ হাসপাতাল
(৩) স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
(৪) জয় বাংলা পত্রিকা (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপত্র)
(৫) বাঙলাদেশ বুলেটিন
(৬) বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী সংগঠন
(৭) বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি
(৮) স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল
(৯) বঙ্গবন্ধু শিল্পী গোষ্ঠী
(১০) বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী গোষ্ঠী
(১১) বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি
(১২) বাংলাদেশ সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী পরিষদ
(১৩) নিউইয়র্ক বাংলাদেশ লীগ
(১৪) বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি, লন্ডন এবং
(১৫) লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্টসিয়া।

বাংলাদেশ সরকার দেশবাসীর প্রতি নিম্নলিখিত নির্দেশাবলী জারি করে
১. পাক সরকার ও দখলদার বাহিনীকে কোন প্রকার সহযোগিতা করা চলবে না। সকল প্রকার খাজনা, শুল্ক পাক সরকারকে দেয়া চলবে না।
২. আঠারো থেকে ত্রিশ বছরের যুবকরা অবিলম্বে মুক্তিফৌজের অধিনায়ক বা প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবেন।
৩. পাটের পরিবর্তে আউস ধান চাষ করতে হবে।
৪. গণধিকৃত দখলদার নিঃশেষ করতে হবে। সংগ্রামবিরোধী গোয়েন্দাদের নির্মূল করা প্রত্যেকটি বাঙালীর কর্তব্য।
৫. মুক্তিফৌজের সাথে সর্বপ্রকার সহযোগিতা এবং দখলদার বাহিনীর প্রতিপদে বাধা দিতে হবে।
৬. সকল সরকারী-বেসরকারী কর্মচারীদের পাক সরকারের অধীনে কাজে যোগ না দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে মুক্তি সংগ্রামের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

গ্রন্থপঞ্জি
হাসান হাফিজুর রহমান, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, ঢাকা, ১৯৮২; এইচ.টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, ২০০৪; নূরুল কাদের, একাত্তর আমার, ১৯৯৯; শামসুল হুদা চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর, ১৯৮৫; বি বি বিশ্বাস, একাত্তরে মুজিবনগর, ২০০০; মোহাম্মদ ফায়েকউজ্জামান, মুজিবনগর সরকার ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ঢাকা, ২০০৮।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *