:: ফেনী বুলবুল ::
আলহামদুলিল্লাহ! জীবনের আরেকটি ঈদ বাবা-মা এর সাথে নিজ গাঁয়ে করার সৌভাগ্য হলো। বছরজুড়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়, তাই ছুটি পেলে ঘুমটাকে সকালবেলা পার করে দীর্ঘ করি। ঈদের পরদিনও সেইরকম ইচ্ছাই ছিলো, কিন্তু ভোরবেলায় আমার একমাত্র কন্যা এসে ডেকে তুলে বললো, ‘বাবা বাহিরে হাঁটতে যাবো’। কি আর করা, কন্যাকে নিয়ে হাঁটতে বের হলাম। ভোরবেলায় গ্রামের রাস্তায় কোন মানুষজন নেই, ঠান্ডা ঠান্ডা ফুরফুরে বাতাস হাঁটতে বেশ লাগছিলো। বাড়ির রাস্তা পার হয়ে খালের পাড় ধরে হাঁটতে থাকলাম। হাঁটতে হাঁটতে বাদশা মিয়ার পুলের উপর উঠার পর একটা কুকুর এসে আমাদের সাথে যোগ দিলো। কুকুরটি এমনভাবে চলছিলো যেন সে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে বেশ প্রশিক্ষিত। আমাদের আগে আগে হাঁটছে, আবার হঠাৎ করে ঘুরে পিছনে যাচ্ছে। পিছন থেকে একবার ডানপাশ দিয়ে একবার বামপাশ দিয়ে সামনে যাচ্ছে। কুকুরটা যখন গা ঘেষে সামনে পিছনে যাচ্ছে তখন আমার কন্যা কিছুটা ভয় পাচ্ছে। কন্যাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বললাম ভয়ের কিছু নাই, কুকুরটা আমাদেরকে পাহারা দিচ্ছে। কন্যাকে এই কথা বললেও আমি কিন্তু মনে মনে ভাবছি- কুকুরটা কেন আমাদের সাথে এমন করছে? ওতো আমাকে কখনোই দেখেনি। কারন দুই ঈদ ছাড়া এখনতো আর আমাদের তেমন একটা গাঁয়ে যাওয়া হয় না। নিজের ভাবনার উত্তর নিজেই আবার দিই এই বলে যে- কুকুরটি এই এলাকার আর আমিওতো এই মাটিরই ছেলে। তাই কুকুরটি হয়তো আমার গায়ে এই গাঁয়ের মাটির গন্ধ পেয়েছে।
বাদশা মিয়ার পুল হতে উচুঁপুল যাওয়ার রাস্তার ডানপাশ জুড়ে পুরোটাই রামগোপাল প্রান্তর (রাম্ঙল হাতর)। উত্তরে বাদশা মিয়ার বাড়ির সামনের খাল হতে দক্ষিনে ভূইঁয়া বাড়ির (রাম দয়াল ভূইয়া বাড়ি) উত্তরের রাস্তা পর্যন্ত বিস্তৃর্ন এই মাঠ। উর্বর ভূমি হিসাবে খ্যাত এই মাঠ একসময়ে ফসলে ফসলে ভরে থাকতো। বর্তমানে দিনমজুরের অভাবে আমাদের এলাকায় কৃষিকাজ একেবারে নাই বললেই চলে। তাই এই দৃষ্টিজোড়া বিস্তৃর্ন প্রান্তর এখন তারাবনে ভরে গেছে। মাটিখেকো ব্রিকফিল্ডের মাটির দালাল আর জমির প্রতি মায়ামমতাহীন নিষ্ঠুর জমিমালিকদের মাটি বিক্রির বিকিকিনির নির্মম শিকার এই প্রান্তর। ফলে পুরো প্রান্তরের বুকজুড়ে ক্ষতবিক্ষত বিশাল বিশাল গর্ত। তারাবন, গর্ত আর জঙ্গলে মিলে এই প্রান্তর এখন শত শত শিয়ালের অভয়ারন্য। আমি আর কন্যা উঁচু পুল যাওয়ার মাঝামাঝি রাস্তায় গিয়ে হঠাৎ ভীষণ চেচাঁমেচি শুনে রামগোপাল প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে দেখি দুই গ্রুপ শিয়ালের ভয়ংকর এক গ্যাং ফাইট। গ্যাং ফাইটটা কতটা ভয়ংকর ছিলো সেটা লিখে বোঝানোর ক্ষমতা আমার নাই। কন্যা যেমন ভয় পাচ্ছে তেমন আগ্রহ নিয়েই এই ব্যাতিক্রম দৃশ্য উপভোগও করছিলো। আমাদের সাথে থাকা কুকুরটাও ভয়ে লেজ নাড়া বন্ধ করে স্থির হয়ে গেল। যুগের যে পরিবর্তন হয়েছে তা স্পষ্ট দেখতে পেলাম, যে শিয়াল জীবনভর কুকুরের গন্ধে ভয়ে পালাতো এখন সেই শিয়ালের ভয়ে কুকুর এখন লেজ নাড়া পর্যন্ত বন্ধ করে ফেলে। হঠাৎ করে একটি শিয়াল দৌড়ে এসে দুই গ্রুপ শিয়ালের মাঝে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে ডাক দেয়ার সাথে সাথে গ্যাং ফাইট নিমিষেই থেমে গেল। শিয়ালদের একটা গ্রুপ মাঠের দক্ষিন দিকে চলে গেলো আরেকটা গ্রুপ মাঠের উত্তরদিকে তারাবনে ঢুকে গেলো। শিয়ালদের এই পুরো গল্প যখন আমার কাজিন সবুজ মিয়াকে বললাম, শুনে ভাইয়া বললো, এটা শিয়ালদের কিশোর গ্যাং ফাইট। দক্ষিনদিকে যাওয়া গুলো হলো ভূঁইয়া বাড়ি গ্রুপ আর তারাবনে ঢুকাগুলো হলো রাম্ঙল হাতর গ্রুপ। যাহোক এই ঘটনাটা দেখে যোগ্য নেতৃত্ব এবং চেইন অব কমান্ড কি জিনিষ সেটা পরিস্কার বোঝা গেল। শিয়ালের সমাজে যে নেতৃত্ব ও চেইন অব কমান্ড আছে সেটা এখন আর আমাদের মানব সমাজে নাই।
উঁচু পুল ঘুরে এসে আমাদের মসজিদের কাছে গেলাম। কন্যাকে মসজিদ অঙ্গন দেখাতে গিয়ে হঠাৎ চোখ গেল মসজিদের বারান্দায় শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে। ফ্লোরে শুয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে আমার বন্ধু নটিক্যাল মেরিন ইন্জিনিয়র আবুল কাসেম বাচ্চু। ক্লাস ওয়ান থেকে আমরা ফাইভ পর্যন্ত একসাথে পড়েছি। বাচ্চু ছিল অলওয়েজ ফার্ষ্ট বয়। একসময় বাচ্চু ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হলো। বাচ্চু দেখতে যেমন সুশ্রী ছিলো তেমনি ছিলো হ্যান্ডসাম এবং স্মাট। জিন্সের প্যান্ট, পলো শার্ট এবং কেডস পরতো সবসময়।মেরিন ইন্জিনিয়রিং পড়ার শেষে বাচ্চুর মাঝে এক আমুল পরিবর্তন চলে আসলো।অনেকেই তার এমন পরিবর্তনে বিস্মিত হলো।বাচ্চু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদের জামায়াতে পড়া শুরু করলো। জিন্স পলো শার্ট ছেড়ে জুব্বা পরা ধরলো। মাথায় শুধু টুপি নয় রীতিমতো পাগড়ি পরা নিয়মিত করে ফেললো। বিপরীত লিঙের কারো দিকে সে চোখ তুলে পর্যন্ত তাকায় না।তার এমন পরিবর্তনে অনেকে অনেকরকম কমেন্টস করতে থাকলো।অনেকে এমনও বলেছিলো, ‘আরে অনেকেই এরকম করে কিন্তু বেশিদিন টিকেনা। কয়দিন পরই আবার যে লাউ সেই কদু হয়ে যাবে’। কিন্তু নিন্দুকদের এমন ভবিষ্যতবানী অসত্য করে বন্ধু বাচ্চু তিনদশকের বেশি সময় ধরে আল্লাহর ধ্যানে দ্বীনের পথে আছে। চাকরির পাশাপাশি দ্বীনের দাওয়াতের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে। দ্বীনের দাওয়াতের কাজে সে পৃথিবীর অসংখ্য দেশে গিয়েছে। সমাজে জ্ঞানি উচ্চশিক্ষিত মানুষের অভাব নাই। কিন্তু বাচ্চুর মতো সত্যিকারের জ্ঞানি লোক কয়জন আছে? বাচ্চু এই দুনিয়ার স্কুলের পরীক্ষার জন্য যেভাবে ভালো পড়াশুনা করে প্রস্তুতি নিতো ঠিক যথাসময়েই পরকালের পরীক্ষার জন্যও সে পড়াশুনা শুরু করে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছে।আমি দোয়া করি বাচ্চু এই দুনিয়ার স্কুলের পরীক্ষায় যেমন ফার্ষ্ট হতো আখেরাতের পরীক্ষায়ও বাচ্চু যেন ফার্ষ্ট হয়। বাচ্চুর ঘুমের গভীরতা দেখে ওকে ডাকলাম না, হয়তো রাতে জেগে নামাজ পড়েছে, ফজর পড়ে ঘুমিয়েছে। দুর থেকে কন্যাকে দেখিয়ে বললাম, ঐ যে ঘুমিয়ে থাকা লোকটা দেখছো ওটা আমার ক্লাসমেট এবং বন্ধু। বাচ্চুকে দেখে আমাদের অনেককিছু শিখার থাকলেও আমাদের দিল সিল মারা থাকায় আমরা কিছুই শিখতে পারিনি। আল্লাহ আমাদেরকে হেদায়েত দান করুক।
মসজিদ প্রাঙ্গন পেরিয়ে দক্ষিণ দিকে যেতে যেতে কন্যাকে বললাম, জীবন সংগ্রামে বাস্তবতার কঠিন গ্যাড়াকলে পড়ে যদি আমার মরনকালে তুমি পাশে না থাকো বা আসতেও না পারো কোন সমস্যা নেই, তাতে তুমি মন খারাপ করোনা। যদি কখনো সুযোগ পাও সময় পাও ঠিক এখানে চলে আসবে। এটাই আমাদের পারিবারিক কবরস্থান। উত্তর পূর্বকোনে বড় উঁচু দেয়াল ঘেরা যে দুইটা কবর ঐখানে সস্ত্রীক শুয়ে আছেন আমাদের পরদাদা বাদশা মিয়া। তাদের পায়ের কাছে সস্ত্রীক শুয়ে আছেন বাদশা মিয়ার তিন ছেলে অথ্যাৎ আমাদের তিন দাদা যথাক্রমে ফজল মিয়া, বজু মিয়া এবং হাবু মিয়া। এর পাশেই আমাদের চাচা-চাচিরা। আমারও যেদিন সকল ব্যাস্ততার অবসান হবে, ক্লান্ত আমিও এসে বাপ-চাচাদের পায়ের কাছে কোথাও শুয়ে যাবো। তুমি পারলে আমাদের জন্য একটু দোয়া করে দিও।