:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
খোলাবাজারে ডলার সংকট বেড়েই চলেছে। দেশের খোলাবাজারের ইতিহাসে মার্কিন ডলারের দাম এত বাড়েনি কখনোই। আজ বুধবার সন্ধ্যায় প্রতি ডলারের দাম ১১৯ টাকায় উঠেছে। এর আগে গত ৮ আগস্ট খোলাবাজারে দর উঠেছিল ১১৫ টাকা।
খোলাবাজার থেকে যে কেউ ডলার কিনতে পারেন। ব্যাংক থেকে কিনতে পাসপোর্ট এনডোর্সমেন্ট করতে হয়। যে কারণে অনেকে এখন খোলাবাজার থেকে ডলার কিনে শেয়ারবাজারের মতো বিনিয়োগ করছেন, যা অবৈধ।
বুধবার মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকার খোলা বাজারে দেখা যায়, নগদ ডলার কেনার জন্য গ্রাহককে ১১৮ থেকে ১১৯ টাকা গুণতে হচ্ছে। অন্যদিকে, খোলাবাজারে বিক্রির ক্ষেত্রে সাধারণ গ্রাহক প্রতি ডলারের বিনিময়ে পাচ্ছেন ১১৫ থেকে ১১৬ টাকা।
এছাড়া, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতেও ১০৮ থেকে ১১০ টাকার ওপরে নগদে ডলার বিক্রি হচ্ছে।
বর্তমানে ঢাকার মতিঝিলসহ দেশের অধিকাংশ মানি এক্সচেঞ্জেই নগদ ডলারের সংকট রয়েছে। এ কারণে মানুষ বিক্রির চেয়ে ডলার কেনার দিকে বেশি আগ্রহী।
সোমবার আন্তঃব্যাংকে ডলারের দর ৯৪ টাকা ৯৫ পয়সা স্থির করা হয়। সরকারি আমদানি বিল মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক এই হারে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করে থাকে।
রাজধানীর দিলকুশা, মতিঝিল, পল্টন, গুলশান এলাকায় মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনের কারণে যারা অবৈধভাবে ডলার বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের সংখ্যা কমে গেছে। তাছাড়া অনেকের কাছে ডলার থাকলেও ভয়ে খোলাবাজারে বিক্রি করতে আসছে না। অপরদিকে, ডলারের সংকট তো রয়েছে। অনেক মানি এক্সচেঞ্জ হাউজে চাহিদা অনুযায়ী ডলার নেই। আর এসব কারণে ডলারের দাম বেড়েই চলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি মানি এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আজ ডলারের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নেই। তাই সকাল থেকে দাম ঊর্ধ্বমুখী ছিল। সকালে ১১৭ টাকায় বিক্রি করলেও দুপুরে ১১৯-এ বিক্রি হয়েছে। তবে দুপুরের পর ১১৯.৯০ টাকায় ডলার বিক্রি হয়েছে। শেষ পর্যায়ে ১২০ টাকা অতিক্রম করার আশঙ্কা করছেন তিনি।
এদিকে, ডলার সংকট নিরসনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে ডলার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন টিমও কাজ করছে। ডলারের সংকট ও কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকায় ৬ ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের অপসারণ, ৫টি মানি এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স স্থগিত এবং ৪৫টি মানি এক্সচেঞ্জ হাউজকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যাতে কেউ কৃত্রিমভাবে ডলার সংকট না করতে পারে সেজন্য ডিজিটাল প্লাটফর্মেও নজরদারি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ডলারের দাম পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার কেনাবেচা হয়েছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা। যা ৯ জানুয়ারি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ টাকা। গত ২৩ মার্চ তা বেড়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় বেচাকেনা হয়। গত ২৭ এপ্রিল ডলার প্রতি ২৫ পয়সা বেড়ে ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সায় বেচাকেনা হয়েছে। গত ১০ মে ডলার প্রতি আরও ২৫ পয়সা বেড়ে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সায় বেচাকেনা হয়েছে। গত ১৬ মে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার কেনাবেচা ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এরপর ২৩ মে ফের ৪০ পয়সা বাড়িয়ে দাম ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা নির্ধারণ করে। এরপরও বাজার স্থিতিশীল হয়নি।
পরে সংকট নিরসনে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস, বাংলাদেশের (এবিবি) দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৯ মে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ৮৯ টাকা বেঁধে দেয়। আর আমদানিকারকদের কাছে বিক্রির জন্য বিসি সেলিং রেট নির্ধারণ করা হয় ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা। যদিও ব্যাংকগুলো আন্তঃব্যাংক লেনদেনে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৯ টাকা ৮০ পয়সার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু তাতেও বাজার স্থিতিশীল না হওয়ায় ডলারের একরেট উঠিয়ে দিয়ে গত ২ জুন আরও ৯০ পয়সা বাড়িয়ে দাম ৮৯ টাকা ৯০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। গত ৬ জুন প্রতি ডলার ৯১ টাকা ৫০ পয়সা। গত ৭ জুন ডলার ৯১.৯৫ টাকা, ৮ জুন ৯২ টাকা এবং গত ১৩ জুন ডলারের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৯২.৫০ টাকা। গত ১৫ জুন ডলার দাম ছিল ৯২.৮০ টাকা। গত ২১ জুন দাম বেড়ে ৯২.৯০ টাকা, পরেরদিন তা বেড়ে ৯২.৯৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। গত ২৮ জুন ডলারের দাম বেড়ে ৯৩.৪৫ টাকা, ২৯ জুন ৯৩.৪৪ টাকা, ৩০ জুন ৯৩.৪৫ টাকা, ১৪ জুলাই ৯৩.৬১ টাকা, ১৭ জুলাই ৯৩.৯৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। গত ২১ জুলাই ডলারের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪.৪৫ টাকা। গত সোমবার আন্তঃব্যাংকে ডলার লেনদেন হয়েছে ৯৪.৭০ টাকায়। যা ডলারের দামের সর্বোচ্চ রেকর্ড।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরজুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর বাড়তে থাকে আমদানি ব্যয়। রপ্তানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়; বাড়তে থাকে দাম।
বাজার ‘স্থিতিশীল’ করতে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় নতুন অর্থবছরেও বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১১৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিক ডলার বিক্রির কারণে ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যাংকগুলোতে এখন আমদানির জন্য ১০০ টাকার নিচে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০৭ থেকে ১০৯ টাকায় ডলার কিনে আমদানি দায় মেটাতে হচ্ছে। রেমিট্যান্সের জন্যও ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা দরে ডলার কিনতে হচ্ছে।
এদিকে ডলারের কারসাজি রোধে খোলা বাজার ও এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোতে ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে এ পরিদর্শন কার্যক্রম চালানো হয়।
গত সপ্তাহ পর্যন্ত কারসাজির অপরাধে পাঁচ মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি ৪২টিকে শোকজ করা হয়েছে। এছাড়া লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করায় ৯টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলা হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলামের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি গ্রাহকদের ডলারের পরিবর্তে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, বর্তমানে যেহেতু ক্যাশ ডলারের সংকট রয়েছে, তাই এসময় স্টুডেন্ট ভিসায় বা চিকিৎসার কাজে যারা বাইরে যাচ্ছেন তারা যদি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে তাহলে তাদের কাজটাও সহজ হবে এবং তারা বেশি লাভবান হবেন। এই বিষয়ে গ্রাহকদেরই ব্যাংকের পাশাপাশি গ্রাহকদেরও উদ্যোগী হতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।