:: সোমা দেব ::
আমার বান্ধবীরা যখন মোটামুটি সেটেলড অবস্থায় পৌঁছে গেছে তখন আমার প্রথম একটা বিয়ের প্রস্তাব এলো। পাত্রের বয়স একটু বেশি কিন্তু ভাল অবস্থানে আছে। আমি দেখতে-শুনতে খারাপ তো নয়ই, বরং বেশ ভালো, স্বাস্থ্য স্লিম, ফর্সা। সাধারণ লোকের কাছে সুন্দরীর সংজ্ঞা যেমন ঠিক তেমন আমি।
স্বভাবে-বলনে-চলনে কেউ কখনো আমাকে খারাপ বলতে পারেনি। তবুও কেন এই আটত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত রয়েছি, সেটা নিয়ে মানুষের জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। রাস্তা-ঘাটে, অনুষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে সব জায়গায় বিয়ে নিয়ে কথা শুনতে শুনতে আমি রীতিমতো মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছি। অবস্থা এমন যে, এক পর্যায়ে আমি সামাজিক সব অনুষ্ঠান এড়িয়ে যেতে লাগলাম।
কিছুদিন আগে এক বান্ধবীর মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে এক অপরিচিতা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-‘ ভাবী আপনার বাচ্চা নিয়ে আসেননি?’
মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে বললাম,
-‘আমার বাচ্চা তো নেই ভাবী।’
আমার কথা শুনে উনি যেনো খুব মর্মাহত হলেন। বললেন,
-‘কেনো, নেই কেনো? হয় না? এখন তো নানারকম চিকিৎসা আছে। আমার পরিচিত এক ডাক্তার আছে…’
উনাকে থামিয়ে আমি বললাম,
-‘আমি বিয়ে করিনি।’
ভদ্রমহিলা এতক্ষণে আঁতকে উঠেছেন। ভ্রু কুঁচকে আমাকে কিছুক্ষণ দেখলেন তারপর বললেন,
-‘বিয়ে করেননি মানে? বিয়ে হয়নি এখনও? হায় কপাল! আর কবে করবেন বিয়ে?’
বলে মিটিমিটি হাসতে থাকলেন। আমি বিব্রত হলাম অথবা অস্বস্তিতে পড়লাম সেগুলো তাঁর দেখার বিষয় নয়৷ উনি বেশ ঠোঁটকাটা বুঝে আমি সেখান থেকে উঠে চলে গিয়েছিলাম।
আমি মাঝে মাঝে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বান্ধবীদের ছবি দেখি৷ কারও ছেলেমেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেবে, কারও ছেলেমেয়ে এইট বা নাইনে পড়ে, কেউ নিয়মিত বর নিয়ে ঘুরছে, কেউ গাড়ি-বাড়ি করে ফেলেছে, দামী শাড়ি গয়নায় মুড়িয়ে বিভিন্ন পার্টি করছে। আমি তখনও পরবর্তী জীবনের প্ল্যান করছি।
ওদের ছবি দেখে মাঝে মাঝেই ভাবি এই জীবনটাই কি তবে সুখের ছিলো? না, আমার মধ্যে কোনো হতাশা বা হা-হুতাশ ভর করেনি। বরং আমি বেশ আত্মবিশ্বাসী। তবে চারপাশের মানুষের কাছে যেনো আমার আত্মবিশ্বাসটাই দূর্বোধ্য লাগতো।
চারপাশের মানুষ কেনো শুধু, আমাকে আমার কিছু বান্ধবীরাও কম কথা শোনায় না। কোন গেট টুগেদারে গেলেই ‘কী রে , আর কবে বিয়ে করবি? আমরা তো তোর চেয়ে এগিয়ে গেলাম, আমাদের মেয়ে তো বড় হয়ে গেলো রে। তোর আর আমাদের মেয়ে একসাথেই বিয়ে দিতে হবে’।
এসব বলে অনেকের মাঝেই হাসির রোল পড়ে যেতো। সবাই যে এমন করতো তা কিন্তু নয়। কেউ এসে ‘মন খারাপ করিস না’ বলেও সান্ত্বনা দিতো।
আবার ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও মন খারাপ করার মতো নয়। আমাকে নিজের মতো করে চলতে দেখে, আমার অবস্থান দেখেও কারও কারও ভালো লাগতো না।
আমার অন্য বান্ধবীরা যখন বাসা থেকে ঠিক করা বিয়েতে জমকালো আয়োজনে ব্যস্ত আমি তখন জীবনপ্রাণ উজাড় করে ভালো রেজাল্ট করার প্রত্যয়ে পড়াশোনা করছি। আমার ক্লাসমেটরা যখন উথাল-পাতাল প্রেম করছে আমি তখন বিকাল-সন্ধ্যে টিউশনি করিয়ে সময় পার করছি। আমার বান্ধবীরা যখন হানিমুন করছে, সন্তান নেওয়ার প্ল্যান করছে তখন আমি সাবলেটে থেকে চাকরির পড়া আর পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত।
ছাত্রজীবনে টিউশনির টাকা থেকে আমি নিজের প্রয়োজনে খরচ করতাম আর বাকি টাকা ছোট দুই ভাই-বোনের পড়াশোনার কিছুটা খরচ করেছি।
আমাকে যে কেউ প্রেমের প্রস্তাব দেয়নি এমন নয়, তবে প্রেমের পেছনে সময় দেওয়ার মতো সময় বা টাকা খরচ করার মতো বিলাসিতা আমার ছিলো না। তাই নিজেকে এসব ব্যাপারে দমিয়ে রেখেছি দিনের পর দিন। তবে অন্যদের দেখে একটু ঈর্ষা হতো হয়তো আমার।
একবার আমরা শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় এক বান্ধবীর বিয়েতে গেলাম। বান্ধবীর ঢাকাতেই বিয়ে হচ্ছে, অফিসার্স ক্লাবে বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। আমরা তখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমরা তিন বান্ধবী বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম।
ওখানে গিয়ে তো আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিলো। সাব-জজের সাথে বিয়ে হচ্ছে আমাদের ক্লাসমেট বান্ধবী যুথিকার। কী এলাহী কান্ড! আর যুথিকাকে একদম চেনাই যাচ্ছিলো না। বিয়ের সাজে, গয়নায়, ঝলমলে শাড়িতে কী যে অপূর্ব, একদম পরীর মতো লাগছিলো ওকে। কত দামী শাড়ি-গয়না পরে বিয়ের আসরে বসে ছিলো যুথিকা। অবশ্য যুথিকা এমনিতেই অনেক সুন্দরী। তখন মনে হয়েছিলো, ইস, এরকম জমকালোভাবে যদি আমার বিয়ে হতো! বিয়ের পর ওরা হানিমুনে গিয়েছিলো সিঙ্গাপুর। ক্লাসের বাইরে আড্ডা দেওয়ার সময় যুথিকা শুধু ওর বর আর বিয়ের, বেড়ানোর, শ্বশুরবাড়ির নানা সুখের গল্প করতো।
অনেক বছর পর কিছুদিন আগে যুথিকার সাথে একটা শপিং মলে দেখা হয়েছিলো আমার। প্রথমে আমি যুথিকাকে একদম চিনতেই পারিনি। কী বিশাল দেহ বানিয়েছে যুথি! ওজনের জন্য নড়তেই পারছে না, কড়া মেকাপ নিয়েছে কিন্তু আগের মতো মুখে আর নিষ্পাপ ভাবটা নেই। আমি কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতেই বললো,
-‘ ঊনিশ বছর ধরে সংসার করছি, আর কী থাকবে বল! তিন ছেলেমেয়ে সামলাতে গিয়ে এই অবস্থা! বড় তো মেয়ে কলেজে পড়ে।’
আমি বললাম,
-‘তুই কোথাও আছিস মানে জব করছিস?’
যুথিকা বললো,
-‘বাচ্চা-কাচ্চা আর সংসার সামলাতে গিয়ে চাকরিতে ঢুকতে পারিনি রে। আর আমার বর তো মেয়েদের চাকরি করা একদম পছন্দ করে না।’
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ও জিজ্ঞাসা করলো,
-‘ কী রে, তোর কী খবর! এখনও এত স্লিম আছিস, ছেলেমেয়ে কয়টা?’
আমি যখন বিয়ে করিনি বললাম তখন যুথিকাও চোখ কপালে তুলে হায়হায় করে উঠলো। বললো,
-‘ কী বলছিস? সত্যি?’
তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-‘ কোন প্রবলেম-ট্রবলেম নেই তো! মানে শারীরিক কোন সমস্যা?’
আমি উত্তর দিলাম না। ও বলতেই থাকলো,
-‘আর ক’দিন অপেক্ষা কর, আমার মেয়ের আর তোর, একসাথেই বিয়ে দিয়ে দেবো।’
বলে একাই হাসলো, তারপর ফোন নম্বর নিয়ে চলে গেলো।
আমি একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উর্ধ্বতন অবস্থানে আছি। বেশিরভাগ সময়েই দেশের বাইরে কনফারেন্স, ট্যুর, ওয়ার্কশপ থাকে আমার। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই নিজেকে যোগ্য অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রাণপণ লড়াই করেছিলাম। সাথে ছোট দুই ভাই-বোনকেও সেরা অবস্থানে পৌঁছানোর পণ করেছিলাম।
এখন ছোট ভাই স্কলারশিপ নিয়ে জার্মানিতে পিএইচডি করছে আর ছোট বোন উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা। ওরা নিজেদের এবং পরিবারের পছন্দানুযায়ী বিয়ে করেছে।
আমি কিন্তু প্রথমেই এত বড় পজিশনের চাকরি পাইনি। একেবারে তিল থেকে শুরু করতে হয়েছে আমাকে। আস্তে আস্তে নিজের যোগ্যতা এবং মেধা কাজে লাগিয়ে আজকে আমি অনিন্দিতা এখনকার অবস্থানে পৌঁছেছি। তাই আগেভাগে বিয়ে করা আমার জন্য খুব সহজ ছিলো না।
আমি সবসময়ই নিজে গুছিয়ে নিতে চেয়েছি, নিজে ব্যাংকে বেশ কিছু টাকা জমিয়েছি তিলতিল করে৷ আমি কখনই চাইনি আমার বিয়ের জন্য আমার মুদি দোকানী বাবা অন্য কারও কাছে হাত পাতুক। সেই সময়টুকুতে অসংখ্য লোকের কথা, টিটকিরি, খোঁচা হজম করতে হয়েছে আমাকে। কারণ কারও কাছে আমি আমার বিয়ে না করার ‘কারণ’ ব্যাখ্যা করতে যাইনি। আমার বাবা যখন আমাদের পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খেতেন, ছোট্ট দোকানের আয়ে একবেলা খেয়েও পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছি তখন এই টিটকিরি দেওয়া কোনো মানুষকে এসে সাহায্য তো দূরে থাক, সান্ত্বনাও দিতেও আসতে দেখিনি।
আমার কোনো বান্ধবীকেও কখনও ভালো ছেলের সাথের আমার বিয়ের সম্বন্ধ করিয়ে দিতে দেখিনি। সবাই আড়ালে-আবডালে মুচকি হেসে, কেউ কেউ সামনে দু’চারটা কথা শুনিয়ে চলে গিয়েছে।
আমার কোনো বান্ধবীর বর এসপি, কারো বর ইউএনও, কারো বরের কোটি টাকার ব্যবসা, কারো বর প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। সবাই যার যার মতো করে সুখী আছে। তবুও আমার বর নেই শুনে সবাই কেমন যেনো মুখভঙ্গি করে তাকায়। এমন ভাব যেনো আমার নিশ্চয়ই কোনো দোষ বা খুঁত আছে, নাহলে বিয়ে হয় না কেনো?
আমি অবশ্য কাউকেই কিছু বোঝাতে বা ভুল ভাঙ্গাতে যাই না। জানি, আমি ভুল ভাঙ্গাতে গেলেই এরা তত বেশি আমাকে সন্দেহ করবে। কিন্তু আমার যে নিজে প্রতিষ্ঠিত হতে গিয়ে, ভাই বোনকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে সর্বোপরি বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে, বাবার দোকানটা বড় করতে গিয়ে অনেকটা সময় চলে গিয়েছে এটা কেউ বুঝতে চাইবে না।
লোকের কথা যে শোনার দরকার নেই সেটা আমিও জানি, বুঝি। কিন্তু বিষয়টা এমন প্রকাশ্যে সবার আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় মাঝে মাঝে যে, আমি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যেতে লাগলাম। বিশেষ করে আমাদের কিছু আত্মীয়-স্বজন সবকিছু জেনেও এমন করুণা নিয়ে তাকায়, কথা বলে যে সত্যি আমার সহ্য করার উপায় থাকে না। অথচ আমি যে এত বড় পদে কর্মরত, এত দায়িত্ব পালন করছি, আমার যোগ্যতা নিয়ে, মেধা নিয়ে তাদের ভালো কোনো কথা কখনও শুনিনি।
আমার এক দূর সম্পর্কের মামা আমার ছোট ভাইয়ের বিয়ের দিন আমার বোনকে বলছিলেন,
-‘অনিন্দিতাকে দেখলে খারাপ লাগে। বেচারি জীবনটা উৎসর্গ করে দিলো সংসারের পেছনে। অথচ নিজের কোনো গতি করতে পারলো না। এই বয়সে ওকে আর কে বিয়ে করবে বল?’
সেদিন দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো হজম করেছিলাম।
সবার নানা ধরনের কটু কথায় মনে হতো বিয়েই বুঝি জীবনের সব, জীবনের গতি। আমার মা আত্মীয়দের কথা শুনে ওদেরকেই আমার বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজে দিতে বলতেন। তখন তারাই মুখ বেঁকিয়ে বলতে থাকতো,
-‘ কী যে বলো মামী, অনিন্দিতার যা বয়স হয়েছে ওর জন্য পাত্র কোথায় পাবো? সবাই বিয়ের জন্য কম বয়সী মেয়ে চায়। অত বেশি বয়সের মেয়েকে বাড়ির বউ বানাতে চায় না কেউ।’
আমার ছোটবোন বলেছিলো,
– ‘কেনো, বেশি বয়সী মেয়েকে বউ বানালে কী হয়?’
তখন তারাই বলেছিলো,
-‘ তোর অত বুঝে কাজ নেই। আর কম বয়সী মেয়েদের গড়ে-পিটে নেওয়া যায়। বয়স বেশি মেয়েরা কি আর শ্বশুরবাড়ির কথা শুনে বশে থাকতে চায়?’
এসব কথার কারণে আমি একসময় বাড়ি যাওয়াই বন্ধ করে দিলাম। ফোনেও কারো সাথে কথা বলতাম না। আমি এত কষ্ট করে বড় হয়েছি অন্যের করুণা পাওয়ার জন্য নয়। শুধু যদি ঢাকায় থাকতাম তাহলে হয়তো বিষয়টি এতটা সিরিয়াস হতো না। কিন্তু যেহেতু আমরা ছোট্ট মফস্বল শহরে থাকি সেখানে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন নানাভাবে আমার মা-বাবাকে নানা কথা শোনাতো৷ একটা পর্যায়ে যেনো আমি নিজের সাথে যুদ্ধ করতে লাগলাম। বিয়ে করতে আমার আপত্তি ছিলো না, যদি সে অবশ্যই ভালো মানসিকতার মানুষ হয়, আমার অপারগতা, আমার বিশ্বাস, আমার লড়াইকে সম্মান করে।
আমার আটত্রিশ বছর বয়সে যে বিয়ের প্রস্তাব এলো সেই পাত্র দেখতে যেতে আমি প্রথমে রাজি হইনি। কারণ আমি জানি, আমাকে দেখে পরে বয়স বেশি বলে নাকচ করে দেবে। কী দরকার জেনেশুনে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার!
আমি নিজেই ঠিক করে নিয়েছি, আমি বিয়ে করবো না। আমি নিজের কাজ নিয়ে আমি খুব খুশি আছি। তাছাড়া আমার স্বামী, শ্বশুরবাড়ির সাথে তো বাবা-মাকে সাহায্য করার ব্যাপারে মতানৈক্য হতেই পারে। এরকম নানা বিষয় চিন্তা করে বিয়ে করবো না বলে পিছিয়েই ছিলাম। কিন্তু আমার ছোট ভাইবোন এমন করে বোঝালো, অনেকটা ওদের কথায় রাজি হয়েই পাত্র দেখতে গেলাম।
আমাকে অবাক করে দিয়ে যার সাথে আমার বিয়ের কথা হচ্ছিলো তিনি রাজি হয়ে গেলেন। আর আমার মতামত জানতে চাইলেন তিনি ও তাঁর পরিবার। আমার বাড়ির অনুরোধে আমি আর না করলাম না। অবশ্য আমার এখন কাউকে খারাপ লাগা, ভালো লাগার অনুভূতিগুলো চাপা পড়ে গেছে। বিয়ের দিন আমি তাঁকে ভালো করে দেখলাম। বয়স একটু বেশি আমার চেয়ে কিন্তু খুব একটা বোঝা যায় না। আমার বান্ধবীরাও এসেছে বিয়েতে। বিয়েতে এসেও ওরা বলাবলি করছিলো,
-‘ আমরা তো ভেবেছিলাম, অনিন্দিতার আর বিয়েই হবে না। দেখ, কেমন হ্যান্ডসাম পাত্র জুটিয়ে নিলো!’
-‘অনিন্দিতার ফ্যামিলি তো এরকম স্ট্যান্ডার্ড না। তবুও দেখলি, প্রাক্তন সচিবের ছেলের সাথে বিয়ে হচ্ছে! ছেলে নাকি আবার একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর! কীভাবে হলো রে এত কিছু!’
কেউ আবার বললো,
-‘ কেনো অনিন্দিতা কি কিছু কম নাকি!’
আমি বিয়ের আসরে বসেই এসব শুনে মিটিমিটি হাসছিলাম। কিছু কিছু মানুষের কথা বোধহয় কোনোদিনও শেষ হবে না। মন্দ থাকলেও কথা বলবে আবার ভাল থাকলেও কথা বলবে।
আমি সত্যি একটা ভালো জীবনসঙ্গী পেয়েছি, যে আমার কষ্ট করে বড় হওয়াকে খুব সম্মান করে। আমার বাবা মুদি দোকানী ছিলো বলে তাঁকে অসম্মান তো করেইনি বরং অনেক বেশিই সম্মান করে। বিয়ের পর আমার শাশুড়ি আমাকে বলেছেন,
-‘ আমরা তোমার যোগ্যতা দেখে তোমাকে পছন্দ করেছি। আমার ছেলে তোমাকে সম্মান করছে। আর তোমার মতো গুণী মেয়েকে যারা জন্ম দিয়েছেন তারা তো অবশ্যই সম্মানের পাত্র।’
আমি সত্যি সারাজীবন নিজের পড়াশোনা, চাকরি, নিজের কাজ, পরিবার, ভাইবোন, আত্মীয়, চারপাশের মানুষ সবার প্রতি খুব সৎ ছিলাম। আমার হাত দিয়ে এ যাবৎ কারো কোনদিন ক্ষতি হয়নি। হয়তো এই সততার পুরস্কার আমি পাচ্ছি এখন। আমার এখন খুব মনে হয়, চারপাশে যারা আছে তাদের অনেকেই নানা কথা বলেছে, সেগুলোকে পাত্তা দেওয়া আমার একদমই উচিত হয়নি। তাদের কথায় মন খারাপ করাও আমার উচিত হয়নি। কারণ আমার এই সুখের জীবন নিয়েও তাদের কথার শেষ নেই।
আর সময় হলেই সব হবে, কারো আগে, কারো পরে। শুধু সময়ের অপেক্ষা, সবার জীবনের গল্প তো আর এক নয়৷
বিয়ের দুই বছর পর আমার ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে। একদিন মেয়েকে নিয়ে একটি শপিং মলে গিয়েছি, মেয়ের বয়স তখন সাড়ে তিন বছর। সেখানে এক কলেজ জীবনের বান্ধবীর সাথে দেখা। আমাকে দেখেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরলো। নানা কথার পরে ওর একটাই প্রশ্ন,
-‘ বিয়ে করে তো না হয় বাচ্চা হয়েছে তো কিন্তু এই বাচ্চা কবে মানুষ করবি? আমাদের ছেলেমেয়েরা তো ইউনিভার্সিটিতে পড়ে!’
আমি ওর কথা শুনে আর আগের মতো মন খারাপ করলাম না বরং হো হো করে হেসে দিলাম। তারপর বললাম,
-‘অন্যের পেছনে দেওয়ার মতো, অন্যের সমস্যা নিয়ে নিজে অস্থির হওয়ার মতো সময় আমার নেই রে। সেই সময়টুকুতে আমি ঠিক মানুষ করে ফেলবো মেয়েকে’
বলে আস্তে করে সরে এলাম ওর কাছ থেকে।