:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে সাত লাখের বেশি শিশু ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আর এই সময়ে নিহত হয়েছে ৪ হাজার ৬৩০ শিশু।
দ্রুত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে ইউনিসেফ বলেছে, এ অঞ্চলে মানবিক সহায়তার চাহিদা বেড়ে গেছে। তাদের টেকসই ও নির্বিঘ্ন সহায়তার জন্য দরকার যুদ্ধরিবরতির। সেই সঙ্গে যেসব শিশুকে জিম্মি করা হয়েছে, তাদের নিরাপদে মুক্তি দাবি করেছে ইউনিসেফ।
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ২৪০ জনে। নিহতদের মধ্যে শিশুই ৪ হাজার ৬৩০ জন এবং নারী ৩ হাজার ১৩০ জন। আহত হয়েছে আরও অন্তত ২৯ হাজার ৫০০ জন।
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েলের বোমা হামলায় অব্যাহত রয়েছে।
নিহতদের মধ্যে ১১ হাজার ২০৫ জন গাজার এবং পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে মারা গেছে আরও ১৮৩ জন। এ ছাড়া গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় আহত হয়েছে আরও অন্তত ২৭ হাজার এবং পশ্চিম তীরে আহতের সংখ্যা আড়াই হাজারের অধিক।
এদিকে, ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলনকে (হামাস) ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রামের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জর্ডানের সাবেক তথ্যমন্ত্রী তাহের আল-আদওয়ান। এক্সে শেয়ার করা এক পোস্টে আরব লিগের প্রতি এ আহ্বান জানান তিনি।
আল-আদওয়ান পোস্টে বলেন, গাজা ও ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি নিয়ে যদি আসন্ন আরব লিগ শীর্ষ সম্মেলনে এবং সমগ্র পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তবে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং তাঁদের ‘অশুভ’ জোট আল-কাসাম ব্রিগেডকে (হামাসের সশস্ত্র বাহিনী) যে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়েছে, তা আরবদের অস্বীকার করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সম্মেলনে অবশ্যই হামাস গোষ্ঠীকে প্রতিরোধ আন্দোলনের দল এবং ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
পোস্টে আল-আদওয়ান আরও বলেন, ‘গাজার প্রতিরোধযুদ্ধকে স্বীকৃতি ও সমর্থন দিন, ইসরায়েলি দখলদারির অধীনে নিপীড়িত ভাতৃসম আরব ফিলিস্তিনি জনগণের এটি প্রাপ্য। যদি ইরান বা অন্য কোনো দেশ, যাদের আরব দেশগুলোর ওপর খবরদারি করার উচ্চাভিলাষ রয়েছে, তাদের (হামাস) সঙ্গে সমন্বয় করে থাকে, তাহলে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনুন।’
ইসরায়েলি কর্মকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা ছড়িয়েছে জার্মানিতে। দেশটিতে রাস্তাঘাটে রীতিমতো মুখ লুকিয়ে বা পরিচয় গোপন করে হাঁটতে হচ্ছে তাদের। চলমান ইসরায়েল ও হামাস সংঘাত জার্মানিতে সামাজিক বিভেদ ঘটিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর ভয়ে ইহুদিরা যেমন পালিয়ে বেড়িয়েছে তেমনি এখনো অনেকে মুখ লুকিয়ে আছে। ইহুদি পুরুষরা তাদের ঐতিহ্যবাহী জিনিসপত্র জনসমক্ষে আনছেন না। গত ১৮ অক্টোবর জার্মানির রাজধানী বার্লিনে ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের একটি সিনাগগে (ধর্মীয় উপাসনালয়) পেট্রোল বোমা ছোড়ার ঘটনাও ঘটেছে।
গাজায় প্রতি দশ মিনিটে প্রাণ হারাচ্ছে একটি শিশু
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান ড. তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস বলেছেন যে, গাজার অর্ধেক হাসপাতালই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ফিলিস্তিনি উপত্যকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চূড়ান্ত সীমায় রয়েছে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে তিনি বলেন, ‘গাজার ৩৬টি হাসপাতাল এবং এর দুই-তৃতীয়াংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অর্ধেকই কাজ করছে না। যেগুলো কাজ করছে তারা তাদের সামর্থ্যের বাইরে কাজ করছে।’
তিনি বলেন, ‘গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চূড়ান্ত সীমায় রয়েছে। তবুও কোনো না কোনো ভাবে জীবন রক্ষার জন্য লড়াই অব্যাহত রয়েছে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বলেন, ‘সেখানকার স্বাস্থ্যকর্মীদের এখন ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং জ্বালানির প্রচণ্ড প্রয়োজন। সেখানে প্রতি দশ মিনিটে একটি শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। প্রায় ১৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তবে সেখানে কোথাও এবং কেউ নিরাপদ নয়।’
ডব্লিউএইচও প্রধানের মতে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চারটি হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে জ্বালানির অভাবে। হাসপাতালগুলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে ৪৩০ শয্যা ছিল। তবে এর চেয়েও অনেক বেশি রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। ইসরায়েলের হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত শতাধিক জাতিসংঘের কর্মী নিহত হয়েছেন।
সম্প্রতি জাতিসংঘ বলেছে যে, গাজা শিশুদের কবরস্থান হয়ে উঠছে। এটি একটি যুদ্ধবিরতির দাবিকে বাড়িয়ে তুলছে। এর আগে জাতিসংঘের সংস্থার প্রধানরা গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য বিরল যৌথ আবেদন করেছেন। জাতিসংঘের ১৮টি সংস্থার নেতারা ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। সেখানে ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলায় মৃতের সংখ্যায় হতবাক হয়েছেন তারা। এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংস্থাগুলোর প্রধানরা।
গাজায় ইসরায়েলের অবিরাম হামলার মধ্যে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডটির সর্ববৃহৎ হাসপাতাল আল-শিফা হাসপাতাল এখন প্রায় কবরস্থানে পরিণত হয়েছে বলে হুঁশিয়ার করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। এমনকি হাসপাতালে মৃতদের দাফন করতে পারছে না বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।
ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলা ও জ্বালানিসংকটের কারণে ফিলিস্তিনের গাজার উত্তরাঞ্চলের সব হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। জ্বালানিসংকটে জেনারেটর বন্ধ থাকায় সেখানকার সবচেয়ে বড় হাসপাতালের ৩৪ রোগীর মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে সাত নবজাতকও রয়েছে।
এদিকে, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এবং যোগাযোগের ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় গাজায় হতাহতের হালনাগাদ তথ্য দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর সেখানকার ১১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এর ৪০ শতাংশই শিশু।
জাবালিয়া ক্যাম্পে ইসরায়েলি বোমা হামলা
উত্তর গাজার জাবালিয়া রিফিউজি ক্যাম্পে ইসরায়েলি বিমান হামলায় অন্তত ৩০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। স্থানীয় সময় সোমবার এ হামলায় আহত হয়েছেন আরও অনেকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাবালিয়া রিফিউজি ক্যাম্পের ১২টি বাড়ি লক্ষ্য করে এ বিমান হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী।
এর আগে ১৯ অক্টোবরও জাবালিয়া ক্যাম্পে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। সেসময় অন্তত ১৮ ফিলিস্তিনি নিহত হয়।
এদিকে গত কয়েক দিন ধরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর স্থল হামলা জোরদার হওয়ার পর থেকে গাজার উত্তরাঞ্চলে সংঘাতের তীব্রতা বেড়েছে।
সংঘাতের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি উত্তর গাজার শহর গাজা সিটির হাসপাতালগুলোর আশেপাশে। ইসরায়েলি বাহিনীর দাবি, এই হাসপাতালগুলোর নিচে হামাসের টানেলের নেটওয়ার্ক রয়েছে এবং এসব হাসপাতালকে কেন্দ্র করেই তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধে নিহত ৪২ সাংবাদিক
৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলের হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত ৪২ জন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী নিহত হয়েছে। সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। গত তিন দশক ধরে কাজ করা এই সংগঠনটি বলছে, এত কম সময়ে এত বেশি সাংবাদিক মৃত্যুর নজির আর নেই।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই যুদ্ধে ১২ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। গাজা ও পশ্চিম তীরে ১১ হাজার ৭০ জন এবং ইসরায়েলে ১২০০ নাগরিক নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪২ জন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীর মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ৩৭ জন ফিলিস্তিনি, চারজন ইসরায়েলি, একজন লেবাননের নাগরিক। এই যুদ্ধে আরও ৯ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন, নিখোঁজ রয়েছেন তিনজন। আর ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সংগঠনটি জানিয়েছে, যুদ্ধের খবর সংগ্রহে নিয়োজিত সাংবাদিকরা নানা ধরনের হামলা ও হুমকি ও বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। কারও কারও পরিবারের সদস্যরাও নিহত হয়েছেন।
গাজা শহরের সাংবাদিকরা বর্তমানে খুবই ঝুঁকির সম্মুখীন। কারণ তারা গাজা সিটিতে ইসরায়েলের স্থল ও বিমান হামলা, বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ব্যাপক বিদ্যুৎ বিভ্রাটের মুখে সংঘাতের সংবাদ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।