:: চট্টগ্রাম প্রতিনিধি ::
টানা চারদিনের বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় পানিবন্দি নগরবাসীর পাশাপাশি চট্টগ্রামের ১৫টি উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষও পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
উপজেলাগুলোর মধ্যে দক্ষিণের সাতকানিয়া, বাঁশখালী, পটিয়া ও আনোয়ারা এবং উত্তরের রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, সীতাকুণ্ড, মীরসরাই, হাটহাজারী ও ফটিকছড়ির পানিতে তলিয়ে যাওয়া এলাকার পরিমাণ বেশি।
পানিতে ডুবে গিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আঞ্চলিক মহাসড়কে। সড়কের বিভিন্ন স্থানে আটকা পড়ে শত শত যানবাহন। শুধু এই সড়কের চন্দনাইশ উপজেলা অংশে কম-বেশি তিন কিলোমিটারে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। পানি ঢুকে সড়কে বিকল হয়ে পড়ে অনেক যানবাহন। সড়ক ডুবে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে পার্বত্য জেলা বান্দরবানও। এছাড়া বিভিন্ন এলাকার আরও অনেক সড়কে পানি উঠে যাওয়ায় সেসব সড়কেও যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
এদিকে বন্যার পানিতে চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী, চন্দনাইশ ও সাতকানিয়াসহ প্রায় সব উপজেলায় কম-বেশি বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এসব উপজেলার হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। শত শত বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়ায় মানুষজন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকটও। সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলায়। ফলে এই দুটি উপজেলায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্যদের মাঠে নামানো হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।
জেলা প্রশাসক বলেন, ‘টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম নগরীতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির পাশাপাশি সব উপজেলায়ও কম-বেশি বন্যা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলা। সাতকানিয়ার সব ইউনিয়ন পানিতে তলিয়ে গেছে। তাই সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলার বন্যাদুর্গত মানুষকে সহায়তা করার জন্য চট্টগ্রামের জিওসি ও নৌবাহিনীর সঙ্গে কথা বলি। এর পরপরই দুই উপজেলায় সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্যরা বন্যার্তদের সহায়তায় কাজ শুরু করে।’ বন্যার্তদের সহায়তার জন্য ৪০০ টন চাল, শুকনো খাবার বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. ছাইফুল্লাহ মজুমদার জানান, বেশির ভাগ উপজেলায় পানি বাড়ছে। এর মধ্যে ১০ উপজেলায় পানির পরিমাণ বেশি। দক্ষিণের উপজেলাগুলোতে পানি বাড়ছে মূলত পাহাড়ি সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর পানি বাড়ার কারণে। বাড়ছে হালদা ও কর্ণফুলীর পানিও।
উপজেলা ও নগরী মিলিয়ে সোমবার রাত পর্যন্ত ৭৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, মোট প্রায় তিন লাখ ১০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এরমধ্যে নগরীর পরিবারের সংখ্যা খুবই কম। বেশির ভাগই উপজেলাবাসী।
রাউজান উপজেলার উরকিরচর, পশ্চিম গুজরা, নোয়াপাড়া, বাগোয়ান, পূর্বগুজরা, বিনাজুরী ইউনিয়নের রাস্তাঘাটের ওপর দিয়ে তীব্রভাবে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। কোনো কোনো রাস্তা হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে গেছে। হালদা ও কর্ণফুলীর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে হাঁটুপানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
বোয়ালখালীর উপজেলার সারোয়াতলী, শাকপুরা, আমুচিয়া, পোপাদিয়ার বিস্তির্ণ ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। এ উপজেলায় পানিতে কালুরঘাট ফেরির অ্যাপ্রোচ সড়ক, পল্টুন ও বেইলি সেতু ডুবে যাওয়ায় পারাপার ব্যাহত হচ্ছে।
চন্দনাইশ উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা জিমরান মোহাম্মদ সায়েক বলেন, আমরা ত্রাণ তৎপরতা শুরু করেছি। তিন ইউনিয়নে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে অনেকে বসবাস করছেন। তাদের সরে যাবার জন্য মাইকিং করা হয়েছে। যারা সরে যাচ্ছেন না তাদের জোরপূর্বক সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
অপরদিকে সাতকানিয়া উপজেলার চরতী ও আমিলাইষ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ও ফসলের ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাঞ্চনা, এঁওচিয়া, বাজালিয়া ইউনিয়নে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী শতাধিক মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
সাতকানিয়া উপজেলা ইউএনও মিল্টন বিশ্বাস বলেন, কয়েকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হলেও সড়ক যোগাযোগ ঠিক আছে। পাহাড় থেকে স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বাররা মিলে অনেক পরিবারকে সরিয়ে নিয়েছে।
রাঙ্গুনিয়ার ইউএনও আতাউল গণি ওসমানী বলেন, লোকালয়ে এখনও পানি আসেনি। তবে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। বেশি শঙ্কায় আছি পাহাড়ি ঢল নিয়ে। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে অনেককে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া বাঁশখালী উপজেলার পুকুরিয়া ও সাধনপুর ইউনিয়নের সাগরসংলগ্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সেখানে বিস্তীর্ণ এলাকায় ও পাহাড়ে ফসল ও সবজিক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাঁশখালীর ইউএনও সাইদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, তিনটি ইউনিয়নের শতাধিক পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় আছে। এছাড়া সাধনপুরে দেয়াল ধসে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
সন্দ্বীপের ইউএনও সম্রাট খীসা বলেন, জোয়ারের পানিতে ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। সাগরে, নদীতে জোয়ার বেশি হওয়ায় অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে সাঙ্গু নদী ফুলেফেঁপে বান্দরবান শহর প্লাবিত হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় পাহাড় ধসের কারণে জেলা থেকে উপজেলা ও দূরপাল্লার সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় বান্দরবান ‘কার্যত বিচ্ছিন্ন’ হয়ে পড়েছে। জেলা শহরের অনেক মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে হোটেলে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। জেলা শহরে রোববার থেকে কোনো বিদ্যুৎ নেই। ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত হওয়ায় যোগাযোগেও সমস্যা হচ্ছে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস সোমবার (৭ আগস্ট) ভোর ৬টা পর্যন্ত ৩২২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা গত ৩০ বছরে রেকর্ড। রোববার (৬ আগস্ট) সন্ধ্যা ৬টায় পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ৩০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, মানুষের জানমাল রক্ষার্থে চট্টগ্রাম মহানগরে ছয়টি সার্কেলের মাধ্যমে ভাগ করে পাহাড় রক্ষা এবং মানুষের জানমাল রক্ষায় জেলা প্রশাসনের কয়েকটি টিম কাজ করছে। এছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় প্রতিদিন মাইকিং থেকে শুরু করে মানুষকে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে সরে যেতে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।