:: নাগরিক সাহিত্য ডেস্ক ::
চলে গেলেন দুই বাংলার পাঠকনন্দিত কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। সোমবার সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।
গত ২৫ এপ্রিল মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারজয়ী সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর তার শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে।
সমরেশ মজুমদারের প্রয়াণে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক শোকবার্তায় মমতা বন্দোপাধ্যায় বলেন, ‘সমরেশ মজুমদারের প্রয়াণে সাহিত্য জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো।’
এদিকে সমরেশ মজুমদারের প্রয়াণ উপলক্ষে কোনো আচার-অনুষ্ঠান হবে না বলে জানিয়েছেন তাঁর মেয়ে দোয়েল মজুমদার। শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে কলকাতার নিমতলা মহাশ্মশানে।
দোয়েল মজুমদার বলেন, ‘রবীন্দ্র সদনে তার মৃতদেহ থাকবে না। (মঙ্গলবার) সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত কলকাতার ৬৪-বি, শ্যামপুকুর স্ট্রিটের বাড়িতেই মরদেহ শায়িত থাকবে। বাবা চাইতেন না বলে তাই কোনো আচার-অনুষ্ঠান হবে না। দুপুরে নিমতলা মহাশ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হবে।’
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় সমরেশ মজুমদারের। ১৯৬০ সালে আসেন কলকাতায়। বাংলায় স্নাতক সম্পন্ন করেন কলকাতার বিখ্যাত স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স। কর্মজীবনে যুক্ত ছিলেন আনন্দবাজার পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড- এর সঙ্গে।
গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি তার আসক্তি ছিল প্রবল। তার প্রথম গল্প “অন্যমাত্রা” লেখা হয়েছিল মঞ্চনাটক হিসেবে। লেখকজীবনের শুরু সেখান থেকেই। দেশ পত্রিকায় ১৯৬৭ সালে অন্যমাত্রা গল্পটি ছাপা হয়েছিলো। তার প্রথম উপন্যাস “দৌড়”। এটিও ছাপা হয়েছিলো দেশ পত্রিকাতে ১৯৭৫ সালে। শুধু গল্প বা উপন্যাস নয়, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি থেকে গোয়েন্দাকাহিনি, কিশোর উপন্যাস লেখনিতে সমরেশ মজুমদারের জুড়ি মেলা ভার।
বাংলা সাহিত্যজগতে সমরেশ মজুমদারকে বিশেষ খ্যাতি এনে দেয় তার ট্রিলজি- ‘উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ’। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলির মধ্যে সাতকাহন, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান, গঙ্গা, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা, অনুরাগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
অনেক অসাধারণ লেখনীর এই রূপকার ভারতের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন। ১৯৮২ সালে আনন্দ পুরস্কার, ১৯৮৪ সালে সাহিত্য আকাদেমী পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার এবং আইয়াইএমএস পুরস্কার জয় করেছেন। চিত্রনাট্য লেখক হিসাবে জয় করেছেন বিএফজেএ, দিশারী এবং চলচ্চিত্র প্রসার সমিতির অ্যাওয়ার্ড।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় বা সমরেশ বসুদের পরবর্তী সময়ের লেখক সমরেশ মজুমদারের প্রথম গল্প ‘দৌড়’ ১৯৭৫ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এর পরের দশকে সমরেশ মজুমদার একের পর এক স্মরণীয় ছোটগল্প, বড় গল্প, উপন্যাসের জন্ম দিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাতকাহন, তেরো পার্বণ, উনিশ-বিশ, টাকা পয়সা, গর্ভধারিণী, অর্জুন মেজরের অ্যাডভেঞ্চার, এই আমি রেণু, অবশ, স্মরণাগত, দিন যায় রাত যায়, ফেরারি, তীর্থযাত্রী, বন্দি নিবাস, বুনো হাঁস, নিকট কথা, শ্রদ্ধাঞ্জলি, অনুপ্রবেশ, ওরা এবং ওদের মায়েরা, দাউ দাউ আগুন, হারামির হাতবাক্স, বিলে পালায়নি প্রমুখ।
তবে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে বেড়ে ওঠা সমরেশকে সম্ভবত বাঙালি পাঠক বেশি মনে রাখবে পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা তাঁর ত্রয়ী উপন্যাস ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ এর জন্য। তাঁর সাহিত্যিক জীবনের একেবারে গোড়ার দিকে লেখা এই তিন উপন্যাস তাঁকে রাতারাতি পশ্চিমবঙ্গের একজন তারকা লেখকে পরিণত করে। পরবর্তী সময়ে এর চতুর্থ পর্ব ‘মৌষলকাল’ লেখেন সমরেশ।
সমরেশ মজুমদারের জন্ম ১৯৪২ সালের ১০ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের গয়েরকাটায়। তাঁর শৈশব কেটেছে ডুয়ার্সের চা–বাগানে। স্কুলজীবন কেটেছে জলপাইগুড়িতে। ষাটের দশকের শুরুর দিকে কলকাতায় এসে স্কটিশ চার্চ কলেজে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করেন তিনি। সমরেশ মজুমদারের লেখালেখির শুরু গ্রুপ থিয়েটার ও নাটক লেখার মধ্য দিয়ে। তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে।