শরীরে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলেই আমরা জন্ডিসে আক্রান্ত হই। বিলিরুবিন এমন একটা পদার্থ, যা আমাদের শরীরে রক্তচলাচল ব্যবস্থাতে প্রভাব ফেলে, ক্ষতিগ্রস্থ করে। শুধু তাই নয়, এর ফলে আমাদের চোখ এবং ত্বক স্বাভাবিক রং হারিয়ে ক্রমশ হলুদ হয়ে যায়। যে কোনও ব্যক্তি যে কোনও সময়ে জন্ডিসে আক্রান্ত হতে পারেন। এমনকি সদ্যোজাতরাও এই মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বিশেষ করে প্রি-ম্যাচিওর শিশুরা। কীভাবে বুঝতে পারবেন যে আপনি বা আপনার প্রিয়জন জন্ডিসে আক্রান্ত হয়েছেন? জন্ডিসের লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ জেনে নিন।
জন্ডিসের প্রকারভেদ
জন্ডিস প্রধাণত ৩ প্রকারের হয়:
১) প্রি-হেপাটিক জন্ডিস (pre-hepatic jaundice)
এই ধরণের জন্ডিস প্রধাণত লিভারে আঘাত বা লিভারের বিভিন্ন সমস্যা থেকে হয়।
২) হেপাটোসেলুলার জন্ডিস (hepatocellular jaundice)
শরীরে হেমোলিসিসের পরিমান বেড়ে গেলে তা থেকে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়। আর এর ফলেই এই ধরণের জন্ডিস দেখা দেয়।
৩) পোস্ট হেপাটিক জন্ডিস বা অবস্ট্রাকটিভ জন্ডিস (post-hepatic jaundice /obstructive jaundice)
পিত্তথলি থেকে পিত্তরস ঠিকমতো বের হতে না পারলেও জন্ডিস হতে পারে। এই জন্ডিসে ত্বকে হতে পারে অসহনীয় চুলকানি।আমাদের যকৃতের প্রায় গায়ে গায়ে লেগে রয়েছে পিত্তথলি।
জন্ডিসের লক্ষণ
১) ঘণ হলুদ রঙের প্রস্রাব।
২) ফ্যাকাশে রঙের মলত্যাগ।
৩) তলপেটে ব্যথা।
৪) অস্বাভাবিকরকমের ওজন কমে যাওয়া।
৫) জ্বর।
৬) বমি।
৭) ক্লান্তি।
এগুলি জন্ডিসের সাধারণ লক্ষণ। এরই সঙ্গে ত্বক এবং চোখ হলুদ হয়ে যায়। কখনও কখনও জন্ডিসের মাত্রা অত্যধিক বেড়ে গেলে চোখ ব্রাউন বা কমলা রঙেরও হয়ে যেতে পারে। এই লক্ষণগুলি দেখা দিলে অবহেলা না করে সঙ্গে সঙ্গে চিকিত্সকের কাছে যাওয়া দরকার। মাথায় রাখতে হবে, জন্ডিস অবহেলা করলে, তা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
জন্ডিস প্রতিরোধ
১) সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।
২) তাজা এবং গরম খাবার খান।
৩) ফিল্টার করা ফোটানো জল খান।
৪) হেপাটাইটিস এবং অন্যান্য ভ্যাকসিন নিয়মিত নিন।
৫) নিয়মিত ওজন পরীক্ষা করান।
জণ্ডিস রোগের পথ্য
জণ্ডিস রোগে আখের রস খুব উপকারী। তবে সে রস ভালো এবং পরিষ্কার আখের হওয়া চাই। সকালে আখের বা কমলার রস খাওয়া যেতে পারে।
কমলার রস, ডাবের জল, যবের ঘোল, মিষ্টি বেদানার রস, মূলো পাতার রস,ছানার জল, দইয়ের ঘোল, ছাঁচ বা ঘোলের মধ্যে সামান্য লবণ ও গোলমরিচ মিশিয়ে খেলেও উপকার পাওয়া যায়। দুধ খেতে চাইলে দেওয়া যেতে পারে তবে সমমাত্রায় জল মিশিয়ে কড়াইয়ে চাপিয়ে গরম করে তাতে গুটি কয়েক মৌরি, বা কয়েক দানা (১-২ টি) পিপল, অথবা ১ গ্রাম পরিমাণ সূঁঠচূর্ণ দিয়ে খেলে ভালো।
শাক-সব্জির মধ্যে পটল, চৌলাই শাক, কাঁচা মূলো, লাউ, ভেণ্ডি পালঙ, পুদিনা, ধনে, আমলকী, টম্যাটো, রসুন, ধনে পাতা ইত্যাদি খাওয়া যায়।
ফলের মধ্যে মিষ্টি বেদানা, মিষ্টি কমলা, আঙুর, মনাক্কা ও কিশমিশ (জলে ভিজিয়ে রেখে সকালে বীচি ছাড়িড়ে মনাক্কা বা কিশমিশ খেয়ে পরে ঐ ভেজানোর জলটাও খেয়ে নিতে হবে) খাওয়া যায়। আঙুর ইত্যাদি ফল আজকাল বিষাক্ত পোকা-মাকড় নাশক দ্রব্যের মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হয়। এজন্য এ সমস্ত ফল বাড়িতে ২-৩ বার ভালো করে ধুয়ে তবে খাওয়ার পরমার্শ দেবেন। মুসম্বি, সফেদা, পেঁপে, খেজুর ইত্যাদি ফলও খাওয়া যায়।
খাওয়া দাওয়ার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। ভালো পুরনো চালের ভাত বা পুরনো গমের আটার রুটি, যবের রুটি (ঘি ছাড়া) দেওয়া যায়। মুগের ডালের জল দিতে পারেন। প্রয়োজনে তাতে গোলমরিচ ও বিট লবণ দিতে পারেন। এছাড়া মুসুর, অড়হর ডালের জুস করেও খাওয়া যেতে পারে। জণ্ডিস হলে অন্তত ৭-৮ দিন মশলা দেওয়া খাবার, টক, শুকনো লঙ্কা বা তৈলাক্ত খাবার না খেলে ওষুদের ফল ভালো পাওয়া যায়।
জণ্ডিস রোগের অপথ্য
তেল, ঘি, হলুদ, শুকনো লঙ্কা এবং গরম মশলা দেওয়া খাবার বর্জনীয়। টক খাওয়াও চলবে না। সামান্য মাত্রায় গরুর দুধের মাখন চলতে পারে। রাই, হিঙ, তিল, গুড়, বেসন, কচু, মাটির তলার আলু, মিষ্টি আলু ইত্যাদি খাওয়াও নিষিদ্ধ। ছোলা ও বিউলির ডাল এবং ময়দার তৈরি খাবার নিষিদ্ধ। কেক, ভাজা খাবার, পিত্তকারক খাবার ইত্যাদি খাওয়া বর্জন করতে হবে। এছাড়া রোদে ঘোরা, আগুনের পাশে বসা, খুব পরিশ্রমের কাজ করা, বেশি হাঁটাহাঁটি করা ক্রোধ ও উত্তেজনা, উদ্বেগ, সম্ভোগ বা সহবাস ইত্যাদি সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে। ধূমপান, মদ্যপান করাও চলবে না। আমিষ খাদ্য যেমন, মাছ, মাংস, ডিম খাওয়া চলবে না। চা কফি বা অন্যান্য মাদক দ্রবও পান করা চলবে না। জল ফুটিয়ে অথবা বিশুদ্ধ জল পান করতে হবে। কোনো খাবার বাসি খাওয়াও চলবে না।