:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলায় জামিন পেয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন রোববার এ আদেশ দেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাবলিক প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল নাগরিক নিউজকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আদেশের আগে ড. মুহাম্মদ ইউনূস আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করলে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর ড. ইউনূসের জামিন আবেদনের বিরোধিতা করেন। উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে আদালত ড. ইউনূসের জামিন মঞ্জুর করেন।
গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘এটা এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, দেশের মধ্যেও সীমাবদ্ধ নয়, সারা দুনিয়ার মানুষ লক্ষ করছে এই বিচারে কী হলো। আমরা যা যা করছি তা সবই তারা দেখছে।’
৩ মার্চ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় জামিন পাওয়ার পর এসব কথা বলেন তিনি।
আজকের এই ঘটনা ইতিহাস হয়ে থাকবে মন্তব্য করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এই যে ঘটনাগুলো ঘটছে তার পক্ষে লিখুন, বিপক্ষে লিখুন কোনো অসুবিধা নাই। কিন্তু এটা রেকর্ডেড। জাতির ইতিহাসের একটা অংশ হয়ে যাবে।’
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আপনারা আজকের এই ছবিটা তুলে রাখুন। দুর্নীতি দমন কমিশনের বটতলা আমরা সবাই। এটা ঐতিহাসিক একটা ছবি। এটা আজকে-কালকে পত্রপত্রিকায় বের হবে। কিন্তু এটা যুগ যুগ ধরে নানা বইতে প্রকাশিত হবে।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘একজন নোবেল বিজয়ীর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনেছে, জালিয়াতির অভিযোগ এনেছে, মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ এনেছে। আমি একা নই। আমরা আরও ৭ জন, যারা সারাজীবন কঠোর পরিশ্রম করেছি গরিব মানুষের জন্য। এরা কোনো চাকরি করতে এখানে আসে নাই। তারাও অর্থ আত্মসাৎ, জালিয়াতির এবং মানি লন্ডারিংয়ের জন্য অভিযুক্ত।’
এ নোবেলজয়ী বলেন, ‘আমাদের ছেলে-মেয়েরা এগুলো স্কুলে পড়বে। তারা তো নোবেল পুরস্কারের কথা ভুলতে পারবে না। তখন তারা পড়বে তার নামে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ দেয়, মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ দেয়, জালিয়াতিতে দেয়; তখন তারা কনফিউশনে পড়ে যাবে। আসলটা কী! এটা কি মুখোশ নাকি আসল মানুষ।’
গ্রামীণ টেলিকমের কর্মীদের লভ্যাংশের ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা মামলায় গত ১ ফেব্রুয়ারি ড. ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় দুদক।
ড. ইউনূস ছাড়া অভিযোগপত্রে গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুল ইসলাম, প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান, পরিচালক পারভীন মাহমুদ, নাজনীন সুলতানা, মো. শাহজাহান, নূরজাহান বেগম এবং এস এম হাজ্জাতুল ইসলাম লতিফী, আইনজীবী মো. ইউসুফ আলী ও জাফরুল হাসান শরীফ, গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসান, ইউনিয়নের প্রতিনিধি মো. মাইনুল ইসলাম এবং জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের দপ্তর সম্পাদক মো. কামরুল হাসানকে আসামি করা হয়।
অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিদের মধ্যে কামরুল হাসানের নাম তদন্তের পর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অপর ব্যক্তিদের নাম এজাহারে ছিল।
মামলায় ড. ইউনূস ও পারভীন মাহমুদ জামিনে আছেন। অন্য ১২ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।
দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বাদী হয়ে গত বছরের ৩০ মে ওই মামলা করেন। মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসামিরা ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে; যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ।
দুদক জানায়, গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. ইউনূস ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল ইসলামসহ প্রতিষ্ঠানটির বোর্ড সদস্যদের উপস্থিতিতে ২০২২ সালের ৯ মে গৃহীত এক সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখায় ৮ মে একটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারীদের পাওনার লভ্যাংশ বিতরণে শ্রমিক ইউনিয়ন ও গ্রামীণ টেলিকমের মধ্যে একই বছরের ২৭ এপ্রিল একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তিতে ৮ মে ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়, যা বাস্তবে অসম্ভব। কাগজপত্র নকল করে এটা করা হয়েছে।
দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়, চুক্তি অনুযায়ী ও ১০৮তম বোর্ড সভার (গ্রামীণ টেলিকম) সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০২২ সালের ১০ মে গ্রামীণ টেলিকমের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের মিরপুর শাখা থেকে ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখায় ৪৩৭ কোটি ১ লাখ ১২ হাজার ৬২১ টাকা স্থানান্তর করা হয়। কর্মচারীদের লভ্যাংশের টাকা বিতরণ না করে তা আত্মসাৎ করা হয়।
লভ্যাংশের ভাগ বাবদ পাওনা টাকা চেয়ে গ্রামীণ টেলিকমের ১৭৬ কর্মী শতাধিক মামলা করেছিলেন। তাঁরা হাইকোর্টেও গিয়েছিলেন। পরে তাঁদের সঙ্গে গ্রামীণ টেলিকমের সমঝোতা হয়। ড. ইউনূসের আইনজীবীরা বলছেন, সমঝোতার মাধ্যমে পাওনা পেয়ে কর্মীরা ২০২২ সালের মে মাসে মামলাগুলো প্রত্যাহার করেন। এরপর পাওনা পরিশোধের বিষয়টিকেই অর্থ আত্মসাৎ হিসেবে ধরে দুদক মামলা করে।
আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘সরকারের নির্দেশে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তর দুদকে চিঠি দিয়েছে; যা তারা পারে না। আর ড. ইউনূস যখন এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন, তখন তড়িঘড়ি করে দুদক তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে। এর মাধ্যমে ড. ইউনূসকে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়েছে।’
সকালে ড. ইউনূস শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের করা মামলায় কাকরাইলে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে জামিন নেন। পরে বেলা আড়াইটায় পুরান ঢাকায় তিনি ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতে হাজির হয়ে জামিন চান।