জাতিসংঘে জিয়াউর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ

জাতিসংঘে জিয়াউর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ এখন পর্যন্ত কোন বইপত্র কিংবা কোন ম্যাগাজিনে আসেনি। অনেক ঘাটাঘাটির পর এটা তৎকালীন একটি পত্রিকা থেকে লেখাটি সংগ্রহ করে প্রকাশ করা হল। ১৯৮০ সালের ২৭ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এই ঐতিহাসিক ভাষণ দেন।

জনাব সভাপতি, জনাব মহাসচিব ও সম্মানিত প্রতিনিধিবৃন্দ,
বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছি। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এই একাদশ বিশেষ অধিবেশন বাংলাদেশের দৃষ্টিতে যে কতটা গুরুত্বর্পূণ আজ এখানে আমার উপস্থিতি তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। এই বিশেষ অধিবেশনের ব্যবস্থা করতে দীর্ঘ সময় লেগেছে, এজন্যে অনেক কষ্ট স্বীকারও করতে হয়েছে। সাধারণ পরিষদের ষষ্ঠ ও সপ্তম বিশেষ অধিবেশনের পরবর্তী বছরগুলোতে একটি নতুন আন্তর্জাতিক অর্থর্নৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে বিশেষ কোন অগ্রগতি হয়নি। ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যেকার বৈষম্য হ্রাস পাবার বদলে দেখা যাচ্ছে তা বরং বৃদ্ধিই পেয়েছে।

জাতিসংঘ সনদের আদর্শ এবং মানবাধিকার সংকান্ত্র ঘোষণার প্রতি আমরা সকলেই আনুগত্যশীল। মানুষের মৌলিক দুটি অধিকার: ক্ষুধা ও দারিদ্রতা থেকে মুক্তিসহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, পূর্ণ কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ও বিকাশের নিশ্চয়তা বিধান করতেও আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তা সত্বেও আমরা এখন প‌র্যন্ত যে অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছি তা খুবই সামান্য। এর কারণ কি?

ক্ষুধার্তের সংখ্যা বাড়ছে
এটাইবা কেমন কথা, জাতিসংঘের প্রথম ও দ্বিতীয় উন্নয়ন দশকের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি আমাদের সর্বসম্মত আস্থা সত্বেও দুনিয়ার দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত লোকের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস না পেয়ে ক্রমাগত বেড়েই চলছে। প্রতি বছর এই মহান সংস্থা, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে অগণিত প্রস্তাব গ্রহণ করে আসছে, অথচ এই আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি একক বৃহত্তম হুমকি যেটা সে ব্যাপারে তার কোন খেয়াল নেই। তারইবা কারণ কি?
সারা দুনিয়ায় প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের পরিমাণ কেন বাড়তে বাড়তে এখন বছরে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে অথচ সেই তুলনায় অর্থনৈতিক সহায়তার মাত্রা সত্যিকার অর্থে দিন দিন কমেই চলেছে কি কারণে, তারইবা জবাব কে দেবে?

বিশ্বের কোটি কোটি বঞ্চিত, ক্ষুধার্ত, সহায়সম্বল ও আশ্রয়হীন মানুষ, যারা প্রতিদিন প্রতি ‍মুহূর্ত বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত, তাদের আমরা কি বাণী শোনাবো? আপনারা কি চান, আমরা তাদের বলি: এই পৃথিবীকে আমরা দুটি ভাগে ভাগ করতে চাই? যার একটিতে জীবনধারার ভিত্তি হবে অপচয়বহুল ভোগ-বিলাস, যার ফলে বিশ্বের মূল্যবান ক্ষয়িঞ্চু প্রাকৃতিক সম্পদরাজি দ্রুত নিঃশেষিত হবে, যা পরিবেশকে দূষিত করে তুলে পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করবে। পক্ষান্তরে সেই একই গ্রহের ভেতরে থাকবে দুঃখ দুর্দশা ও বঞ্চণায় ভারাক্রান্ত অপর এক জগতে যেখানে প্রতিদিন শিশুরা অনাহারে প্রাণ হারায় কিংবা অপুষ্টির ফলে শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে ¬- যেখানে

দারিদ্রতা, রোগ আর হতাশাজীর্ণ মানবেতার জীবন যাপনই হচ্ছে ভাগ্যলিপি?
চলতি শতাব্দিতে মানব জাতি বিস্ময়কর অগ্রগতি হাসিল করেছে। গত হয়েছে উপনিবেশবাদের দিন। গত পঁয়ত্রিশ বছরে জাতিসংঘের সদস্য সংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিনগুন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, চিকিৎসা আর যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে তার সত্যিই কোন তুলনা নেই। মানুষ মহাসাগরের অতলে আর মহাশূন্যে অভিযান চালিয়েছে। তবুও এ প্রসঙ্গে আজ থেকে দুই দশক আগে এই বিশ্বসংস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট উক্তির পুনরাবৃত্তি করে আমি বলবো, মহাশূন্যের রহস্য যেন আমাদের মানব সমাজের সম্মুখীন রূঢ় বাস্তবতা থেকে আমাদের দৃষ্টি অথবা উদ্যমকে বিক্ষিপ্ত না করে। দারিদ্রতা, নিরক্ষরতা আর রোগশোকের মোকাবেলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছাড়া রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব একটা পরিহাস আর কিছু নয়। আশার আলোর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি ছাড়া আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার শুধুই শ্লোগান হয়ে থাকবে।

১৯৪৫ সনে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই সাড়ে তিন দশক ধরে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের জন্যে একটি উন্নত বিশ্ব এবং আরো সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ রচনার জন্যে কাজ করে চলেছি। জাতিসংঘ সনদ এবং এই বিশ্বসংস্থার সম্পূর্ণ কাঠামোই গড়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী পরস্পর নির্ভরতা আর সহযোগিতার আর্দশের ভিত্তিতে। বিশ্বব্যাপী এই পরস্পর নির্ভরশীলতাকে আমরা বেছে নিয়েছিলাম? এর পেছনে কোন যুক্তি ছিল? এই যুক্তি হচ্ছে, আমরা সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং মুক্তি, মানুষের মর্যাদা আর ন্যায় বিচারের নিশ্চয়তা বিধানকারী একটি বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছি। এর কারণ বর্তমান বিশ্ব সমাজের বিবর্তনের ধারাতে এই সত্যটি বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে, যে আজকের অধিকাংশ সমস্যারই প্রকৃতি হচ্ছে আন্তর্জাতিক যেগুলোর একটা অন্যটার সংগে সম্পর্কযুক্ত, আলাদাভাবে যেসব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। শান্তি যেমন অবিভাজ্য তেমনি শান্তিকে বিপন্ন না করে বিশ্বকে ধনী আর দরিদ্র এই দুই ভাগে ভাগ করা যায় না। আমরা যদি অবিভাজ্য মানব সমাজে বিশ্বাস করি তবে এই সমাজের প্রতি আমাদের পারস্পরিক কর্তব্য ও দায় দায়িত্বকেও স্বীকার করে নিতে হবে।

বিশ্বব্যাপী সহযোগিতার সপেক্ষে এর চাইতেও অনেক বেশি জোরালো যুক্তি পেশ করা যায়, যেমনটা করা হয়েছে ব্রান্ডট কমিশনের রিপোর্টে। বিশ্ব সমস্যাসমূহের সম্যক উপলব্ধি ও এসবের মোকাবেলায় গঠনমূলক সুপারিশ প্রদানের জন্য আমরা জনাব ব্রান্ডট ও তার কমিশনের সদস্যদের প্রশংসা করছি। এই রিপোর্টের একটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে এতে দেখানো হয়েছে যে উত্তর ও দক্ষিণ উভয়েরই পারস্পরিক স্বার্থে একটি নতুন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। এই রিপোর্টে ‘উত্তর‘ থেকে ‘দক্ষিণ‘কে বাণিজ্য বিনিয়োগ, সম্পদ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর ক্ষেত্রে যেসব সুযোগ-সুবিধা দিতে বলা হয়েছে তা দক্ষিণের প্রতি কোন বদান্যতা বা ঔপনিবেশিক আমলের অন্যায় অবিচারের প্রতিকার হিসাবে নয় বরং ‘উত্তরের‘ স্বার্থে এটা দরকারী বলেই তা করা হয়েছে।

বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন দরকার 
আমি বলতে চাই যে এই পারস্পরিক স্বার্থের বিভিন্ন দিক রয়েছে ব্যাপারটা শুধু এই নয় যে এটা দক্ষিণের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে- যার ফলে উত্তর আরও বেশি করে তাদের উপর উদ্বৃত্ত রফতানীযোগ্য পণ্য চাপিয়ে দিতে পারবে। এ ব্যাপারে অর্থনৈতিক দিক থেকে খুবই জোরালো যুক্তি থাকলেও এর সুদূর-প্রসারী রাজনৈতিক তাৎপর্যকে যেন আমরা ঘুণাক্ষরেও অবহেলা না করি। বছর খানেকের কিছু কমই হবে হাভানা শীর্ষ সম্মেলনে পরলোকগত প্রেসিডেন্ট টিটো স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন উন্নয়নকামী দেশগুলোর প্রতি বৈষম্যমূলক বর্তমান আন্তর্জাতিক অর্থ-ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনা ছাড়া বিশ্বের নিরাপত্তা, শান্তি ও স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা বিধান প্রায় অসম্ভব। মানব সমাজের নিয়ন্ত্রণে যেসব বৈষয়িক সম্পদ রয়েছে সেগুলো সবার মঙ্গলের জন্যে কাজে না লাগিয়ে বরং তার বিপরীত উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো হচ্ছে। অসম অর্থনৈতিক সম্পর্ক নতুন নতুন জটিলতা আর সংঘাতের এক বিপজ্জনক উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শান্তি অবিভাজ্য
শান্তির অবিভাজ্যতা সম্পর্কে কারো মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ আছে কি? উত্তর কি মনে যে সে দক্ষিণের বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি ও আলোড়ন থেকে গাঁ বাঁচিয়ে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবে? এই কি তার বিশ্বাস যে যখন যুদ্ধ-বিগ্রহ, বঞ্চনা আর স্থবিরতা বিষিয়ে তুলবে আমাদের এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা, তখন তার এলাকাতে বিরাজ করবে অব্যাহত শান্তি, প্রগতি আর সমৃদ্ধি?

ব্রান্ডট কমিশনের রির্পোটে যে সুপারিশগুলো রয়েছে তা সুসম ও বাস্তবধর্মী। সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলির জন্য একটি বিশেষ সক্রিয় কর্মসূচী গ্রহণসহ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা ও প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে একটি সন্তোষজনক ভারসাম্য অর্জন, অস্ত্রসজ্জার উপর করারোপ ও নিরস্ত্রীকরণ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের বর্ধিত প্রচেষ্টা, দক্ষিণের দেশগুলোর মধ্যেকার সহযোগিতা বৃদ্ধি, বিশেষ করে তাদের পণ্য দ্রব্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন ও বিতরণ ব্যবস্থায় অধিকতর অংশগ্রহণের ব্যাপারে তাদের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রসার, জ্বালানী শক্তি সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক কর্মকৌশল উদ্ভাবন, উন্নয়নকামী দেশসমূহের শিল্পোন্নয়, শুল্ক বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা গঠন, বিশ্ব মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার এবং উন্নয়নমূলক কাজের জন্য অর্থ সরবরাহে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের যে সুপারিশ এতে করা হয়েছে তা যেমন বলিষ্ঠ তেমনি যুক্তিপূর্ণ। অবশ্য প্রয়োজনবোধে কোন কোন ক্ষেত্রে একটু আধটু রদবদল করতে আমাদের আপত্তি নেই। তবে আমাদের অবশ্যই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাণিজ্য ঘাটতি ছয় হাজার কোটি ডলার
আজ অমাদের কন্ঠে বিপুল উদ্বেগের এই যে অনুরণন ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেটা কি কারণে? কেন আজ আমরা এতটা মরিয়া হয়ে পড়েছি? আমাদের এই উদ্বেগের কারণ হচ্ছে অস্ত্র প্রতিযোগিতার দ্রুত প্রসার। বর্তমানে সামরিক খাতে বিশ্বের বার্ষিক ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচশত বিলিয়ন ডলার এবং প্রতি বছর তা চল্লিশ বিলিয়ন হারে বাড়ছে। পক্ষান্তরে সরকারী উন্নয়ন সহায়তার মাত্রা কমেই চলেছে এবং বর্তমানে তার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে অস্ত্রসজ্জা খাতে ব্যয়ের মাত্র পাঁচ শতাংশেরও কম। সামগ্রীকভাবে উন্নয়নকামী দেশগুলোর অর্থনৈতিক চিত্র, অজানা একটা শংকা আর হতাশায় আমাদের হৃদয় ভারাক্রান্ত করে তোলে। উন্নয়নকামী দেশগুলো সম্মিলিত বৈদেশিক দেনার পরিমাণ এখন তিনশো বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এসব বৈদেশিক দেনার দায় পরিশোধে প্রতি বছর খরচ হচ্ছে চল্লিশ বিলিয়ন ডলার যা এসব দেশের মোট রফতানী আয়ের শতকরা ২০ ভাগেরও বেশি। অংশত এই কারণে এবং অংশত শিল্পোন্নত দেশগুলোর বাণিজ্য নীতি আর তাদের প্রস্তুত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ১৯৭৯ সালে উন্নয়নকামী দেশসমূহের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল পঁয়তাল্লিশ বিলিয়ন ডলার। ১৯৮০ সালে এই অংক বেড়ে ৬০ বিলিয়ন ডলার হবে অনুমান করা হচ্ছে।

৪০ কোটি মানুষ অনাহারে কাটায়
পূর্ব-ইউরোপসহ উত্তর ভূখন্ডে রয়েছে বিশ্বের জনসংখ্যার মাত্র এক-চতুর্থাংশ অথচ তাদের হাতেই রয়েছে বিশ্বের মোট আয়ের চার-পঞ্চমাংশ। বিশ্বের শিল্পোকারখানার ৯০ শতাংশেরও বেশি রয়েছে উত্তরাঞ্চলে। উত্তরের বহু জাতিভিত্তিক কর্পোরেশনগুলি প্রযুক্তিগত সর্বাধুনিক উদ্ভাবনকে তাদের কুক্ষিগত করে রেখেছে।দক্ষিণের যে এক বিলিয়নেরও বেশি মানব সন্তান চরম দরিদ্রসীমার মধ্যে বাস করে তাদের মধ্যে চারশো মিলিয়নের বেশি প্রায় অনাহারে কাটায়। একমাত্র ১৯৭৮ সালেই ৫ বছরের কম বয়সী বারো মিলিয়ন শিশু অনাহারে মৃত্যু বরণ করেছে। আমূল পরিবর্তন সূচক কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে দক্ষিণের বর্তমান নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটবে।

সবচেয়ে গরীব ৩০
এই নৈরাশ্য ও অনিশ্চয়তার পটভূমিতে রয়েছে জাতিসংঘ কর্তৃক এলডিসি অর্থাৎ সবচেয়ে অনুন্নত দেশ বলে চিহ্নিত ত্রিশটি দেশ। এসব দেশের অবস্থা খুব কম করে বললেও অত্যন্ত ভয়াবহ। সবচেয়ে অনুন্নত এই দেশগুলোতে বাস করছে আনুমানিক দুশো ষাট মিলিয়ন মানুষ অর্থাৎ উন্নয়নকামী সকল দেশের মোট জনসংখ্যার তের শতাংশ। ১৯৭০ থেকে ৭৭ সাল পর্যন্ত সময়ের পরিসরে উন্নয়নকামী সকল দেশের মাথাপিছু আয়ের বার্ষিক গড় যেখানে চারশো ছয় মার্কিন ডলার থেকে পাঁচশো পাঁচ ডলারে উন্নীত হয়, সেক্ষেত্রে সবচেয়ে অনুন্নত দেশ গুলিতে এই বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল মাত্র ছ ডলার অর্থাৎ ১৯৭০ সালে ১শো ৩৩ ডলার থেকে ১৯৭৭ সালে ১শো ৩৯ ডলারে। এ সময়ে উন্নয়নকামী দেশগুলোতে বাজারদর অনুযায়ী সত্যিকার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ক্ষেত্রে মাথাপিছু বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল শতকরা তিন ভাগ আর সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর বেলায় তা ছিল মাত্র শূন্যে দশমিক দুই ভাগ। বিশ্ব ব্যাংকের প্রকাশিত ১৯৭৯ সালের বিশ্ব উন্নয়ন রিপোর্টে বলা হয়েছে, যদি আমরা ধরেও নিই ১৯৮০‘র দশকে উন্নয়নকামী দেশগুলোতে অর্থনৈতিক বিকাশের গতি হবে সবচেয়ে দ্রুত, তবুও এসব দেশের গড় আয় দাঁড়াবে শিল্পোন্নত দেশসমূহের আয়ের বারো ভাগের এক ভাগের মত আর সবচেয়ে অনুন্নত দেশে এই পরিমাণ হবে ৪০ ভাগের এক ভাগের কম। সবচেয়ে অনুন্নত দেশ গুলোতে মাথাপিছু শিল্প পণ্য উৎপাদনে ১৯৬০ সালের ৭ ডলার থেকে বেড়ে ১৯৯০ সালে ২০ ডলারে পৌছাবে- এর পাশাপাশি উন্নয়নকামী দেশসমূহে ১৯৬০ সালে এই অংক ছিল ৪৪ লাখ ডলার এবং ১৯৯০ সালে তা হবে ১শো ৭৪ ডলার। সবচেয়ে অনুন্নত দেশের কৃষি পণ্য উৎপাদন ১৯৬০ সালের ৬৯ ডলার ১৯৯০ সালে ৬২ ডলারে নেমে যাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে ১৯৭০-৭৮ মেয়াদে উন্নয়নকামী দেশগুলিতে স্থিতিশীল মূল্যের হিসাবে রফতানী আয়ের পরিমাণ যেখানে ঊর্ধমুখী, সে তুলনায় সবচেয়ে অনুন্নত দেশে তার ক্রমাগত ঘাটতি হয়েছে।

অনতিবিলম্বে কিছু কিছু জরুরী ও বলিষ্ঠ কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে আমাদের ভয় হয়, সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলির বেশির ভাগেরই পরিস্থিতি অতি দ্রুত আয়েত্তের বাইরে চলে যাবে। এই কারণেই ম্যালিনায় পঞ্চম আঙ্কটাড সম্মেলনে গৃহীত জরুরী কর্মপন্থা, সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলির অর্থনীতিকে অবিলম্বে চাংগা করে তোলা যার লক্ষে, তার দ্রুত বাস্তবায়নের জন্যে আন্তর্জাতিক সমাজের উপর আমরা এতো চাপ দিচ্ছি। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে শিল্পোন্নত দেশসমূহ তাদের সম্প্রতি ঘোষিত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলির জন্যে তাদের অর্থনৈতিক সহায়তার পরিমাণ দ্বিগুণ বৃদ্ধি করুক। এ ধরনের সাহায্যের পরিমাণটাই শধু যথেষ্ট নয়, এর গুণগত উৎকর্ষতার প্রশ্নটাও সমান জরুরী। এই সাহায্য যতোটা সম্ভব শর্তহীন। অনুদানের আকারে হতে হবে। ১৯৭৮ সালে বাণিজ্য ও উন্নয়ন বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেশ কয়েকটি শিল্পোন্নত দেশ যদি সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোকে প্রদত্ত তাদের ঋণ মওকুফ করে দিয়েছে কিংবা রেয়াতি সুবিধা দিয়েছে তবু কিছু কিছু দেশ এখনও এ ব্যাপারে পিছিয়ে রয়েছে। আর বিলম্ব না করে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য আমরা এই দেশগুলির প্রতি জরুরী আবেদন জানাচ্ছি। সবরকম শুল্ক বাধা অপসারিত করে এসব দেশ থেকে রফতানীর পরিমাণ বৃদ্ধির জন্যে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ও অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলির উচিত হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাহায্য দানের ব্যবস্থা করা। অপর দিকে সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলির রেয়াতি শর্ত ক্রুড অয়েল এবং পেট্রোলজাত সামগ্রীর পূর্ণ চাহিদা পূরণের দায়িত্ব নিতে হবে ওপেক দেশগুলিকে। এসব দেশের উদ্বৃত্ত জনশক্তিকে কাজে লাগানোর জন্যেও তাদের বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।

নিজস্ব সম্পদ আহরণ
সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলো কি চায়? আমরা চাইছি আমাদের জনগণের জন্যে খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা আর চিকিৎসা – জীবনধারণের এই মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে। আমাদের নিজেস্ব সম্পদের পূর্ণ আহরণের সামর্থ অর্জন আমাদের কাম্য। আমাদের মধ্যে অনেক দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ কিন্তু এসব সম্পদের যথাযথ আহরণের জন্যে আমাদের নেই কারিগরি জ্ঞান অথবা মূলধন, অথবা ক্ষেত্রবিশেষে দুটই। ব্রান্ডট কমিশনের মতে, সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর উন্নয়ন খরচ মেটানোর জন্য বার্ষিক মোট যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা বিশ্বের বর্তমান অস্ত্রসজ্জা ব্যয়ের এক শতাংশেরও কম। একটি ট্যাংকের মূল্য দিয়ে আমরা এক লক্ষ টন চাল দারণ ক্ষমতাসম্পন্ন গুদাম নির্মাণ করতে পারি আর একটি জেট জঙ্গী বিমানের অর্থ দিয়ে গড়ে তুলতে পারি চল্লিশ হাজার গ্রাম্য চিকিৎসা কেন্দ্র।

উত্তরের বন্ধুরা আমাদের বলে থাকেন যে আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে তাদের বিশেষ আগ্রহ থাকলেও তাদের হাত পা বাঁধা। আমাদের জন্যে সুদূরপ্রসারী সুবিধা সুবিধা প্রদানের ক্ষমতা তাদের সরকারের নেই, তাদের পার্লামেন্ট এটা মেনে নেবে না, তাদের নির্বাচকমন্ডলীকে বোঝানো যাবে না এবং তাদের কোষাগার শূন্য। কাজেই আমরা যেন আমাদের দূরাবস্থার পরিত্রাণের জন্যে ওপেক দেশসমূহের শরণাপন্ন হই। এর জবাবে আমি বলবো, আপনাদের এসব সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে আমরা আপনাদের সহায়তা করতে প্রস্তুত। জনাব ব্রান্ডটের নেতৃত্বে পরিচালিত কমিশনের সদস্যরা সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আলাপের মাধ্যমে যেমনটা করেছেন। আমরা সানন্দে আমাদের দেশের দূত, প্রতিনিধিদল, ছাত্র ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতা সাংবাদিকও শিক্ষাবিদদের বক্তৃতা সফরে পাঠিয়ে জনমত সংগঠনে উদ্যোগী হতে রাজী আছি। আমার বিশ্বাস তারা উত্তরের তাদের সমগোত্রীয় অথচ অধিকতর সচ্ছল ব্যক্তিদের শেষ পর্যন্ত এটা বোঝাতে সক্ষম হবেন যে আমরা যদি বর্তমান অচলাবস্থার দ্রুত নিরসন না করতে পারি তাহলে বিশ্ব এমন এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে যা থেকে ধনী, দরিদ্র কেউই রেহাই পাবে না।

শীর্ষ সম্মেলন চাই 
আত্মপ্রবঞ্চনার সময় আমাদের নেই। আপনারা আমাদের পরিষ্কার জানিয়ে দিন, আপনাদের কোন সাহায্যে আসতে পারি কি না। যদি আমরা এটাই সাব্যস্ত করি যে, সমস্যাটি প্রকৃত পক্ষে একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন এবং এর মীমাংসার জন্যে যে সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্তমালার প্রয়োজন তা এই বিশেষ অধিবেশনের এখতিয়ারের বাইরে, তাহলে বেশতো একটা শীর্ষ সম্মেলনেরই ব্যবস্থা করা হোক। তবে আমি আপনাদের অনুরোধ করবো, আমরা যেন আগে থেকেই সত্যকে এড়িয়ে যাবার চেষ্ঠা না করি, আমাদের নিষ্ক্রিয়তাকে ঢাকবার জন্যে মিথ্যে অজুহাত খাড়া না করি। আমরা বসে আছি একটি বিস্ফোরণ উন্মুখ জীবন্ত আগ্নেয়গিরির উপর এবং নষ্ট করার মত বিন্দুমাত্র সময় আমাদের হাতে নেই।
সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর মতামতের যথাযথ বিবেচনা এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থায় সমমর্যাদায় তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদানের প্রশ্নটিও আমার বিবেচনায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এসব দেশের সম্পদ উন্নয়নের জন্যে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ দরকার যাতে তারা বৈদেশিক চাপ ও শোষণের হাত থেকে নিজেদের ক্রমান্বয়ে মুক্ত করতে পারে। সর্বোপরি এসব দেশকে অবশ্যই বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ও বাধা ছাড়াই তাদের নিজ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সুযোগ দিতে হবে।

আমরা আশা করছি যে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন কর্মকৌশলে সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর জন্যে ম্যানিলায় গৃহীত নির্দিষ্ট কর্মপন্থা কার্যক্রমটি অন্তর্ভূক্ত করার ব্যাপারে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হবে। আমরা এটাও আশা করি সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলির ব্যাপারে আগামী বছরে জাতিসংঘের যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবার কথা আছে, তাতে এই কার্যক্রমের বিস্তারিত লক্ষ্য নির্ধারণ এবং এর বাস্তবায়নের উপায় উদ্ভাবন সম্ভব হবে। এই সম্মেলনের প্রস্তুতিতে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই বিস্তারিত সমীক্ষা এবং এমন একটি বিশেষ কার্যক্রম তৈরির কাজ হাতে নিয়েছে যার ফলে বাংলাদেশের উন্নয়নের কাজ আরো ত্বরান্বিত হবে। ইতিমধ্যে জরুরী কর্মপন্থা কার্যক্রমের আওতায় অনতিবিলম্বে সুনিদিষ্ট বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণও অত্যাবশ্যক।

৮৫ নাগাদ জনসংখ্যা দু শতাংশ কমাবো
এবার আমি বাংলাদেশ সম্পর্কে কয়েকটি কথা উল্লেখ করতে চাই। সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ বাস করে এই ভূখন্ডে। জাপান ও নেদারল্যান্ডের তুলনায় দ্বিগুণ ঘন জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় বিশ্বের মধ্যে প্রায় সর্বনিম্ন। এর জনসংখ্যার পঞ্চাশ শতাংশের বেশি হয় বেকার অথবা ভূমিহীন চাষী যারা শুধু বছরের নির্দিষ্ট একটা মওসুমে কাজ পায়। প্রতিবছর আমাদের বিশ লাখের উপর অতিরিক্ত মুখের আহার জোগাতে হয় – জোগাতে হয় পরনের জন্যে আর কাপড়, শিক্ষার জন্যে আরো বিদ্যালয় এবং মাথা গোঁজার জন্যে আরো বাসগৃহ। তবু আমরা হার মানিনি এবং আমরা হার মানবো না। আগামী পাঁচ বছরে আমাদের খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করতে আমরা সংকল্পবদ্ধ। দেশের জন্মহার দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে ১৯৮৫ নাগাদ দুই শতাংশে আমরা কমিয়ে আনবো। আমরা আরো বিদ্যালয় ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করবো। দেশের কোন নারী, পুরুষ ও শিশুকে আমরা অভুক্ত, আশ্রয়হীন অথবা বস্ত্রহীন থাকতে দেবো না। কৃষি ও পল্লীর উন্নয়নকে আমরা অগ্রাধিকার দিয়েছি। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের প্রায় নয় কোটি জনগণের সবাইকে কর্মচেতনায় উদ্বুদ্ধ করা। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আমাদের আস্থাও অবিচল থাকবে। স্বনির্ভরতা অর্জন আমাদের মূলমন্ত্র। আমাদের সফল হতেই হবে কারণ বিফল হবার উপায় আমাদের নেই।

সম্প্রতি আমরা আমাদের দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনার কাজ শুরু করেছি এবং তার কাঠামোর মধ্যে এই লক্ষ্যসমূহের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া আছে। পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারে আমাদের মিত্রদের কাছ থেকে যে ব্যাপক সমর্থন আমরা পেয়েছি সেজন্যে আমরা কৃতজ্ঞ তবে আমাদের চাহিদার তুলনায় এ সাহায্য এখনও মোটেও পর্যাপ্ত নয়।

জ্বালানী সম্পদ উন্নয়নে কনসর্টিয়াম
বর্তমান আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আমাদের দুই দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। এক দিকে তেল আমদানীর জন্য আমাদের ক্রমশঃ বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে, অপর দিকে আমদানীকৃত কলকব্জা এবং শিল্প কাঁচামালের জন্যেও আমাদের তা করতে হচ্ছে। বর্তমানে জ্বালানী তেল ও পেট্রোলিয়াম সামগ্রীর আমদানি বাবদ আমাদের খরচের পরিমাণ আমাদের মোট রফতানীর আয়ের পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি। ১৯৬০ সালে সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর তেল আমদানি খাতের ব্যয় ছিল ছশো মিলিয়ন ডলারের মত। আর চলতি বছর বাংলাদেশেকে তার অপরিশোধিত তেলের চাহিদা পূরণের জন্যে খরচ করতে হবে এর প্রায় সমপরিমাণ অর্থ। আমি এই প্রসঙ্গে প্রস্তাব করছি সামগ্রিকভাবে ওপেক দেশগুলিকে অনুন্নত দেশসমূহের তেল আমদানি ব্যয় মেটানোর ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারণ আমরা ইতিমধ্যে লক্ষ্য করেছি ভেনেজুয়েলা ও মেক্সিকো ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় এলাকার দরিদ্রতম দেশগুলোকে রেয়াতী মূল্যে তেল সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমার আর একটা প্রস্তাব হল, সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর জ্বালানী শক্তি সম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে উন্নত ও ওপেক উভয়ের সমর্থনে একটি আন্তর্জাতিক কনসর্টিয়াম প্রতিষ্ঠা করা হোক। সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর জন্য ওপেক দেশসমূহ দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে এবং ওপেক তহবিল থেকে যে সাহায্য দিয়েছে সেজন্য আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। ১৯৮০-র জানুয়ারী পযর্ন্ত ওপেক তহবিল থেকে প্রদত্ত সাহায্যের পরিমাণ ছিল দুশো তেষট্টি মিলিয়ন ডলার। আমরা এই সহায়তার জন্যে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ এই জন্যে যে, তেল হচ্ছে এমন একটি সম্পদ যা দিন দিন নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে আর উন্নয়নকামী দেশ হিসাবে ওপেক দেশসমূহেরও নিজ নিজ অর্থনীতিকে গড়ে তোলার জন্যে এই তেল রাজস্বের পূর্ণ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা অপরিহর্য।

ওপেকভুক্ত কোন কোন দেশ উন্নয়নকামী দেশগুলোতে তাদের বিপুল আয়ের একটা অংশ বিনিয়োগে যে ক্রমবর্ধমান আগ্রহ দেখাচ্ছে তাকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। তৃতীয় বিশ্বে পেট্রো ডলার পুনর্বিনিয়োগের ব্যাপারে ফেডারেল জার্মান প্রজাতন্ত্র সরকারের প্রস্তাব এবং এ ধরনের অর্থ বিনিয়োগে ওপেক দেশগুলি যে ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে তা কমানোর জন্যে একটা আন্তর্জাতিক কার্যব্যবস্থা গ্রহণের প্রতি সমর্থন দানের যে প্রতিশ্রুতি ঐ সরকার করেছে, তা খুবই গঠনমূলক এবং সতর্কতার সঙ্গে তা বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে।
সবচেয়ে অনুন্নত দেশসমূহের ব্যাপারে এবং তাদের জন্যে বিশেষ দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমি এতক্ষণ যেসব কথা বললাম তার কারণ এই নয় যে উন্নয়নকামী বিশ্বের সামগ্রিক সমস্যাবলী থেকে দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া আমার উদ্দেশ্য বরং বহুক্ষেত্রে সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর চাহিদা ও প্রয়োজন যে আলাদা সেটাই প্রতিপন্ন করা। কাজেই আমাদের জন্যে প্রযোজ্য সমাধানও ভিন্ন হতে হবে- তবে একটি নতুন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনের প্রতি আমাদের আস্থা অবিচল রয়েছে। সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোকে সহায়তার লক্ষ্যে পরিচালিত বিভিন্ন কর্যক্রম ও বিশেষ প্রচেষ্টায় উন্নয়নকামী বিশ্বের অধিকতর সৌভাগ্যবান দেশগুলি যে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে সেজন্যে আমরা কৃতজ্ঞ। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, পূর্ব ও পশ্চিমের, উত্তর ও দক্ষিণের শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল সকল দেশের পক্ষ থেকে ক্রমবর্ধমান মাত্রায় এ ধরণের সাহায্য প্রদান অব্যাহত থাকবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মানব সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু নতুন নতুন ধারণা আমাদের সামনে এসেছে। এটা সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয়েছে যে বিশ্বের সীমিত সম্পদরাজির সংরক্ষণ অপরিহার্য। এ বিষয়েও আমরা সবাই একমত যে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্ষুধা আর দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে আমাদের অবশ্যই মুক্ত হতে হবে। দক্ষিণের উৎপন্ন পণ্যের ন্যায্য মূল্যের কথা ভিন্ন স্বর পরিলক্ষিত হয় না। এটা বাস্তবিকই আশার কথা যে বহু বছর ধরে দীর্ঘ ও কষ্টকর আলাপ-আলোচনার পর আমরা শেষ পর্যন্ত সাধারণ তহবিল গঠনে সমর্থ হয়েছি। আমাদের আশা-আকাংক্ষার তুলনায় এই তহবিল অনেক ছোট, তবু একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে কিছুটা বিলম্বিত হলেও একটি নতুন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

ব্রান্ডট কমিশনের রিপোর্টের প্রতি সমর্থন
তবু এখানেই থেমে গেলে চলবে না। এখন আমাদের জন্যে যেটা অপরিহর্য তা হল জ্বালানি শক্তি, বাণিজ্য শিল্প, অর্থ প্রতিষ্ঠান, কর্মসংস্থান, প্রযুক্তির হস্তান্তর, খাদ্য ও কৃষি এবং সম্পদ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে যেসব বাধা বিপত্তি আমাদের সামনে রয়েছে সেগুলো কাটিয়ে ওঠার পন্থা উদ্ভাবনের কাজে আত্মনিয়োগ করা। সম্পদের ব্যাপক হস্তান্তর ছাড়া দক্ষিণের বহু দেশ, বিশেষ করে সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলির পক্ষে দারিদ্রতার অভিশপ্ত আবর্ত থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব নয় বলে আমরা মনে করি। উন্নত দেশসমূহের পক্ষ থেকে সরকারী উন্নয়ন সহায়তার মাত্রা উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ছাড়াও আমরা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অস্ত্র ব্যয়ের উপর কর আরোপের ব্যবস্থা করে অর্থ সংগ্রহের একটি আন্তর্জাতিক পদ্ধতির বিষয় বিবেচনা করে দেখতে পারি। উত্তর ও দক্ষিণ-উভয় অংশের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর উপর কর ধার্যের বিষয়টিও বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে। বিপুল সংখ্যক বিদেশী নাগরিক, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশসমূহের লক্ষ লক্ষ লোক এখন বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় কর্মরত রয়েছে। সাধারণত তারা যে যেখানে কাজ করছেন শুধু সেই দেশের সরকারকেই আয়কর দিয়ে থাকেন। এই করের একটা অংশ এসব বিদেশী নাগরিকের নিজ নিজ দেশকে ফেরত দেয়া উচিত। বহু জাতি সংস্থাগুলোর উপরও বিশেষ কর ধার্যের ব্যবস্থা হতে পারে এবং সমুদ্রগর্ভ থেকে আহরিত খনিজ সম্পদের আয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশও দক্ষিণের জন্যে দেয়া উচিত। ব্রান্ডট কমিশনের রিপোর্টে একটি বিশ্ব উন্নয়ন তহবিল গঠনের যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তা আমরা পুরোপুরি সমর্থন করি। একটি নতুন বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ফলে কাঠামো ও পরিচালনার দিক দিয়ে যেসব পরিবর্তন সাধনের প্রয়োজন হবে তা উপযোগী করে জাতিসংঘ ও তার অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকে ব্যাপকভাবে পুনর্বিন্যস্ত করার কাজ হাতে নেয়াও সমীচীন হবে।

পরিশেষে, আমি সুনির্দিষ্ট কতগুলো ব্যবস্থা বাস্তবায়নের সুপারিশ করতে চাই। আমি মনে করি এগুলো দক্ষিণের বিশেষ করে এর দরিদ্রতম দেশগুলোর বর্তমান সমস্যাবলীর সমাধানে বিশেষ সহায়ক হবে। এগুলো হচ্ছে :

(১) একটি নতুন বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় উত্তরের জনমত সংগঠনের ব্যাপারে দক্ষিণ সম্ভাব্য সকল সহযোগিতার ব্যবস্থা করবে।

(২) পরিকল্পিত অর্থনীতিভিত্তিক দেশগুলোসহ সকল শিল্পোন্নত…., সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর প্রতি তাদের সরকারী উন্নয়ন সহায়তার পরিমাণ অবিলম্বে দ্বিগুণ করবে এবং এ ধরণের সব সহায়তা শর্তমুক্ত হবে।

(৩) ওপেক দেশসমূহ সবচেয়ে অনুন্নত দেশসমূহের জন্যে তেলের মূল্য শতকরা পঞ্চাশ ভাগ হ্রাসের ব্যবস্থা করবে।

(৪) সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলো জ্বলানি শক্তি সম্পদ উন্নয়নের জন্যে একটি আন্তর্জাতিক কনসর্টিয়াম গঠন করতে হবে।

(৫) ওপেক দেশগুলো, উন্নত দেশগুলোর সম্ভাব্য সহযোগিতায়, তাদের সম্পদের একটা অংশ উন্নয়নকামী দেশগুলোতে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করবে।

(৬) আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অস্ত্র ব্যয়ের ওপর কর আরোপের মাধ্যমে উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে সম্পদের ব্যাপক হস্তান্তরে ব্যবস্থা করতে হবে।

(৭) উত্তরের অর্থনীতিতে দক্ষিণের জনশক্তি বর্তমানে যে বাস্তব অবদান রাখছে, সেজন্যে উত্তরের এ ব্যাপারে দক্ষিণকে যথাযথ প্রতিদানের ব্যবস্থা করা উচিত।

(৮) বহুজাতি সংস্থাসমূহের ওপর বিশেষ করে ধার্য করা উচিত এবং দক্ষিণের দরিদ্র দেশগুলোর সাহায্যের জন্যে অতি ধনী দেশগুলোরও উচিত একটি বিশেষ কর দেয়া।

(৯) উন্নয়নকামী দেশসমূহের স্বার্থেই জাতিসংঘ এর অধীনস্থ বিভিন্ন বিশেষ সংস্থা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্ব ব্যাংককে সম্পূর্ণ পুনর্বিন্যস্ত করতে হবে। একই সঙ্গে সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর জন্য গৃহীত কর্মপন্থা কার্যক্রমের বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান গঠনেরও ব্যবস্থা নিতে হবে।

(১০) সার্বজনীন সদস্য পদের ব্যবস্থাসহ একটি বিশ্ব উন্নয়ন তহবিল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিশ্বব্যাপী কর আরোপের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ এই তহবিলে জমা হবে এবং এই অর্থের যথাযথ বরাদ্ধ ও ব্যবহার হবে এর দায়িত্ব।

আমাদের নিকট ও দূরবর্তী এলাকায় বিদেশী সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে উদ্ভূত অবনতিশীল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, নতুন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আজকে জাতীয় উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং আঞ্চলিক শান্তি ও সহযোগিতার জন্যে প্রচেষ্টা কেন্দ্রীভূত করার প্রয়োজন অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। এর প্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ সম্প্রতি দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির একটি শীর্ষ সম্মেলনের প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা দেখছি যে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে যখন আঞ্চলিক সহযোগিতার বাস্তব রূপ নিয়ে সাফল্যের পথে এগিয়ে যাচ্ছে তখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক পর্যায়ের সহযোগিতা গড়ে তোলার কোন আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানো হয়নি। আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হবে পরস্পর মিলিত হওয়া এবং এই অঞ্চলের সব দেশের পাস্পরিক স্বার্থে সহযোগিতার সম্ভাব্য ক্ষেত্রসমূহ খুঁজে বের করা। আমরা দেখেছি, বিশ্বের অন্যান্য অংশে কেমন করে এই আঞ্চলিক সহযোগিতা উত্তেজনা প্রশমনে এবং অভিন্ন স্বার্থে তাদের বিরোধী পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গী নমনীয় করে তুলতে সহায়ক হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় অনুরূপ উদ্যোগ গ্রহণের এইটাই হচ্ছে উপযুক্ত সময়।

আমার মনে হয়, আমি আমার হৃদয়ের বেদনা ও যন্ত্রণার অনুভূতি কিছুটা ব্যক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। আমার বিশ্বাস, এখানে উপস্থিত সম্মানিত প্রতিনিধিবৃন্দের অনেকেই অনুরূপ মর্মবেদনায় পীড়িত হচ্ছেন। আমি জনাব ব্রান্ডেটের কথারই পুনরাবৃত্তি করে বলতে পারি, আমাদের অভিন্ন ভবিষ্যত রচনার কাজটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে সেটা কেবল সরকার এবং বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দেয়া যায় না। কাজেই যুব ও নারী সমাজ. শ্রমিক আন্দোলন, রাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবি ও ধর্মীয় নেতৃবর্গ, বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ, কারিগর আর ব্যবস্থাপক এবং পল্লীসমাজ আর বণিক সম্প্রদায়ের সকলের প্রতি আমাদের আবেদন, তারা যেন এই নতুন চ্যালেঞ্জের আলোকে সমস্যার প্রকৃতি অনুধাবন করতে এবং সেই অনুযায়ী কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে সচেষ্ট হোন।

সমসাময়িক এই বিশ্বের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা আমাদের করতেই হবে। এই মুহূর্তে যেটা প্রয়োজন তা হল বলিষ্ঠ এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন কর্মপন্থা গ্রহণ। আমরা যদি পুরনো দিনের ধ্যান-ধারণা আর আদর্শকে আঁকড়ে ধরে থাকি, তাহলে সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে বিশ্ব সমাজের সর্বস্তরের জনগণের উন্নততর ও মহত্তর জীবনের জন্যে কাজ করে যেতে হবে। বিশ্বের সকল জাতি মিলিতভাবে এই লক্ষ্য অর্জনের উপযোগী যথেষ্ট সম্পদ ও কারিগরি জ্ঞানের অধিকারী সহযোগিতার পথ ধরে অগ্রসর হতে পারলে, এই লক্ষ্য, অনেকের ধারণার চাইতে আরো দ্রুত অর্জন সম্ভব। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে নিরাপত্তার কারণেই আমাদের উচিত এই পথ অবলম্বন করা। আমাদের আন্তরিক কামনা ও প্রার্থনা, আমরা যেন উপযুক্ত সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হই।

জনাব সভাপতি, আপনাকে ধন্যবাদ।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *