:: মুহাম্মাদ ওয়ালিদ আল হামিদী ::
জুমআর সালাতের প্রথম আযান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ছিল না। হযরত আবু বকর রাঃ ও হযরত উমর রাঃ এর খেলাফত কালেও ছিল না। অর্থাৎ তাদের সময়ে শুধুমাত্র একটি আযান দেয়া হত, আর সেটা খুতবা শুরুর প্রাক্কালে। এখন প্রশ্ন হল- তাহলে দুই আযান আসল কোথা থেকে?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পূর্বে আযান প্রবর্তন করেছিলেন মানুষকে সালাতের সময়ের ব্যাপারে সতর্ক করার জন্য। অর্থাৎ মানুষ যাতে এটা বুঝে যে, আযান হয়ে গেছে সুতরাং সালাতের সময় হয়ে গেছে, এখন মসজিদে যেতে হবে। মসজিদে না আসতে পারলে যেখানে সম্ভব সেখানে সালাত আদায় করতে হবে।
আর জুমআর দিনে খুতবা আরম্ভ করার পূর্বে একটি আযান দেয়ার বিধান প্রবর্তন করেছিলেন। সে সময় পর্যন্ত মুসলমানদের সংখ্যা খুউব বেশি ছিল না। জুমআর দিনে সবাই সালাতুল জুমআ এবং খুতবার জন্য মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়ে রাখতেন। আযান হলেই মসজিদ মুখী হয়ে যেতেন। এভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও শাইখাইন রাঃ এর সময়ে চলছিল।
হযরত ওমর রাঃ এর খেলাফত কালে ইসলামের সাম্রাজ্য অর্ধ পৃথিবী পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল। তাঁর শাহাদাতের পরে হযরত উসমান রাঃ খেলাফতের মসনদে সমাসীন হওয়ার পর এ বিজয়ের যাত্রা চলমান থাকে। বাড়তে থাকে ঈমানদারদের সংখ্যাও। জামে মসজিদের নিকটবর্তী এলাকাবাসী ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন। তখন দেখা গেল জুমআর দিনে খুতবা আরম্ভ হওয়ার পূর্ব মূহুর্তে আযান দেয়ার পর লোকজন তৈরী হয়ে মসজিদ পর্যন্ত আসতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে এবং জুমআ সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত খুতবা যথাযথ ভাবে শ্রবণ করতে সক্ষম হচ্ছেন না।
এমতাবস্থায়, ইসলামের তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান রাঃ জুমআর সালাত ও খুতবার ব্যাপারে মানুষদের সতর্ক করার জন্য খুতবা আরম্ভ হওয়ার পূর্বে দেয়া আযানের সময় থেকে আরো কিছু সময় পূর্বে আরেকটা আযান মদীনার অদূরে “যাওরা” নামক বাজারে দেয়ার বিধান জারী করেন। সে আযানের উদ্দেশ্য ছিল- যাতে করে লোকজন আযান শুনে অন্যান্য কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত করে মসজিদ মুখী হয়ে যায়। বুখারী, অবু দাউদ, নাসায়ী, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও সুনানে আহমাদে এই বর্ণনাটি এসেছে। এখান থেকেই জুমআর সালাত কেন্দ্রীক দুটি আযানের উৎপত্তি ঘটে।
পাঠক, জুমআর সালাতের প্রথম আযান কোথা থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে আশাকরি বুঝতে পেরেছেন। এবার এই আযানটির হুকুম সম্পর্কে আলোকপাত করছি-
তার আগে একটি প্রশ্ন। সেটা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং শাইখাইন রাঃ যা করেননি হযরত উসমান রাঃ কর্তৃক কি দ্বীনের কোনো বিধান সংযুক্ত করার অধিকার আছে? উত্তর পাওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি হাদীস শেয়ার করছি-
হযরত আবু নাজীহ রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- তোমাদের উপর দায়িত্ব হল আমার এবং সুপথ প্রাপ্ত আমার খুলাফায়ে রাশেদীন এর সুন্নাহ আঁকড়ে ধরা। (তিরমিযী) তাহলে বুঝা গেল হযরত উসমান রাঃ এল ক্ষমতা আছে ইসলামে নতুন কোনো বিধান সংযুক্ত করার।
শুধু তাই নয়, হযরত উসমান রাঃ আযানের বিধান জারী করার পর এটার উপর সাহাবায়ে কেরামের ইজমা হয়। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কেউ এর বিরোধিতা করেননি। সালাফের বক্তব্য হচ্ছে সাহাবায়ে কেরামের ইজমাকৃত আমল অবশ্যই বেদআত নয় বরং পালনীয়। ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মাজমুআতুল ফাতওয়া তাই বলে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে- শাইখ আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ ও শাইখ আব্দুর রহীম (বাঘের হাট) এটাকে বেদআত বলেছেন।
এবার এ আযানের ফিক্বহী হুকুম জানা প্রয়োজন। জুমআর সালাতের প্রথম আযান ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম সুফিয়ান ব্যতীত সকল ফুক্বাহার নিকট সুন্নাতে উসমান হিসেবে এটা সুন্নাহ মুস্তাহাব (سنة مستحبة) । আর তারা দুজনের মত হল এটা জায়েয। আর সম্মানিত শাইখ আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ সাহেব ও শাইখ আব্দুর রহীম সাহেবের মতে এটা বেদআত। তারা কিসের ভিত্তিতে কোন নিয়তে বলেছেন আল্লাহ ভাল জানেন। তারা একটা দলীল পেশ করেছেন, সেটা হচ্ছে – রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা করেননি তা বেদআত। অথচ সালফে সালেহীন সাহাবায়ে কেরামের শারিআহ সম্পৃক্ত কোনো কাজকে বেদআত বলেননি। বরং সাহাবায়ে কেরামের যুগ পর্যন্ত যে সকল শারয়ী আমলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি সেটাকে বেদআত বলেছেন।
সম্মানিত পাঠক, যে দুজন শাইখ জুমআর সালাতের প্রথম আযানকে বেদআত বলেছেন তাদের বক্তব্য যদি সঠিক হিসেবে গ্রহণ করতে হয় তাহলে এটা চালু করার কারণে হযরত উসমান রাঃ বেদআত করেছেন। উসমান রাঃ এর পুরো খেলাফতের সময় এটা চলমান ছিল। এটার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকায় তাঁকে বেদআতী বলতে হবে (নাউযুবিল্লাহ) । আর বেদআতের ঠিকানা জাহান্নাম। লা-হাউলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা-বিল্লাহ্ । এরা তো দেখছি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সরাসরি নির্দেশনা নেই এমন ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামকে শরিআহ’র মুওয়াফিক আমল সঠিকতার মানদণ্ড মানবে দূরের কথা উল্টো তাদের আমলকে বেদআত বলছেন।
তাওহীদের দেশ খ্যাত সৌদিআরবের পবিত্র ভূমি মক্কা মদীনা সহ আমার জানামতে এমন কোনো জামে মসজিদ নাই যেখানে জুমআর সালাত কেন্দ্রীক দুটি আজান হয় না। এখন এরা সবাইকি বেদআতী? ইয়া আল্লাহ! কী যে বলব! সিরিয়াস মোড নিয়ে বসছিলাম উত্তর লিখতে, কিন্তু এখন শুধু হাসি আসতেছে শাইখ দুজনের বক্তব্য শুনে। অনলাইন অফলাইন সব খুঁজলাম কিন্তু একজন সালাফের বক্তব্যও পেলাম না এটা বেদআত বলে।
যাইহোক, আমি এটা শাইখদ্বয়ের নিকট পৌঁছে দেয়ার জন্য লিখিনি। কারণ এই শাইখদ্বয় আমার মত ক্ষুদ্র মানুষের কথার প্রতি কর্ণপাত করবেন না। তারা বক্তব্য তাদের মত করেই দিয়ে যাবেন। তাই যারা আমার মত ক্ষুদ্র মানুষের স্ট্যাটাস গুলো পড়েন এবং বিশ্বাস রাখেন তাদেরকে সঠিক বিষয়টি অবগতির জন্য লিখা। এরপরও যদি কেউ তারা দুজন সম্মানিত আলেমের কাছে আমার এই কথাগুলো পৌঁছে দেন তবে আলহামদুলিল্লাহ।
সম্মানিত পাঠক! এবারের মত ইতি টানতে যাচ্ছি। আমি আমার এই স্ট্যাটাসটি কাউকে ছোট করে উপস্থাপনের জন্য লিখিনি। কাউকে ব্যঙ্গ করার জন্যও নয়। পূর্ব শত্রুতার জন্যও নয়। মানুষ আজকাল কিছুর বিরোধিতা করলে বুঝে হয়তো কোনো স্বার্থ আছে। আমার এমন কিছুই নেই। দ্বীনের সঠিক তথ্য প্রচারের জন্য লিখেছি। তারপরও কোনো ক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃত সীমা লঙ্ঘন হলে আল্লাহ যেন আমাকে ক্ষমা করেন। আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের সবাইকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের পথের উপর জীবন অতিবাহিত করান। আমীন।
মদীনা মুনাওয়ারা থেকে