:: ফাইজুস সালেহীন ::
বাংলা অভিধানে একটি শব্দ আছে- কুম্ভিলক। চোর, শ্যালক,শাল মাছ- এগুলো কুম্ভিলকের সমার্থক। এর আরও একটি অর্থ রয়েছে। তা জানার আগে সবিনয়ে অনুরোধ করবো, দয়া করে দুটো ‘অতি আলোকিত’ নাম মনে রাখুন; এক. ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল দুই.সামিয়া রহমান। কাজে লাগবে।
কথা হচ্ছিলো কুম্ভিলক প্রসঙ্গে। কুম্ভিলকের ইংরেজি প্রতিশব্দও রয়েছে অনেকগুলো। সবগুলো প্রতিশব্দের দরকার আমাদের নেই।আমরা নেবো প্লেজিয়ারিস্ট শব্দটি। প্লেজিয়ারিস্টের কঠিন বাংলা প্রতিশব্দ হলো কুম্ভিল বা কুম্ভিলক। আরও সহজ বাংলায় একে বলা যায় লেখাচোর। যে ব্যক্তি অন্যের কোনো লেখার ভাব-ভাবনা, ভাষা, স্টাইল ইত্যাদি নকল করে নিজের নামে চালিয়ে দেন , তিনিই প্লেজিয়ারিস্ট। এই ধরণের চৌর্যবৃত্তি কি অপরাধ?নিশ্চয়ই অপরাধ; এবং গুরুতর অপরাধ। এই কাজ অপহরণের শামিল। প্লেজিয়ারিস্ট শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ Plagiarius থেকে,যার আক্ষরিক অর্থ অপহরণকারী। তার মানে হলো, যিনি বা যারা অন্যের লেখা বা ভাব চুরি করে তারাও অপহরণকারী।তারা অন্য কারো বুদ্ধিবৃত্তিক প্রপার্টি অপহরণ করেন। বাংলা সাহিত্যের অনেক বড় বড় লেখক কবির বিরুদ্ধে বিদেশি লেখক কবির ভাবনা চুরির অভিযোগ রয়েছে, যদিও তা সুপ্রমাণিত নয়।
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ড. হাসিনা খান গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে স্বীকার করে নিয়েছেন বইটি লেখায় কপি করা হয়েছে।বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, এই বইয়ের কোনো কোনো অধ্যায়ের অংশবিশেষ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এডুকেশনাল সাইট থেকে নিয়ে হুবহু অনুবাদ করে ব্যবহার করা হয়েছে। বইয়ের এই নির্দিষ্ট অংশটুকু এবং ওয়েবসাইটটির একই লেখাটুকু তুলনা করে অভিযোগটি আমাদের কাছে সত্য বলেই প্রতীয়মান হয়েছে।’
অনুতাপ নেই,অনুশোচনা নেই, স্রেফ চালাকিপুর্ণ একটি বিবৃতি। চায়ের সাথে টায়ের মতো রয়েছে ঔদ্ধত্য। এমনভাবে তারা বক্তব্য দিয়েছেন, যাতে মনে হয় এই ইন্টেলেকচুয়াল প্রতারণার বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির মাথা তারা। এই সবিশেষ চালাকির জন্যে তারা হাততালি পেতে পারেন। আরও একবার করতালি তাদের পাওনা এই কারণে যে, তারা বাঙ্গালকে হাইকোর্ট দেখাবার একটা মজার ফিকশান তৈরি করেছেন এই অসাধারণ বিবৃতির মাধ্যমে।বইটির প্রধান ও দ্বিতীয় প্রধান লেখক সর্বোপরি খোদ সম্পাদক বলছেন যে, তারা পরীক্ষা করে দেখেছেন এবং অভিযোগটি তাদের কাছে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে।এই বিবৃতি পড়ে পাঠকের কুজ্ঝটিকায় পথ হারানোর সমূহ আশংকা। ড. হাসিনা খান সম্পর্কে তেমন কিছু বলবার নেই। কেননা তিনি বইটির একজন সহলেখকমাত্র।নকল অংশটুকু তিনি নাও লিখে থাকতে পারেন। ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালসহ বইয়ের অন্য চারজন লেখকের যে কেউ লিখে(চুরি করে) থাকতে পারেন। বইয়ের চুরিকরা অংশটুকু জাফর ইকবাল নিজেই লিখেননি, তারও কোনো প্রমাণ নেই !
জাফর ইকবাল সাহেব এই বইয়ের অন্যতম লেখকই কেবল নন, তিনি সম্পাদকও বটে। মাননীয় সম্পাদক ফেসবুক ট্রায়ালের মুখে নকল করা অংশ পরীক্ষা করে দেখলেন। বই ছাপিয়ে যখন ছেলেমেয়েদের হাতে পৌঁছে দেয়া হয়েছে, তখন তিনি গরজ অনুভব করলেন লেখা পরীক্ষা করে দেখার। হিংটিংছট!
সম্পাদক কাকে বলে , সম্পাদকের দায়িত্ব কী ,আশা করি বিদগ্ধ সম্পাদকদের চাইতেও তিনি বেশি জানেন, কারণ তিনিই তো বাঙলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলায় অটোগ্রাফ দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেন। তিনি তো সাধারণ কোনো মানুষ নন।ভরা যৌবনে ;তার বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে গর্তে লুকিয়ে থাকার অভিযোগ থাকলেও তিনি ছেলেমেয়েদের ‘এসো মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনি’ অনুষ্ঠান করতে পারেন সগৌরবে।তিনি সাধারণ কোনো মানুষ হলে এমনটি করতে পারতেন না। কেননা, লজ্জাই সাধারণ মানুষের ভূষণ, যেমন নারীর।কিন্তু উনার মত বিশাল বড় বুদ্ধিজীবী যারা তারা খুব ভালো করেই জানেন , লজ্জা, দ্বিধা, ভয়- এই তিন থাকতে নয়।তিনি কি জানেন না, একজন সম্পাদক; বইয়েরই হোন পত্রিকার হোন,তার প্রধান কাজই হচ্ছে , প্রিন্টার্স লাইন থেকে শুরু করে প্রতিটি লাইন পড়ে পরিমার্জন করা! প্রয়োজন দেখা দিলে তিনি লেখা সংশোধন করেন,সংশ্লিষ্ট লেখককে ডেকে রিকাস্ট করতে বলেন, ছাপার যোগ্য না হলে লেখা বাদও দিতে পারেন। সে এখতিয়ার সম্পাদকের রয়েছে। সম্পাদক ছাপা হওয়া প্রতিটি বাক্য ও শব্দের জন্যে দায়ী।বইয়ের কোনো লেখার বিরুদ্ধে মামলা হলে রীতি অনুযায়ী সম্পাদকেরই কাঠগড়ায় দাঁড়াবার কথা সবার আগে।সম্পাদক কোনো লেখা প্রেসে যাওয়ার পরও, যখন ছাপা চলতে থাকে, তখনও অনেক সময় ছাপা বন্ধ করে পরিবর্তণ-পরিবর্ধন করেন।সম্পাদকতা কোনো ঠিকাদারী কাজ নয়।বই ও পত্রিকার সম্পাদককে অষ্টপ্রহর সতর্ক থাকতে হয়।আর সেই সেলিব্রেটি সম্পাদক কি না, বই ছেলেমেয়েদের হাতে চলে যাওয়ার পরে নড়েচড়ে বসলেন।সাধারণ কেউ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে এমন কাজ করলে আমরা বলতে পারতাম, আরে সাহেব; সময় থাকতে আপনি কি ঘাস কাটছিলেন ? কিন্তু মুহাম্মদ জাফর ইকবালের মত বড় মাপের অসাধারণকে কি অত বড় কথা বলা যায়? যায় না তো। কাজেই বললাম না।
তিনি জনগণকে আস্বস্ত করে বিবৃতি দিয়ে এও বলেন যে, পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করা হবে। এ কথা তো বলবে বইয়ের প্রকাশক টেক্স্ট বুক বোর্ড কর্তৃপক্ষ। এমন তো নয় যে, এই সম্পাদক মহোদয় বইটির পাণ্ডুলিপি তৈরি করে ছেপে বের করার জন্যে প্রকাশক খুঁজছিলেন।আর টেকস্ট বুক বোর্ড একটা সংস্করণ পাবলিশ করার জন্যে পাণ্ডুলিপি কিনে নিয়েছে।জনগণের টাকায় টেকস্ট বুক বোর্ড বইটি প্রকাশ করেছে এবং বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে।লেখক ও সম্পাদক চুক্তি অনুযায়ী সম্মানী অথবা পারিশ্রমিক পেয়েছেন। বোর্ড কর্তৃপক্ষ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ নাও করতে পারেন, বইটি বাতিলও করে দিতে পারেন।তাহলে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল কেমন করে বলতে পারেন যে, পরবর্তী সংস্করণে ঠিকঠাক করা হবে! আর, ঠিকঠাক করা হলেও, এ বছরই তা হবে, এমনটি আশা করা যায় না। আগামি বছর বইটির পরিমার্জিত সংস্করণ বের হলেও, চলতি শিক্ষাবর্ষে যারা সেভেনে পড়ছে, তারা কি ক্লাশ সেভেনেই থেকে যাবে ? এ বছরের সেভেনের ছেলেমেয়েরা যে প্রতারিত হলো, তার কি হবে! আর নতুন সংস্করণ ছাপতে যে,বিপুল অংকের টাকা লাগবে, সেটা কে দেবে? গৌরি সেন!
গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমানের বিরুদ্ধে গবেষণাপত্র রচনা করতে কুম্ভিলকবৃত্তির অভিযোগ উঠেছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের তদন্তে সেই অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে সামিয়া রহমানকে ডিমোশান দিয়ে সহকারি অধ্যাপক বানানো হয়েছিলো। তবে,সামিয়ার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ উচ্চ আদালতে সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। ‘সামিয়ার আইনজীবী হাসান এমএস আজিম বলেন, ‘শিকাগো ইউনিভার্সিটি বা প্রেস থেকে সামিয়া রহমানের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোন অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আসেনি। অ্যালেক্ম মার্টিনের নামে সামিয়া রহমানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এসেছিল তা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ গবেষণাপত্রটি সামিয়া রহমান তৈরি করেননি এবং সেখানে তার সই ছিল না।’ [সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪ আগস্ট ২০২২]
পক্ষান্তরে জাফর ইকবাল নিজেই কুম্ভিলকবৃত্তির অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েছেন। আত্মস্বীকৃত কুম্ভিলক। তার সায়েন্স ফিকশানের বইয়ের অনেকগুলো সম্পর্কে বিদেশি বই থেকে কাহিনী চুরির অভিযোগ রয়েছে। সে সবেরই বা কী ব্যাখ্যা?
লেখক: সাংবাদিক