:: ফেনী বুলবুল ::
আমার জীবনে সবচেয়ে টেনশনের একটি রাত ছিল যেদিন আমার নানা আমাকে সাথে করে বিয়ে করতে গেলেন সেই রাতটি। সেদিন রাতে কনে পক্ষ আমাদের দুজনকে গভীর রাত পর্যন্ত তাদের কাচারি ঘরে বসিয়ে রাখলো, তাদের একটিই কথা জামাই ( আমার আব্বা) না আসলে বিয়ে হবে না আবার আমাদেরকে ফেরত যেতেও দিবে না।
আমার নানুর মৃত্যুর পর সত্তুরোর্ধ্ব বয়সের নানা হজ্জ্বে যাবেন বলে ঠিক করেন এবং সে হিসাবে টাকা পয়সা জমা করে তিনি হজ্জ্বের প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। এরই মধ্যে কিছু দুষ্টু প্রকৃতির লোক নানার পিছনে লাগলো। তারা নানাকে বিভিন্ন ভাবে পটায়ে বোঝাতে সক্ষম হয় যে কন্যা দায়গ্রস্ত পিতার কন্যা বিয়ে করলে ডাবল হজ্জ্বের সোওয়াব পাওয়া যায়। ব্যাস নানা হজ্জ্বের টাকা উঠায়ে ফেললেন এবং কন্যা দায়গ্রস্ত পিতার কন্যা পাত্রী খোঁজ শুরু করলেন। কিন্তু নানা জানতেন না ঐ দুষ্টু লোকেরা তাদের নির্দিষ্ট করা পাত্রীর জন্যই নানাকে নিয়ে এই মিশনে নেমেছে।ঐ চক্র তাদের পাত্রী দেখাতে নিয়ে গিয়ে ট্যাকনিক্যালি সেখানে বিয়ের পাকা কথা আদায় করে নেয়।
নানার বিয়ে করা নিয়ে আম্মা আব্বার কোন দ্বিমত ছিলো না।নানার একাকিত্ব নিয়ে তারাও চিন্তিত ছিলেন, যদিও নানা নানুকে মৃত্যুশয্যায় জানিয়েছিলেন তিনি আর বিয়ে করবেন না। কিন্তু আব্বার সাথে নানার সমস্যা হলো হজ্জ্ব না করে দুষ্টুচক্রের ফাঁদে পা দেয়া এবং তাদের নির্ধারিত পাত্রী বিয়ে করা নিয়ে। পাত্রী অল্প বয়সী তালাকপ্রাপ্ত এক নারী, তার স্কুল পড়ুয়া একটা মেয়েও আছে। বিয়ার দিন তারিখ ঠিক করে দুইদিন আগে নানা এসে আমাদের বাড়ি শুয়ে আছেন মেয়ে-জামাই-নাতিদেরকে নিয়ে যেতে। আব্বা মেজাজী মানুষ তাই আম্মা প্রাণপন চেষ্টা করছেন আব্বাকে ঠান্ডা রাখতে। আম্মা আব্বাকে বোঝালেন নানার যে অবস্থা তাতে আমরা না গেলেও তিনি বিয়ে করবেনই, তাতে লোকজন ভাববে আমরা স্বার্থপর এবং লোভী তাই যাচ্ছিনা। যাহোক অবশেষে আব্বা বললেন তোমরা যাও আমি যাবোনা, আর বিয়ে শেষ হওয়া মাত্র বাড়ি ফিরে আসবা।আমরা নানার সাথে নানার বাড়ি চলে এলাম। বিয়েরদিন দুপুরে আমার নানা পুকুরে গোসল করার সময় আমাকেও গোসল করালেন। আম্মার ভালোমন্দ রান্না করা খাবার আমরা সবাই মিলে খেলাম।নানা পায়জামা পান্জাবী পরে রিক্সা ডেকে আনলেন। তারপর নানা তার ভাইদের মানে আমার অন্য নানাদের ডাকতে গেলেন কিন্তু কেউ কোন সাড়া না দেয়ায় নানা তার আগে থেকে গুছানো সুটকেস নিয়ে এবং একমাত্র বরযাত্রী হিসাবে আমাকে সাথে নিয়ে বীরদর্পে রিক্সায় করে বিয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলেন।আমরা যখন কনের বাড়ি পৌঁছালাম তখন দু-চারজন লোক এগিয়ে এসে আমাদেরকে কাচারিঘর জাতীয় একটা ঘরে বসালো। আমরা অনেকক্ষণ বসার পর কয়েকজন লোক এসে কাচারিতে ঢুকলো মুলত: তারাই ছিল সকল কারসাজির মুলে। তাদের কানাকানি এবং আলাপচারিতায় যেটা বুঝলাম সেটা হলো দুলাহ মিয়ার সাথে তার ভাইদের কেউ কিংবা বাড়ির কেউ আসলোনা কেন সেটা নিয়ে কোন ঝামেলা হচ্ছে। অপেক্ষা করতে করতে রাত হয়ে গেল কোন সমাধান হচ্ছেনা। রাতে কোন একসময় ঐ এলাকার এক মাতবর ধরনের মুরুব্বি মানুষ এলেন, তিনি নানাকে বললেন আপনার মেয়ে জামাই কি জানেন আপনি এখানে শাদী করতে এসেছেন ? নানা উত্তর দিলেন -জানে। মুরুব্বী জিজ্ঞাস করলেন তাহলে তিনি আসেননি কেন ? এইবার নানা নিরুত্তর।ঐ মুরুব্বী আব্বার নাম ধরে বললেন- …মিয়া না আসা পর্যন্ত যেন বিয়ে না হয়। আমি নানাকে নিয়ে ভীষন টেনশনে পড়ে গেলাম না জানি নানার শেষ পর্যন্ত বিয়েই না হয়।এরই মাঝে নানা একবার মোচড় দিয়ে বসলেন বিয়ে না করেই ফেরত চলে আসবেন। এই কথা শুনে মেয়ে পক্ষের লোকজন কাচারিতে পাহারা বসালো আমরা যেন পালাতে না পারি। সম্ভবত: ঐ মুরুব্বী পরিস্থিতি জানিয়ে কাউকে আব্বার কাছে পাঠিয়েছিলেন। রাত প্রায় দুইটার সময় একটা রিক্সা নিয়ে আব্বা এলেন। সবাই দেখলাম আব্বাকে বেশ সমিহ করছেন। এলাকার ঐ মাতবর ধরনের মুরুব্বীর সাথে দেখলাম আব্বার বেশ ঘনিষ্ঠতা আছে। আব্বা ঐ মুরুব্বীসহ আরো দু-একজনের সাথে কথাবার্তা বলে ঠিক করলেন একটা শর্তে বিয়ে হবে সেটা হলো পাত্রীর স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে আপাতত মায়ের সাথে নিতে পারবেনা। সেটা মেয়ের আসল বাবার সাথে আলাপ করে পরে ঠিক করা হবে। নানা এবং পাত্রী পক্ষ উভয়েই আব্বার শর্তে রাজী হয়ে গেল।পূর্ব থেকেই কাজী মজুদ রাখায় তাৎক্ষনিকই বিয়ে পড়ানো হলো। বিয়ে পড়ানোর সাথে সাথেই আব্বা রিক্সায় উঠে চলে গেলেন।আর সিদ্ধান্ত হলো আমরা বৌ নিয়ে সকালে রওয়ানা হবো। সকাল বেলায় আমরা বৌ নিয়ে চলে আসলাম। আম্মা নতুন নানীকে বরন করে নিলেন। সারাদিন নতুন নানুকে সবকিছু বুঝায়ে দিয়ে সন্ধ্যার দিকে আমরা আমাদের বাড়ি ফিরে এলাম। আমরা বাড়ি ফিরে আসার দুই দিনের মাথায় আব্বা ভয়ংকরভাবে উত্তেজিত হয়ে আম্মাকে বললো আজ থেকে তোমার বাপের বাড়ি শেষ, আর কখনোই ঐ বাড়ি যাওয়ার কথা মুখে আনবে না। আম্মা ভ্যাবাচেকা খেয়ে জানতে চাইলেন আবার কি হয়েছে। আব্বা যেটা জানালো সেটা হলো নানা আব্বার দেয়া শর্ত ভঙ্গ করে নতুন নানুর স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে তাদের বাড়ি নিয়ে এসেছেন। সেদিন থেকে আমাদের নানার বাড়ি বন্ধ হয়ে গেল। এরই মাঝে আমার নানার বছর বছর বাচ্চা হতে লাগলো। চার বছরে তিন বাচ্চা প্রথম এবং ছোটটা ছেলে মেঝটা মেয়ে। মাশাআল্লাহ নানার তিনটা বাচ্চাই যেন নানার ফটোকপি।
আমাদের নানার বাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলেও নানা আগের মতোই নির্দিষ্ট সময় পরপর আমাদের বাড়ি আসেন, তবে নানাকে এখন খুব অস্থির দেখায়।আম্মার সাথে কথা বলার সময় সুযোগ বুঝেই নানা বলতেন আম্মার নামে দেয়া জায়গা জমিগুলো নানাকে ফেরত দিতে। আম্মার এক উত্তর সময় হলে দেখা যাবে। এখানে বলে রাখা ভালো যে আমার নানু মৃত্যুশয্যায় থাকা অবস্থায় একদিন নানাকে কাছে ডেকে বসায়ে নানার হাত নিজের হাতে ধরে জিজ্ঞাস করেন নানু মারা গেলে নানা আবার বিয়ে করবেন কিনা। নানা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে না করেন। নানু আবারও নানাকে বলেন আপনি আমাকে খুশি করার জন্য বলবেন না, আপনার মন থেকে বলেন আমি কিছুই মনে করবোনা। নানা আবারও জানান তিনি এই বয়সে আর কিসের বিয়ে করবেন। তখন নানু নানাকে বলেন – তাহলে আমাদের জায়গা সম্পত্তি যা আছে সবটুকু আমার মেয়ের নামে করে দিন, আমরা দুজন মারা গেলেও যেন এই সম্পত্তি আমার মেয়ে ছাড়া আর কেউ না পায়। নানা তখন হাসতে হাসতে বললেন আমি দুই একদিনের ভিতরই সব আমার মেয়ের নামে দিয়ে দিচ্ছি তুমি কোন চিন্তা করোনা। এইসব শুনে আব্বা নানাকে বেশ করে না করলেন। কিন্তু নানা আব্বার নিষেধ কোনভাবেই শুনলেন না। তিনিও নানুর মতো আশংকায় ছিলেন তিনি মারা গেলে তার সব সম্পত্তি তার ভাইয়ের ছেলেরা পেয়ে যাবে। যেই কথা সেই কাজ নানা খুশি মনেই সমস্ত জায়গা জমি এমন কি ঘর ভিটা বাড়িও আম্মার নামে দিয়ে দিলেন।
নানার এখন অনেক বড় সংসার, নিজের তিন বাচ্চা নানুর আগের সংসারের মেয়ে তাছাড়া নানার শাশুড়ি শালা শালার-বৌ এখন নানার ঘাড়ে। নানার বয়স আরো বেড়েছে, সেবার হাটের দোকানও বিক্রি করে দিতে হয়েছে রুজি রোজগার বন্ধ, শুধু খরচ আর খরচ নানা দিশেহারা। জায়গা জমি যেহেতু আম্মার নামে তাই বিক্রিও করতে পারছেন না, অন্যদিকে আম্মাও ফেরত দিবেন না। আম্মার আশংকা নানার নামে ফেরত দিলে অমিতব্যয়ি নানুর পাল্লায় পড়ে নানা ভিটে বাড়ি সব বিক্রি করে দিবে তাতে নানার ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যত আরো ঝুঁকিতে পড়বে। কিন্তু নানারতো খরচ জোগাতে হবে তাই তিনি জমি বন্ধক দেয়া শুরু করলেন। বন্ধকের টাকা বাড়িয়ে নিতে নিতে জমির মুলদামেরও বেশি নিয়ে নিলেন অনেকের কাছ থেকে। নানা দৌড়ে দৌড়ে আম্মার কাছে আসেন, জায়গা জমি তাকে ফেরত দিতে বলেন। নানার কথা শুনে নানাকে উদভ্রান্ত দেখে আম্মা আঁচলে চোখ মুছেন। নানা যাওয়ার পরও লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন। আম্মার এইসব আব্বার চোখ এড়াতো না তাই আব্বা আম্মাকে বুঝায়ে বললেন জমিগুলো নানার নামে ফেরত দিয়ে দিতে। কিন্তু আম্মা তার ভাইদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নানার নামে ফেরত না দেয়ার সিদ্ধান্তে অনঢ় থাকলেন। নানার বয়স আশি ছাড়িয়ে গেল চোখে দেখেন না খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটেন, হৈচৈ করা মানুষটি হঠাৎ করে একেবারে শান্ত হয়ে গেলেন।
নানা সবসময় আমাদের বাড়ি আসতেন সন্ধ্যার দিকে, রাতে থেকে সকালে নাস্তা খেয়ে চলে যেতেন। শেষবার এক ভরদুপুরে চলে আসলেন নানা, দরদর করে ঘামছিলেন। আম্মাতো নানাকে দেখে অস্থির, জিজ্ঞাসা করলেন এইসময় কোথায় থেকে আসলেন ? এত ঘামছেন কেন? সকালে কিছু খান নাই ? অস্থির আম্মা শুধু প্রশ্ন করেই যাচ্ছিলেন। নানা খুব শান্ত স্বরে বললেন তুমি অস্থির হয়ো না মা আমি ঠিক আছি, গজারিয়া থেকে হেঁটে এসেছিতো তাই ঘেমে গেছি। গজারিয়া হলো আমার মৃত নানুর বাপের বাড়ি মানে নানার প্রথম শ্বশুর বাড়ি। তারপর বললেন আর বেশিদিন হয়তো বাঁচবো না তাই দেখা করে এলাম। এদিকে আম্মা লেবুর শরবত বানায়ে নানাকে খেতে দিয়ে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকলেন। দুপুরে ভাত খেতে বসে নানা আম্মাকে বললেন তুমি মা মাঠের জমিগুলো নিয়ো ঘর ভিটাটা তোমার ভাইদের দিয়ে দিও। আম্মা বললেন আমার নামে থাকলেও মাঠের বাড়ির সবই আমার ভাইদের থাকবে, আপনি চিন্তা করবেন না। নানা বললেন আমি জানি তবু মনে আসে বলি। আসলে আম্মার প্রতি ছিল নানার অগাধ ভালবাসা বিশ্বাস। রাস্তা ঘাটে হাট বাজারে মানুষ নানাকে খোঁচা দিয়ে বলতো সবতো মেয়েকে দিয়ে দিলেন এখন ছেলেরা কি করবে। এইসব শুনে শুনে আর অসময়ে অপরিকল্পিত সংসারের ভারে নানা সব সময়ে অস্থিরতায় ভূগতেন। নানা কেবলমাত্র তার মেয়ে মানে আম্মার সামনে এলেই স্থির শান্ত হয়ে যেতেন। কত আদর কত মায়া কত মমতা তার চোখে মুখে কথায় ঝরে পড়তো তার সাক্ষী আমরা।
এক কোরবানীর ঈদের পরপরই নানা অসুস্থ্যবোধ করছিলেন, ছোট মামাকে বললেন তোমার আপা-কে খবর দাও। আম্মা ছোট মামার সাথে নানার বাড়ি ছুটে গেলেন। আব্বা আমাদের নানার বাড়ি যাওয়া চীরতরে বন্ধ করার পর কিভাবে তা আবার ঠিক হলো সেটা বলবো গল্পের শেষে।আম্মা গিয়ে দেখেন নানা বিছানায় শুয়ে আছেন, নানার পাশে বসে গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে আম্মা নানুকে জিজ্ঞাস করলেন কি হয়েছে। নানু যেটা বললেন সেটা হলো ঈদের দিন কেন জানি অনেক গোশত খেলেন, কারো মানা শুনলেন না।পরে অসুস্থ্যবোধ করলে নিজেই ডাক্তারের কাছে গিয়ে ঔষধ নিয়ে আসলেন।আম্মা নানার মাথায় কপালে হাত বুলায়ে বললেন ভালো হয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ। নানা বললেন মা তোমার হাতে এক গ্লাস পানি খাওয়াও। আম্মা নানার মাথাটা একটু তুলে পানি খাওয়ানোর সময় নানা হাত দিয়ে আম্মার হাত ধরলেন। আম্মা দেখলেন নানার হাতের নখগুলো বেশ বড় হয়ে আছে তাই নানুকে নেইল কার্টারটা দিতে বললেন। আম্মা নানার দুই হাতের নখ কাটলেন এর পর পায়ের নখ কাটার সময় খেয়াল করলেন নানা আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। আম্মা জিজ্ঞাস করলেন ব্যাথা পাচ্ছেন কিনা, নানা মাথা দুলিয়ে না বললেন। শেষ পায়ের নখ কাটতে গিয়ে আম্মার মনে হলো আঙ্গুলগুলো কেমন যেন হঠাৎ সোজা হয়ে গেল। আম্মা নানাকে আবার জিজ্ঞাসা করলেন ব্যাথা পেলো কিনা কিন্ত নানা নিরুত্তর, আম্মা নানার মুখ ছুয়ে বিদ্যুতের শক খাওয়ার মতো করে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। আমার অস্থির নানা খুব স্থির শান্তভাবেই ইন্তেকাল করলেন।
এতক্ষণ যে নানা নানুর কথা বললাম, আমার আম্মা এই নানার ঔরসজাত এবং নানুর জঠরের সন্তান নয়।আমার নানারা পাঁচ ভাই, আমার আম্মারা চার বোন এক ভাই সবাই বড়জনের সন্তান। আমার মেঝ নানা নানু ছিলেন নি:সন্তান দম্পতি।নানাদের যৌথ পরিবার ছিল তাই অন্য নানাদের সন্তান সন্ততি নিয়ে তাদের ভালোই দিন কাটছিলো। কিন্তু সমস্যা হলো যখন তারা আলাদা হয়ে গেলেন। আলাদা হওয়ার পর আমার মেঝ নানু আমার আম্মাকে তার মেয়ে বানিয়ে তার কাছে রাখতে চাইলেন। কিন্তু আমার নানা নানু মানে আম্মার বাবা মা কোনভাবেই তাতে রাজী নয়। আমার মেঝ নানার আকুতি মিনতিতে আমার নানা এক সময় নানুকে বোঝালেন পাশাপাশি ঘর আমার ভাই আর ভাইয়ের বৌ যদি আমাদের মেয়েকে তাদের কাছে রেখে খুশি থাকে অসুবিধা কি, মেয়েতো আমাদের কাছেই থাকবে।কিন্তু আমার নানু কোনভাবেই রাজি নয়। আমার ছোট খালার বয়স ১ বছর থাকতেই আমার নানু মারা যান। তখনই আমার মেঝ নানু আমার আম্মাকে তার কাছে নিয়ে যান। এইভাবেই আমার আম্মা তার বাবা মা বাদ দিয়ে মেঝ নানা নানুর একমাত্র সন্তান হয়ে গেলেন। আম্মা তার মেঝ চাচীকে আম্মা বলে ডাকলেও চাচাকে কিন্তু চাচা বলেই ডাকতেন। আমার নানারা রেঙ্গুন কলিকাতা করাচী চাকুরী করতেন। খুব আদর সোহাগে রাজকন্যার মতোই আমার আম্মা বেড়ে উঠলেন। একসময় অনেক জাঁকজমকপূর্ণতায় আমার আম্মাকে বিয়ে দিলেন।
আমার নানা নানু তাদের মেয়ে ও মেয়ে জামাইয়ের আদরে সদাইব্যাকুল। জামাই মেয়ের সকল সুবিধা অসুবিধা নিয়ে সজাগ সচেতন। খুব আনন্দঘনভাবে কাটছে তাদের দিনগুলো। আমার প্রথম ভাই জন্মগ্রহন করলে আমার এই নানা নানুর খুশিতে জোয়ার আসে। কিন্তু আমার আব্বা আম্মা এবং নানা নানুর সুখের আকাশে নেমে আসে কালো মেঘ, মাত্র ১১ দিনের মাথায় আমার বড়ভাই মারা যান।এরপর আমার বর্তমান বড়ভাই এবং আমার জন্মের সময় এবং জন্ম পরবর্তি সময়গুলোতে আমার নানু ছিলেন সদাসতর্ক। আমার মা এবং আমাদের দেখবাল করা যত্ন করায় রাখেননি এতটুকু ত্রুটি। এক এক ভাইয়ের জন্মের পরপর দুধের গাভী কিনে পাঠিয়ে দিয়েছেন। জামা কাপড় কাঁথা বালিশ থেকে শুরু করে দুধ খাওয়ার ফিডার পর্যন্ত নানা কলিকাতা থেকে নিয়ে আসলেন। আমাদের ঘরের বেশিরভাগ তৈজসপত্রও ছিল নানার কলিকাতা থেকে আনা। নানা নানুর আবদার মিটাতে গিয়ে আমাদের ছোটবেলার বেশিরভাগ সময়ই আমরা নানার বাড়ি কাটাতে হয়েছে। রাতে জাগিয়ে জাগিয়ে পেশাব করানো থেকে শুরু করে সকালে পটি করানোর সকল কাজই নানা করতেন। পটি করতে বসায়ে পটি করার দোয়া শিখাতেন। খাওয়ানোর সময় নানু খাওয়ার দোয়া শিখাতেন। এইভাবে ছোট বেলায়ই নানা নানু আমাদেরকে দোয়া কলেমা সুরা শিখায়ে দিয়েছেন।আমরা জন্মের পর বুঝ জ্ঞান হওয়ার সময় থেকে আমার এই মেঝ নানা নানুই আমাদের নানা নানু। আমরা সর্বদাই এই নানা নানুর আদরে স্নাত ছিলাম।গাছের ফলফলাদি থেকে শুরু করে যেকোন কিছু মেয়ে-জামাই- নাতিদের না খাওয়ায়ে খেতেন না। নানা বাজার থেকে তরমুজ কিনে আনলে নানু সেই তরমুজ একটু কেটে ভিতরে চিনি ঢুকিয়ে পানি রাখার মাটির কলস সরিয়ে কলস রাখার জায়গায় রাখতেন তরমুজ ঠান্ডা হওয়ার জন্য। দুধ জ্বাল দিয়ে সর বসাতেন আমাদেরকে খাওয়ানোর জন্য, অতিরিক্ত সর ছিকায় তুলে রাখতেন ঘি বানানোর জন্য। বড় হয়ে আব্বার কাছে শুনেছি আব্বা জামা খুলে রাখলে কোন এক ফাঁকে আব্বার জামার পকেটে নানু টাকা রেখে দিতেন। একবার আব্বার পকেটে খুবই অল্প টাকা ছিল কিন্তু তিনি বাহিরে এসে দেখলেন পকেটে অনেক টাকা তিনি ঘরে ফিরে আম্মাকে টাকার কথা জানালেন এবং ফেরত দিলেন। আম্মা তদন্ত করে জানতে পারলেন নানুই এই কাজ করতো।আমার নানা নানুর পৃথিবীটাই ছিল মেয়ে-জামাই-নাতিদ্বয়। নানা নানুর নি:সন্তান হওয়ার মনোবেদনা তাদের মন থেকে একেবারেই ধুয়ে মুছে গেল। না বলে দিলে বহিরাগত কারো বুঝার এতটুকু সুযোগ নেই যে আমার আম্মা নানার ঔরসজাত এবং নানুর জঠরের সন্তান নয়। নানু আমার আম্মাকে কখনো ‘মা’ ছাড়া অন্য নামে ডাকতেন না। নানা নানুর এমন সুখ দেখে আমার অন্য নানা নানুরাও বেশ খুশি ছিলেন। আমার নানা নানু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। আমরা দুই ভাই নানা নানুর সাথে ঘুমাতাম তাই টের পেতাম তারা গভীর রাতে উঠেও নামাজ পড়তেন, নামাজ শেষে এসে আমাদের গায়ে ফুঁ দিতেন। নানা নামাজের চকিতে বসে জিকির করতেন। গরমকালে নানা ঘুমানোর সময় আমাদের দুই ভাইকে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতেন, বাতাস করতে করতে ঘুমের মধ্যেও নানার হাতপাখা ঘুরানোর অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। ঘুম পাড়ানোর জন্য কলিকাতা বোম্বাই রেঙ্গুনের অনেক গল্প শুনাতেন। নানু তার বাবার বাড়ি গেলে আমাদেরকেও সেখানে নিয়ে যেতেন। ঐ বাড়ির লোকজনরাও আমাদের খুউব খাতির যত্ন করতেন। যে কেউ আমার নানা নানুকে খুশি করার একটাই পথ ছিল আর সেটা ছিল তাদের মেয়ে-জামাই-নাতিদের আদর যত্ন করা। নানা নানুর মেয়ে-জামাই-নাতি নিয়ে এত বাড়াবাড়ি হয়তো বিধাতার পছন্দ হলো না। হঠাৎ করে আমার নানু অসুস্থ হয়ে পড়লেন।নানাতো পাগলের মতো হয়ে গেলেন। ডাক্তার কবিরাজ দেখালেন, মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে গেলেন কিন্তু কোনভাবেই নানুর রোগ নির্নয় করা যাচ্ছিলো না। নানুর শরীর দিনদিন আরো খারাপ হতে থাকলো। নানা আর আম্মা সারাক্ষণ লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না করতে থাকলেন। আমরা ছোট ছোট দুইভাই কিছু না বুঝে নানুর পাশে বসে থাকতাম। নানু আমাদের দুই ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন আর নানুর দুচোখ দিয়ে নীরবে পানি গড়িয়ে পড়তো। নানা নানুকে চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম নিয়ে গেলেন। রোগ ধরা পড়লো, নানুর টিবি রোগ হয়েছে মানে যক্ষারোগ এবং সেটা এক্সট্রিম লেভেলে। অনেকদিন চিকিৎসার পর নানুকে বাড়ি নিয়ে আসলো। আসলে নানুর আর চিকিৎসা হবেনা বলেই ডাক্তাররা তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন যক্ষারোগের কোন চিকিৎসা ছিলোনা। নানুকে আনার পর দেখলাম নানু একদম শুকিয়ে গেছেন শুধু পেটটা ফুলে আছে। যক্ষার ইনফেকশনটা নানুর পেটের অন্ত্রে হয়েছিল। নানুকে যে খাটে শোয়ানো হলো সেটাকে মশারি দিয়ে ঢেকে রাখা হলো। নানু কাউকে তার কাছে যেতে দিতেন না। কিন্তু আম্মা নানুর কোন বাঁধা নিষেধ শুনতেন না। আম্মা দিনরাত কাঁদেন, নানু আম্মাকেও সান্ত্বনা দিতেন আর বলতেন কেঁদোনা মা আল্লাহ যা করেন তা বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন। অন্যদিকে নানা দিনরাত মসজিদে পড়ে থেকে আল্লাহর কাছে কাঁদতেন আবার পাগলের মতো ছুটে এসে নানুকে দেখতেন আর জিজ্ঞাস করতেন নানুর কোন কষ্ট হচ্ছে কিনা। নানু নিজের কষ্ট সহ্য করে নানার চোখ মুছে দিয়ে হাসতে হাসতে বলতেন- না আমার কোন কষ্ট হচ্ছে না, কিন্তু আপনি কাঁদলে আমার কষ্ট হবে, আপনি আর কাঁদবেন না। আমার মেয়েকে আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি আমাকে কথা দেন আমি না থাকলেও আমার মেয়ে জামাই নাতিদের আপনি অবহেলা করবেন না।
একদিন নানু আমাদের দুই ভাইকে দেখতে চাইলেন, খেলা থেকে আমাদেরকে ডেকে আনা হলো ।দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড় করালো তারপর নানুর মশারি সরিয়ে দেয়া হলো, নানু মাথাটা একটু কাত হয়ে আমাদের দুভাইয়ের দিকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত চেয়েই থাকলেন। তারপর আমরা আবার খেলতে চলে গেলে হঠাৎ চিৎকার কান্নাকাটির শব্দ শুনে দৌড়ে এসে দেখলাম আমার আম্মা নানুর পাশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে নানা ননুর পাশে বসে গোঙাচ্ছে আব্বা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আমার কলিজার টুকরা নানুর মুখসহ সারাশরীর একটা বিছানা চাদর দিয়ে ঢেকে ফেলেছে।
দীর্ঘ অনেক বছর আব্বা যখন আমাদেরকে নানার বাড়ি নিষিদ্ধ রেখেছেন তখন আমার খালারা বিভিন্ন ভাবে আব্বাকে বুঝিয়ে চেয়েছেন আম্মাকে নানার বাড়ি নিতে কিন্তু আব্বা অনঢ় থাকলেন। শেষে আমার নানা মানে আম্মার নিজ বাবা যখন আব্বাকে বললেন ঠিক আছে আমি আমার মেয়েকে আমার ভাইয়ের কাছ থেকে ফেরত নিলাম এখন থেকে ও আমার কাছে আমার ঘরে যাবে। এরপর আব্বা চুপ করে গেলেন এবং তার চেহারাটা বিষাদে ভরে গেল। কি জানি হয়তো নানা তার মেয়ে ফেরত নেয়ার কথা বলাতে আমার আব্বার চোখে আমাদের কলিজার টুকরা নানু ভেসে উঠেছে। সেইদিন থেকে আমাদের নানা বাড়ি যাওয়ায় আর কোন বিধিনিষেধ থাকলো না।