:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::
রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বুধবার রাতে বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তিনি। দুর্ঘটনার সময় তাঁর সঙ্গে আরও ৯ সহযোগী ছিলেন বলে জানা গেছে।
মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ যাওয়ার পথে প্রিগোশিনকে বহনকারী বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। এমব্রেয়ার লিগ্যাসি-৬০০ বিজনেস জেটটির সব আরোহী নিহত হয়েছেন। বিমানটি কী কারণে বিধ্বস্ত হয়েছে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে অনেকেরই সন্দেহ এর পেছনে অন্তর্ঘাতমূলক বিষয় থাকতে পারে।
প্রিগোশিন হত্যার শিকার হয়েছেন বলেও ধারণা করা হচ্ছে। ৬২ বছর বয়সী প্রিগোশিন ঠিক দুই মাস আগে রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে একটি অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সঙ্গীদের নিয়ে পরে তাঁর মস্কো যাত্রা ব্যর্থ হয়। এ অবস্থায় তাঁকে সতর্ক করা হয়েছিল যে—তাঁর জীবন হুমকির মধ্যে রয়েছে।
ভাগনারের সঙ্গে যুক্ত একটি সূত্র দাবি করেছে, প্রিগোশিনকে বহন করা বিমানটিকে গুলি করে বিধ্বস্ত করা হয়েছে। তবে এটি এখনো নিশ্চিত করা যায়নি।
ভাগনার সংশ্লিষ্ট একটি সংবাদমাধ্যমে বলা হয়, মস্কোর দক্ষিণে বিমান বাহিনীর গোলায় ওই বিমান বিধ্বস্ত হয়।
ভাগনার সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যম ‘গ্রে জোন’র বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, স্থানীয়রা দুটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পায়। তারা দুটি ধোয়ার কুণ্ডুলি দেখতে পান।
রাশিয়ার সংবাদ সংস্থা ‘তাস’র বরাত দিয়ে বলা হয়, মাটিতে বিধ্বস্ত হওয়ার পর উড়োজাহাজটিতে আগুন ধরে যায়। ইতিমধ্যে মরদেহও উদ্ধার হয়েছে। উড়োজাহাজটি অন্তত আধাঘণ্টা আকাশে অবস্থান করছিল।
প্রিগোশিন পুতিনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দেশটিতে রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করছিল ভাগনার সেনারা। তবে রুশ সামরিক নেতৃত্বের প্রতি অসন্তোষ ছিল প্রিগোশিনের।
এ অসন্তোষের প্রকাশ ঘটে গত ২৩ জুন। বিদ্রোহ করে বসেন প্রিগোশিন। রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বকে উৎখাতের জন্য ইউক্রেন সীমান্ত থেকে মস্কোর দিকে অভিযান শুরু করেন তিনি। পথে কয়েকটি শহর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন ভাগনারের যোদ্ধারা। ভাগনারের নিয়ন্ত্রণে যায় গুরুত্বপূর্ণ একটি রুশ সেনাঘাঁটি।
প্রিগোশিনের বিদ্রোহের জেরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। পরবর্তী সময়ে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় অভিযান বন্ধের ঘোষণা দেন প্রিগোশিন। সমঝোতায় বলা হয়, প্রিগোশিনসহ ভাগনার সেনারা রাশিয়া ছেড়ে বেলারুশে চলে যাবেন।
৬২ বছর বয়সী প্রিগোশিনের জন্ম রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে। এই এই সেন্ট পিটার্সবার্গেই জন্ম রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের। তাদের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্কও রয়েছে। মূলত ক্রেমলিনে খাবার সরবরাহের মধ্য দিয়ে ‘পুতিনের পাচক’ পরিচিত পান প্রিগোশিন।
প্রিগোশিন ১৮ বছর বয়সে ১৯৭৯ সালে চুরির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে প্রথমবারের মতো কারাভোগ করেন। এর ঠিক দুই বছর পর ডাকাতির দায়ে তাকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর মধ্যে তিনি ৯ বছর কারাভোগ করেন। কারাভোগ শেষে ব্যবসা শুরু করেন প্রিগোশিন। তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গে হট ডগ বিক্রি করা শুরু করেন। পরে ধীরে ধীরে তিনি বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁর মালিক হয়ে যান। পিটার্সবার্গে প্রিগোশিনের রেস্তোরাঁগুলোর মধ্যে একটির নাম ছিল নিউ আইল্যান্ড। ভাসমান এ রেস্তোরাঁটি নেভা নদীতে ভেসে বেড়াত। পুতিনের বেশ পছন্দের রেস্তোরাঁ ছিল এটি। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর পুতিন তার বিদেশি অতিথিদের এই ভাসমান রেস্তোরাঁয় আনতেন।
এভাবে ধীরে ধীরে পুতিনের সঙ্গে প্রিগোশিনের ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। এর কয়েক বছর পর প্রিগ্রোশিনের মালিকানাধীন একটি ক্যাটারিং কোম্পানি কনকর্ড ক্রেমলিনে খাবার সরবরাহ করার দায়িত্ব পায়। এরপর সামরিক বাহিনী ও সরকারি স্কুলেও খাবার সরবরাহের দায়িত্ব পায় প্রিগোশিনের কনকর্ড।
২০১৪ সালে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালায় রাশিয়া। তখন ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয়। সে সময় এমন খবর প্রকাশিত হয় যে, প্রিগোশিন কোনো সাধারণ ব্যবসায়ী নন। প্রথম জানা যায়, একটি ছদ্মবেশী বেসরকারি সামরিক প্রতিষ্ঠান তার সঙ্গে যুক্ত এবং ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে এর সেনারা লড়ছে।
তবে শুধু ইউক্রেন নয়, বিশ্বজুড়ে নিজেদের আধিপত্য বাড়াতে ক্রেমলিন ভাগনার গ্রুপকে ব্যবহার করছে। আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে সক্রিয় ভাগনার। ক্রেমলিনের ‘অ্যাজেন্ডা’ বাস্তবায়নই এই গোষ্ঠীর লক্ষ্য। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারকে সহযোগিতা থেকে শুরু করে মালিতে ফ্রান্সের প্রভাব ঠেকানো পর্যন্ত যা বিস্তৃত।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাড়াটে এই সশস্ত্র সেনাদল ক্রেমলিনের নির্দেশে নিষ্ঠুর ও পাশবিক অভিযান চালানোর জন্য বিশ্বজুড়ে কুখ্যাত হয়ে উঠেছে। ২০১৭ সালে সিরিয়ায় এক বন্দীকে হাতুড়ি দিয়ে নির্যাতন চালানোর পর তার শিরশ্ছেদ করে মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগ রয়েছে এই ভাগনার গ্রুপের বিরুদ্ধে।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রিগোশিন স্বীকার করেন, ২০১৪ সালে তিনিই ভাড়াটে এই সেনাদল প্রতিষ্ঠা করেছেন।
ভাগনারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইইউর। তবে রাশিয়ার আইন অনুযায়ী অবৈধ হলেও দেশটিতে কার্যক্রম চালাতে বাধা দেওয়া হয় না।
প্রিগোশিনের নেতৃত্ব এমন কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যার কাজ ওয়েবসাইট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ক্রেমলিনের মতাদর্শিক অবস্থানের প্রচার করা। এতে নেতৃত্ব দেয় পিটার্সবার্গের ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সি (আইআরএ)। সংস্থাটির বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে।
২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগের বিষয়টির প্রমাণ পাওয়ার পর আইআরএ ও প্রিগোশিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেনে অপপ্রচার চালানোর কাজে নিয়োজিত আছে আইআরএ সংস্থাটি। শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা ইউক্রেন নয় যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতের মতো দেশেও প্রিগোশিনের ‘সাইবার সেনারা’ বিভিন্ন অপপ্রচার চালান বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রিগোশিন স্বীকার করেন যে, তিনিই আইআরএ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার নির্দেশেই এটি পরিচালিত হচ্ছে।