বাংলাদেশি ফোক ও ফ্যান্টাসি চলচ্চিত্র

:: ফজলে এলাহী ::
বাংলাদেশের মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ইতিহাস যদি ঘেঁটে থাকেন তাহলে দেখবেন ইতিহাসের বড় একটা অংশ জুড়ে আছে ফোক ও ফ্যান্টাসি ধারার চলচ্চিত্র। এমনকি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে রেকর্ডসংখ্যক ব্যবসা সফল ছবিগুলোর তালিকায় ১ম স্থান দখল করে আছে তোজাম্মেল হক বকুলের ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ নামের ফোক ফ্যান্টাসি ছবিটি। ফোক ছবির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আমরা তিনটি ভাগ করতে পারি:
১] প্রচলিত লোকগাঁথা
২] সমসাময়িক গ্রামের আর্থ ও সামাজিক গল্পের পটভূমি
৩] যাদু ও সর্প ভিত্তিক ফ্যান্টাসি। এই ধারায় ফোক ছবি নির্মিত হয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে।

এবার ফোক ছবির শুরুর দিকে একটু আলোকপাত করি। ১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আব্দুল জব্বারের ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রটি শুধুই বাংলা ভাষায় নির্মিত এই ভূখণ্ডের সর্বপ্রথম সবাক চলচ্চিত্র নয়, ‘মুখ ও মুখোশ’ ছিল উর্দু ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জও বটে।মুখ ও মুখোশ নির্মাণের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে আমরা একটা বিষয় স্পষ্টত বুঝতে পারি যে, প্রচন্ড দেশ প্রেম ও জাতীয় একটি সংস্কৃতি বিনির্মাণের ভিত্তি ভূমিতে দাঁড়িয়ে আব্দুল জব্বার খান ও তাঁর সহকর্মীরা কারিগরী ও অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতা নিয়েও এক অসাধ্য সাধন করেছিলেন। তাঁরা পাকিস্তানীদের কাছে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন যে, ৫৬ হাজার বর্গমাইলের পূর্ব বাংলায় প্রকৃতার্থে চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব এবং বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব।মূলত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এদেশের চলচ্চিত্র ও নাট্যকর্মীদের কর্মকাণ্ডে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। বাংলাভাষার আন্দোলন বাঙালীর জাতীয় জীবনে যে প্রাণ সঞ্চার করেছিলো তার ছোঁয়া সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্রে কর্মীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছিল যে ধারাবাহিতায় নির্মিত হয় ‘মুখ ও মুখোশ’। মুখ ও মুখোসের গল্প, লোকেশন সবকিছু খেয়াল করলে দেখবেন যে প্রথম সবাক চলচ্চিত্রটিই ছিল ফোক ছবি। অর্থাৎ ফ্যান্টাসি ও লোকগাঁথা ছাড়া নির্মিত ফোক ছবি।

১৯৫৬ সালে ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পেলে পূর্ব বাংলায় সাড়া পড়ে গিয়েছিলো। বাংলা ভাষায় বাংলাদেশে নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দেখে বাংলার মানুষ আবেগে আপ্লুত হয়েছিলো। তারপর ১৯৫৯ সালে এ জে কারদারের জাগো হুয়া সাভেরা, ফতেহ লোহানীর আকাশ আর মাটি, মহীউদ্দিনের মাটির পাহাড় ও এহতেশামের এদেশ তোমার আমার মুক্তি পায়। এই চারটি চলচ্চিত্রই সুস্থ ও শৈল্পিক ধারার সূত্রপাত ঘটায় বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। অর্থাৎ প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশের পর শৈল্পিক ধারায় বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প বিকাশের একটি প্রয়াস শুরু হয়েছিলো বলে বলা চলে। তারপর ১৯৫৯ সালে এহতেশামের ‘এদেশ তোমার আমার’ মহিউদ্দিনের ‘মাটির পাহাড়’, ১৯৬০ সালে এহতেশামের ‘রাজধানীর বুকে’, ফতেহ লোহানীর আসিয়া, ১৯৬১ সালে যে ‘নদী মরু পথে’ (সালাহউদ্দিন), হারানো দিন (মুস্তাফিজ), তোমার আমার (মহীউদ্দিন) ও জহির রায়হানের কখনো আসেনি মুক্তি পায়।

উল্লেখিত ছবিগুলোর মাঝে ‘এদেশ তোমার আমার’,’আসিয়া’, ‘হারানো দিন’ চলচ্চিত্রগুলোও ছিল সামাজিক ফোক ও ফোক রোমান্টিক ছবি অর্থাৎ তৎকালীন সময়ের গ্রাম্য জীবনের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটের উপর নির্মিত। দুঃখজনক হলেও সত্য যে সেই সময় উর্দু ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর পাশাপাশি বাংলায় ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র তৈরি হলেও কোনটি ব্যবসায়িক সফলতা পাচ্ছিল না। যার ফলে এদেশের চলচ্চিত্রের প্রযোজক পরিচালকগন উর্দু ছবি নির্মাণের দিকে ঝুঁকি পড়েন। অর্থাৎ শুরুতেই এদেশের নির্মিত বাংলা চলচ্চিত্র ব্যবসায়িক ঝুঁকির মধ্যে পড়াতে বিরাট ধাক্কা খেয়ে যায়। আমরা যদি সেইসময়কার চলচ্চিত্রের তালিকাটা বা পরিসংখ্যান দেখি, তবে দেখতে পাবো যে বাংলার তুলনায় উর্দু ভাষার চলচ্চিত্রের সংখ্যা বাড়ছিল দিনদিন। যেখানে ১৯৬৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ১৬টি চলচ্চিত্রের মধ্যে নয়টি চলচ্চিত্রই উর্দু ভাষায় নির্মিত হয়। এর মধ্যে দিয়ে আব্দুল জব্বার খান বা সেই সময়ের চলচ্চিত্র কর্মিরা পাকিস্তানী সংস্কৃতি ও উর্দু ভাষার বিপক্ষে যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলো মুখ ও মুখোশের নির্মাণ কাজে, সেই চ্যালেঞ্জেই যেন তাঁরা হেরে যাচ্ছিলেন। বাংলা ভাষার সিনেমার পরিবর্তে উর্দু ভাষা ও সংস্কৃতি এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে যেন জেঁকে বসেছিল। ঠিক এমনই এক সময়ে [১৯৬৫ সাল] পরিচালক সালাহউদ্দিন নির্মাণ করলেন বহুল প্রচলিত লোকগাথা নিয়ে চলচ্চিত্র ‘রুপবান’ যা বাংলা ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোকে ব্যর্থতার গহবর থেকে টেনে তুললো। অর্থাৎ বিপর্যস্ত ও ব্যর্থ বাংলা চলচ্চিত্রকে টেনে তুলতে দেশীয় চলচ্চিত্রকার চলচ্চিত্র কর্মীরা এদেশের লোকজ-সংস্কৃতি ও লোক কাহিনীর কাছে শেষ অবধি হাত পেতেছিলো। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন এদেশের লোক কাহিনী, কথামালা, লোক সঙ্গীত ও লোক বিশ্বাস গুলোই এদেশের মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির মূল কেন্দ্রবিন্দু । সালাহউদ্দিনের ‘রুপবান’ ছিল এদেশের বহুল প্রচলিত লোক কাহিনী। এই লোক কাহিনী ছিলো গীতল। অসংখ্য লোক গানের মধ্য দিয়ে বিধৃত এই কাহিনী ছিলো বাংলার প্রতিটি মানুষের মুখে। বারো বছরের রূপবান কন্যার সাথে রাজপুত্র রহিম, যে কিনা সদ্য জন্ম লাভ করেছে, তার বিয়ের মাধ্যমে এই কাহিনীর বিস্তৃতি লাভ ঘটে। তারপর দৈব বাণীর কল্যাণে ১২ দিনের স্বামী রহিমকে নিয়ে ১২ বছরের রূপবান কন্যার বনবাস। রূপবানের বনসংগ্রামী জীবন, রহিম বাদশার বেড়ে ওঠা, অপর রাজকন্যা তাজেলের প্রেমে পড়া পরিশেষে অমোঘ সত্য প্রকাশিত হওয়ার ইত্যকার বিষয়াদিই রূপবান লোককাহিনীর উপজীব্য।

রুপবানের সফলতায় শুরু হয় বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন একটি অধ্যায়। রূপবানের অসাধারণ ব্যবসায়িক সাফল্যের সূত্র ধরে পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৬ সালে ইবনে মিজান রূপবান চলচ্চিত্রের সিক্যুলের মতো করে আবার বনবাসে রূপবান নির্মাণ করেন ও ব্যবসায়িক সাফল্য পান। তাছাড়াও ১৯৬৬ সালে সফর আলী ভুইয়া নির্মাণ করেন রহিম বাদশা ও রূপবান, সালাহউদ্দিন রূপবানের উর্দু ভার্শনও নির্মাণ করেন। একই বছর নজরুল ইসলাম আপন দুলাল, ইবনে মিজান জরিনা সুন্দরী, সৈয়দ আউয়াল গুনাই বিবি, আলি মনসুর মহুয়া চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। রূপবান ছবির অর্থনৈতিক সাফল্যের কারণে পরবর্তীতে ফোক ও ফোক ফ্যান্টাসি ধারার চলচ্চিত্র এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাসে একটি স্বকীয় জায়গা করে নিতে সমর্থ হয়েছে এবং এই ধারা বহমান থাকে ৯০ দশক পর্যন্ত।

উল্লেখ্য, বাংলা চলচ্চিত্রে ফোক ফ্যান্টাসি ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় পরিচালক ইবনে মিজান। ইবনে মিজান এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিলেন যে তাঁর নাম দেখেই সিনেমা হলে দর্শক ছুটে যেতো। ইবনে মিজান লোকগাঁথার সাথে তাঁর আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা চেতনা যুক্ত করে নিজের মতো করে গল্প বলতেন। কারিগরি অনেক সীমাবদ্ধতা ইবনে মিজান নিজের চেষ্টা দিয়ে জয় করেছিলেন। ইবনে মিজানের ‘মৎস্যকন্যা’ চলচ্চিত্রে দর্শক দেখেছিল সাগরের জলের নীচে নায়ক নায়িকার কথোপকথন যা ছিল একটি বড় কক্ষের আকৃতির একুরিয়ামকে মাঝখানে রেখে উল্টো পাশ থেকে ক্যামেরায় চিত্রধারন।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ফোক ও ফোক ফ্যান্টাসি ধারার চলচ্চিত্রের মধ্যে আজিজুর রহমানের মধুমালা (১৯৬৮), দিলীপ সোমের সাত ভাই চম্পা (১৯৬৮), খান আতাউর রহমানের অরুণ বরুণ কিরণ মালা (১৯৬৮), ই আর খানের রূপবানের রূপ কথা (১৯৬৮), মহিউদ্দিনের গাজী কালু চম্পাবতী (১৯৬৮), ইবনে মিজানের পাতাল পুরীর রাজকন্যা (১৯৬৯), নুরুল হক বাচ্চুর বেদের মেয়ে (১৯৬৯), ইবনে মিজানের আমির সওদাগর ও ভেলুয়া সুন্দরী (১৯৭০), শহীদুল আমিনের রাজকুমারী চন্দ্রবান (১৯৭৯), মঞ্জুর হোসেনের মণিমালা (১৯৭০), ফাল্গুনী গোষ্ঠির মলুয়া (১৯৬৯), বশীর হোসেনের রাজ মুকুট, শেখ আনোয়ারের সতী নারী (১৯৭৩), রূপ সনাতনের দয়াল মুর্শিদ (১৯৭৩), প্রমোদকার (খান আতার ছদ্মনাম) এর সুজন সখী (১৯৭৪), মহসিনের রাজার হলো সাজা (১৯৭৬), সফদর আলী ভূইয়ার কাজল রেখা, (১৯৭৬), আজিজুর রহমানের শাপ মুক্তি (১৯৭৬), এফ এ বিনুর রাজরানী, ইবনে মিজানের বাহাদুর (১৯৭৬), অশোক ঘোষের মতি মহল (১৯৭৭), ইবনে মিজানের নিশান (১৯৭৭), কামাল আহমেদের দাতা হাতেম তাই (১৯৭৭), শফি বিক্রমপুরীর রাজ দুলারী (১৯৭৮), ইবনে মিজানের শাহজাদা (১৯৭৮), অশোক ঘোষের তুফান (১৯৭৮), স্বপন সাহার মেহের বানু (১৯৭৮), দারাশিকোর ফকির মজনুশাহ (১৯৭৮), এফ কবির চৌধুরীর রাজমহল (১৯৭৯), ফয়েজ চৌধুরীর বিজয়িনী সোনাভান (১৯৭৯), শহীদুল আমিনের রাজকুমারী চন্দ্রবান (১৯৭৯), আজিজুর রহমানের সাম্পান ওয়ালা (১৯৭৯), আলমগীর কুমকুমের রাজবন্দী (১৯৭৯), শহীদুল আমিনের রূপের রানী চোরের রাজা (১৯৭৯), ইশতিয়াকের চন্দ্রলেখা (১৯৮০), ফখরুল হাসান বৈরাগীর লুটেরা (১৯৮০), এফ কবির চৌধুরীর, রাজ নন্দিনী (১৯৮০), ইবনে মিজানের তাজ ও তলোয়ার (১৯৮০), জংলী রানী (১৯৮০) এফ কবির চৌধুরীর রাজকন্যা (১৯৮০), দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ওমর শরীফ (১৯৮০), ফখরুল। হাসান বৈরাগীর শাহী দরবার (১৯৮০), এফ কবির চৌধুরীর আলিফ লায়লা (১৯৮০), শেখ নজরুল ইসলামের নাগিন, দিলীপ বিশ্বাসের আনার কলি (১৯৮০), অশোক ঘোষের বাদল (১৯৮১), শহীদুল আমিনের শাহজাদী গুলবাহার, অশোক ঘোষের নবাবজাদী, এফ কবির চৌধুরীর সুলতানা ডাকু (১৯৮০), ইবনে মিজানের রাজ নর্তকী আজিজ মেহেরের আকাশপরী (১৯৮১), ফয়েজ চৌধুরীর আলতা বানু (১৯৮২), নাজমুল হুদা মিন্টুর মধু মালতী, শামসুদ্দিন টগরের যুবরাজ, এফ কবীর চৌধুরীর সওদাগর, রাজসিংহাসন. মতিউর রহমান বাদলের নাগিনী কন্যা (১৯৮২) অশোক ঘোষের টক্কর (১৯৮৩), এফ কবীর চৌধুরীর আবে হায়াত (১৯৮৩), ইবনে মিজানের লাইলী মজনু (১৯৮৩), এম এ মালেকের শাহী চোর, মাসুদ পারভেজের নাগ পূর্ণিমা, শামসুদ্দিন টগরের বানজারান, দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর নাগরাণী, মোস্তফা আনোয়ারের আঁখি মিলন (১৯৮৩), ১৯৮৪ সালে নির্মিত এফ কবীর চৌধুরীর পদ্মাবতী, কাজী কামালের মৎস্য কুমারী, সফদর আলী ভুইয়া রসের বাইদানী, এম এ মালেকের হাসান তারেক, ইবনে মিজানের চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা, ফখরুল হাসান বৈরাগীর রাজিয়া সুলতানা, মোতালেব হোসেনের সালতানাৎ, আবুল খায়ের বুলবুলের শাহী কানুন, আবদুল লতিফ বাচ্চুর দ্বীপ কন্যা, দারাশিকোর জিপসী সর্দার, দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর মহল, ছটকু আহমেদের রাজদন্ড, ১৯৮৫ সালে নির্মিত মুহাম্মদ হান্নানের রাইবিনোদিনী, আজিজুর রহমানের ফুলেশ্বরী, ইবনে মিজানের রাজ কুমারী, মালেক আফসারীর গীত, দেওয়ান নজরুলের কোরবানী, আজিজুর রহমানের সোনাই বন্ধু, কামরুজ্জামানের রসিয়া বন্ধু, ফখরুল হাসান বৈরাগীর ওয়ারিশ. ইবনে মিজানের সতী নাগকন্যা, আজিজুর রহমানের রঙিন রূপবান, শামসুদ্দিন টগরের নকল শাহজাদা, ইবনে মিজানের পাতাল বিজয়, মো. শাহাজাহানের পরীস্থান, হারুনুর রশীদের গুনাই বিবি, আবুল খায়ের বুলবুলের ফুল কুমারী, শামসুদ্দিন টগরের রাজ ভিখারী।

১৯৮৬ সালে নির্মিত মতিউর রহমান বাদলের দুলারী জিল্লুর রহমানের আয়নামতি, আবদুস সামাদের শিরি ফরহাদ, মতিউর রহমান পানুর নাগমহল, ১৯৮৭ সালে নির্মিত এম এ মালেকের চাঁদ সওদাগর, এফ কবীর চৌধুরীর বাহাদুর মেয়ে, আবুল খায়ের বুলবুলের জারকা, মাহমুদ হান্নানের মালা বদল, মতিউর রহমান বাদলের চন্দ্রাবতী, নুর হোসেন বলাইয়ের নাগ কন্যার প্রেম, ইবনে মিজানের রঙিন রাখাল বন্ধু, রাজবধূ,এম এ মালেকের রাজমাতা, রফিকুল বারী চৌধুরীর চন্ডীদাশ রজকিনী, শেখ নজরুল ইসলামের দিদার, ইবনে মিজানের বাহাদুর নওজোয়ান, বসন্ত মালতী, শামসুদ্দিন টগরের সতী কমলা, মিজান চৌধুরীর রঙিন সাতভাই চম্পা, মতিউর রহমান বাদলের শাহ জামাল, শামসুদ্দিন টগরের মহুয়া সুন্দরী, আজিজুর রহমানের কাঞ্চন মালা, শফিউল আলমের অরুণ বরুণ কিরণ মালা, ১৯৮৮ সালে নির্মিত চাষী নজরুলের বেহুলা লখিন্দ ১৯৮৯ সালে তারই নির্মিত সোনার নাও পবনের বৈঠা, সাইদুর রহমানের আলোমতি প্রেম কুমার এবং তোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত বেদের মেয়ে জোছনা উল্লেখযোগ্য।

এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে চাই বেদের মেয়ে জোসনা বাংলাদেশের ফোক ফ্যান্টাসি ঘরানার চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এক বিশেষ ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ইলিয়াস কাঞ্চন ও অনজু অভিনীত এই চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এতদকালের সর্বাপেক্ষা ব্যবসা সফল ছবি। তাছাড়াও উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসেও ব্যবসা সফল প্রথম দশটি চলচ্চিত্রের মধ্যে একটি। ১৯৮৯ সালে প্রযোজক মতিউর রহমান পানুর ‘আনন্দমেলা চলচ্চিত্র’ থেকে একটি ‘ফোক ফ্যান্টাসি’ ছবি বানানোর ঘোষণা দেন যার পরিচালক হবেন তোজাম্মেল হক বকুল । একক পরিচালক হিসেবে বকুলের সেটাই হবে প্রথম কোন ছবি । পরিচালক তোজাম্মেল হক বকুল নিজেই একটি কাহিনী দাঁড় করালেন যার নাম দিলেন ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ এবং কাহিনীর সাথে মিল রেখে নিজেই গানগুলো লিখলেন ( শুধু মুজিব পরদেশী’র কণ্ঠের গানটি ছাড়া)।

পরিচালক বকুলের লিখা ছবির গল্পটি ছিল এমন – বঙ্গরাজ শওকত আকবরের অধীনের একটি পরগনার কাজী সাহেবের (প্রবীর মিত্র) ৯/১০ বয়সের একমাত্র সন্তান জোসনা (অঞ্জু ঘোষ) কে সাপ দংশন করলে জমিদার প্রবীর মিত্র সব চিকিৎসায় ব্যর্থ হয়ে গনক এর কথায় কলা গাছের ভেলায় ভাসিয়ে দেয়। ভাসতে ভাসতে সেই ভেলাটি একসময় একটি নদী তীরের বেদে বহরের নৌকার ধারে এসে ভিড়ে। বেদে বহরের নিঃসন্তান সর্দার সাইফুদ্দিন শিশু জোসনা’কে সুস্থ করে তোলে এবং নিজের নাতনীর মতোই লালন পালন করে একজন বেদেনি হিসেবে গড়ে তোলে । বঙ্গরাজার রাজবাড়ীতে সাপের খেলা দেখে ফেরার পথে উজির পুত্র মোবারক (নাসির খান) জোসনাকে জোর পূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা করে যেখান থেকে রাজকুমার (ইলিয়াস কাঞ্চন) তাকে উদ্ধার করে । এভাবেই রাজকুমার আনোয়ার ও বেদেনি জোসনা’র প্রথম দেখা হয় এবং ঘটনাক্রমে একসময় দুজনের গভীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। বঙ্গরাজা শওকত আকবর যখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে রাজকুমার আনোয়ারের উপর তিনি রাজ্যর দায়িত্ব তুলে দিয়ে সিংহাসনে বসাবেন এবং তার আগে উজির কন্যা তারা’র ( ফারজানা ববি) রাজকুমারের বিয়ে দিবেন। বঙ্গরাজের এমন সিদ্ধান্ত ঘোষণা দেয়ার আগে রাজপুত্র আনোয়ার (কাঞ্চন) কে একটি বিষাক্ত সাপে দংশন করে যার বিষ নামাতে বা সুস্থ করতে কোন ওঝাই রাজী হয়নি। ঠিক সব চেষ্টা যখন ব্যর্থ তখন সেনাপতি পুত্র রাজ্জাক (মিঠুন) জোসনাকে রাজ দরবারে নিয়ে আসে আনোয়ারের চিকিৎসা করাতে । রাজা শওকত আকবর জোসনা’কে প্রতিশ্রুতি দেয় যদি জোসনা যদি রাজকুমার’কে সুস্থ করে তুলতে পারে তাহলে প্রতিদানে পুরস্কার স্বরূপ জোসনা যা চাইবে রাজা তাই দিবে । জোসনা নিজের জীবন বাজি রেখে রাজকুমার আনোয়ার’কে সুস্থ করে তোলার পর রাজার ওয়াদা অনুযায়ী রাজসভার সামনে জোসনাকে চাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করে । জোসনা সবার সামনে গানের সুরে সুরে রাজকুমার’কে পাওয়ার ইচ্ছা জানিয়ে দিলে রাজা ওয়াদা পূরণের বদলে তিরস্কার করে কপালে রক্ত ঝরিয়ে রাজসভা থেকে জোসনা’কে বের করে দেয়। রাজার নির্দেশে বেদে বহরের সব ঘর বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয় এবং বেদে বহর’কে রাজ্য থেকে বের করে দেয় । রাজকুমার আনোয়ার তাঁর মায়ের মুখ থেকে সব শুনে জোসনাকে খুঁজে বের করে এবং বিয়ে করে রাজবাড়ীতে নিয়ে আসে । পিতা বঙ্গরাজার কথা অমান্য করে জোসনা’কে বিয়ে করায় রাজা তাঁর পুত্রকে মৃত্যুদণ্ড দেয় এবং জোসনা’কে বনবাসে পাঠায়। এরপর আরও অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে জোসনা তাঁর পিতা কাজী সাহেবকে খুঁজে পায় এবং বঙ্গরাজা রাজকুমার আনোয়ার ও জোসনা’র সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিয়ে রাজবাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ছবির কাহিনীর মিলনাত্মক সমাপ্তি হয়।

উপরে সংক্ষিপ্তকারে তুলে ধরা কাহিনীটি দিয়ে তৈরি হয় ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ছবিটি। পরিচালক বকুল ছবির দৃশ্যর সাথে মিল রেখে ছোট বড় মিলিয়ে ফোকধারার সর্বমোট ১১ টি গান রাখেন যার ১০টি লিখেছিলেন বকুল নিজেই । সেই গানগুলোর মাঝে রুনা লায়লা ও এন্দ্রু কিশোরের কণ্ঠের ‘বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে ‘ও মুজিব পরদেশী’র কণ্ঠে ‘আমি বন্দি কারাগারে’ গান দুটো হয় সুপারহিট গান যা তখন সবার মুখে মুখে । বকুলের লিখা গানগুলোর সুর ও সঙ্গীত করেছিলেন সেই সময়ের তরুন মেধাবী সঙ্গীত পরিচালক আবু তাহের । তাহের প্রতিটি গানকে খুব সহজ সরল ভাবে মানুষের হৃদয়ে গেঁথে যাবার মতো সুর করেন যার মধ্য লোকগানের একটা ধাঁচ সবসময় ধরে রেখেছিলেন। সেই লোক কাহিনী ,১১ টি লোক গান ও অভিনেতা অভিনেত্রীদের সুনিপুন অভিনয় আর পরিচালকের বুদ্ধিদীপ্ত পরিচালনার ফলে ছবিটি মুক্তির পর হয়ে যায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে প্রথম সর্বাধিক আয় করা ব্যবসাসফল একটি ছবি যার ধারে কাছে এর আগে মুক্তি পাওয়া কোন ছবি ছিল না। দর্শকদের কাছে একেবারেই অচেনা নতুন পরিচালকের রাজসিক সুচনা হয় তোজাম্মেল হক বকুলের যা সবার কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ প্রসঙ্গে পৃথিবীর বিখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক ফাদার গাঁস্ত রোবেজ বলেছিলেন অনজু ঘোষের ইননোসেন্ট চেহারা ও অভিনয়ই এই ছবির ব্যবসা সফলতার প্রধান একটি কারণ। তিনি আরো বলেছিলেন, গতানুগতিক আজগুবী প্রচলিত গ্রামীন লোককাহিনীর ছবিটি খুব সাধারণ হলেও সকল স্তরের সাধারণ মানুষের মনে কাহিনীটি রয়েছে। ফলে চলচ্চিত্রটি সহজে সকলের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছে।

শুধু লোকগাঁথা বা ফ্যান্টাসি নির্ভর গল্প নয়, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট, নরনারীর প্রেমকাহিনী ও সাহিত্যনির্ভর গল্পের বহু অসাধারন ফোক ছবি নির্মিত হয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা চলচ্চিত্রের বিশাল একটি অংশ জুড়ে রয়েছে সেসসব ফোক ছবি। যারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো খান আতাউর রহমানের ‘সুজন সখী’, নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘ লাঠিয়াল’, জহিরুল হকের ‘প্রানসজনী’, আমজাদ হোসেনের ‘সুন্দরী’, ‘নয়নমণি’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘ভাত দে’, চাষি নজরুলের ‘দেবদাস’, ‘রামের সুমতি’, ‘বিরাজ বৌ’, ‘শুভদা’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, বুলবুল আহমেদের ‘রাজলক্ষ্মী ‘শ্রীকান্ত’,রাজ্জাকের ‘চাপা ডাঙ্গার বউ’, ‘জিনের বাদশা’, আব্দুস সামাদ খোকনের ‘ঝিনুক মালা’, দেলোয়ার জাহান ঝনটু’র ‘শিমুল পারুল’, ‘পালকী’ সহ আরও অসংখ্য চলচ্চিত্র দর্শকদের মন জয় করেছিল।৬০ থেকে ৯০ দশকে বাংলা চলচ্চিত্রের এমন কোন জনপ্রিয়,সফল তারকা নেই যে যিনি/ যারা ফোক কিংবা ফোক ফ্যান্টাসি ছবিতে অভিনয় করেননি।

সমালোচকরা প্রায় বলে থাকেন এসব চলচ্চিত্রের বেশীরভাগই আজগুবী। কিন্তু লোক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কিছু চলচ্চিত্রে দেখা গেলেও গ্রামের সাধারণ মানুষের মণিকোঠায় বেঁচে থাকা রূপকথা, উপকথা গুলোও গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ। মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক নানা ব্যাখ্যা থাকলেও এসব চলচ্চিত্রের নির্মাণ ও এর চাহিদা এদেশে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। মূলধারার চলচ্চিত্র শিল্পে গ্রামীণ ফোক “ফ্যান্টাসি ধারার চলচ্চিত্র বিশাল এক লগ্নি ও স্থান দখল করে রাখলেও আজ আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পে এই ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় না যা আমাদের নির্মম আধুনিকতার কুফল বলা যায়।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *