:: ক্রীড়া প্রতিবেদক ::
চলে গেলেন খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে ফুটবল বিশ্বকাপ জয়ী জার্মান কিংবদন্তি ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার (Franz Beckenbauer) মারা গেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।
এই ফুটবল কিংবদন্তি পশ্চিম জার্মানির হয়ে ১৯৭৪ সালে অধিনায়ক হিসেবে এবং ১৯৯০ সালে কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ শিরোপা হাতে তোলেন। খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ী তিনজনের একজন এই বায়ার্ন মিউনিখ কিংবদন্তি।
সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ডিফেন্ডার অধিনায়ক ও কোচ হিসেবে প্রথম বিশ্বকাপ জেতা খেলোয়াড়। পরে ২০১৮ সালে তাঁর এই কীর্তিতে ভাগ বসিয়েছেন দিদিয়ের দেশম। আর সব মিলিয়ে যে তিন জন ফুটবলার খেলোয়াড় এবং কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জিতেছিলেন তাঁদের একজন ছিলেন তিনি। একই ভূমিকায় বিশ্বকাপ জেতা ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি জাগালো গত ৫ জানুয়ারি মারা যান।
ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার কিছুদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানান জটিলতায় ভুগছিলেন। হাসপাতালে ছিলেন কিছুদিন ধরেই। সপ্তাহখানেক আগেই তার ভাই ওয়াল্টার জানিয়েছিলেন, যদি আমি বলি যে তিনি ভালো আছেন, তাহলে মিথ্যা বলা হবে। আমি মিথ্যা বলতে পছন্দ করি না। তিনি ভালো নেই। শারীরিক অবস্থা একটু ভালো হচ্ছে তো আবার খারাপের দিকে যাচ্ছে।
বেকেনবাওয়ার মৃত্যুর খবর গতকাল তাঁর পরিবার নিশ্চিত করেছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘গভীর দুঃখের সঙ্গে আমরা ঘোষণা করছি, স্বামী এবং পিতা ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার গতকাল রোববার ঘুমের মধ্যে শান্তিতে মারা গেছেন। আমরা অনুরোধ করছি, আপনারা নীরবে শোক করতে পারবেন। তবে কোনো ধরনের প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকুন।’
২০১৫ সালে তাঁর পুত্র স্টিফেন মারা যাওয়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে বেকেনবাওয়ারের স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছিল। এরপর থেকেই পারকিনসনস, ডিমেনশিয়া ভুগছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে জার্মান ডিফেন্ডার হৃদ্যন্ত্রের অস্ত্রোপচারের সঙ্গেও লড়ছিলেন। গত কয়েক মাসে ‘কাইজার’ (Kaiser) খ্যাত কিংবদন্তির স্বাস্থ্য অবনতির দিকে গেলে তাঁকে মাসের শুরুতে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল।
ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ছিলেন। তিনি পশ্চিম জার্মানির হয়ে ১০৩ ম্যাচ খেলে ১৪ গোল করেছেন। এছাড়া বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ৫৮৪ ম্যাচ খেলে ৭৫ গোল করেছেন। খেলোয়াড় হিসেবে বায়ার্ন মিউনিখের জার্সিতে তিনটি ইউরোপিয়ান কাপ ও চারটি জার্মান বুন্দেসলিগা জিতেছেন। কোচ হিসেবে বায়ার্নকে উয়েফা কাপ জিতিয়েছেন।
খেলা পরবর্তী জীবনে বেকেনবাওয়ারকে অবশ্য দুর্নীতির অভিযোগেও অভিযুক্ত হতে হয়েছিল। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে দুর্নীতি করার অভিযোগ উঠে তাঁর বিরুদ্ধে। অভিযোগটি ছিল ২০০৬ বিশ্বকাপের আয়োজক হতে আয়োজক নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত ফিফা সদস্যদের ভোট কিনতে তহবিল গঠন করেছিল জার্মান বিডিং কমিটি। আর এই বিডিং কমিটির প্রধান ছিলেন বেকেনবাওয়ার। ২০১৭ সালের মার্চে এই অভিযোগের জন্য সুইস প্রসিকিউটররা তাঁকে জেরাও করে। জীবনের এই নেতিবাচক অধ্যায়টুকু বাদ দিলে বেকেনবাওয়ারের বাকি জীবন ছিল অর্জন ও প্রাপ্তির।
মিউনিখের গিয়েসলিংয়ে ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে জন্ম গ্রহণ করেন বেকেনবাওয়ার। বয়সভিত্তিক ফুটবলের জন্য তিনি বেছে নেন মিউনিখের আরেক ক্লাব বায়ার্নকেই। শুরুতে তিনি ছিলেন একজন সেন্টার ফরোয়ার্ড। বায়ার্নের হয়ে পেশাদার ফুটবলে তাঁর অভিষেক হয় ১৯৬৪ সালে। সে সময় ক্লাবটি খেলত জার্মানির দ্বিতীয় সারির ক্লাবে। বায়ার্নে খেলার সময়েই একপর্যায়ে তিনি মাঝমাঠ এবং পরবর্তীতে ডিফেন্ডার হিসেবে খেলতে শুরু করেন। বায়ার্নকে বুন্দেসলিগায় উঠে আসতে দারুণভাবে সহায়তাও করেন বেকেনবাওয়ার। এরপর ১৯৬৮-৬৯ মৌসুমে তিনি দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হন এবং দলটিকে প্রথমবারের মতো বুন্দেসলিগার শিরোপাও এনে দেন।
বায়ার্নকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে ১৯৭২-৭৪ সালের মধ্যে দলকে ঘরোয়া লিগের হ্যাটট্রিক শিরোপাও এনে দেন। এ সময় ইউরোপিয়ান ফুটবলেও বায়ার্ন হয়ে উঠে অপ্রতিরোধ্য এক দল। ১৯৭৪-৭৬ এর মধ্যে হ্যাটট্রিক ইউরোপিয়ান শিরোপা জেতার কথা তো আগেই বলা হয়েছে।
২০ বছর বয়সে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের কোয়ালিফায়ারে সুইডেনের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে পশ্চিম জার্মানির হয়ে অভিষেক হয় তাঁর। সেই ম্যাচে ২-১ গোলে জিতে ১৯৬৬ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে জায়গা করে নেয় পশ্চিম জার্মানি। সেবার অবশ্য ফাইনালে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের কাছে হেরে রানার্সআপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় পশ্চিম জার্মানিকে। সে সময় জার্মান ফুটবল তাদের সোনালি সময়েও প্রবেশ করে। যে ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে পশ্চিম জার্মানি ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নেয়। আর দুই বছর পর আসে বহুল কাঙ্ক্ষিত ফুটবল বিশ্বকাপটিও।
দলীয় এই সব সাফল্যের পথ ব্যক্তিগত অর্জন ঝুলিও ক্রমশ সমৃদ্ধ হয়েছে বেকেনবাওয়ারের। ১৯৭২ ও ১৯৭৬ সালে ব্যালন ডি’অর জিতে নেন এই ডিফেন্ডার। বেকেনবাওয়ার ফুটবলকে পাকাপাকিভাবে বিদায় জানান ১৯৮৪ সালে। খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করে সেই একই বছর তাৎক্ষণিকভাবে পশ্চিম জার্মানির কোচের দায়িত্ব গ্রহণ করেন বেকেনবাওয়ার।
আগের অভিজ্ঞতা না থাকলেও তাতে অবশ্য কোনো সমস্যা হয়নি। প্রথমবারেই দলকে ১৯৮৬ বিশ্বকাপের ফাইনালে নিয়ে যান বেকেনবাওয়ার। তবে আরেক মহাতারকা ডিয়েগো ম্যারাডোনার অতিমানবীয় ফুটবলের সঙ্গে সেবার পেরে ওঠেনি পশ্চিম জার্মানি। রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিন্তু চার বছর পর সেই আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জেতেন বেকেনবাওয়ার। তাঁর আগেই এই কৃতিত্ব ছিল কেবল ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি মারিও জাগালোর। আর পরে সেটি করে দেখাবেন ফ্রান্সের দিদিয়ের দেশম।
কোচ হিসেবে বেকেনবাওয়ারের কীর্তি অবশ্য সেখানেই থামেনি। এরপর ফরাসি ক্লাব মার্শেইকে ১৯৯০-৯১ লিগ আঁর শিরোপা জেতান বেকেনবাওয়ার। আর ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে কোচ হিসেবে বুন্দেসলিগার শিরোপা এনে দেন বায়ার্নকেও। পরবর্তীতে একই ক্লাবকে ১৯৯৫-৯৬ মৌসুমে উয়েফা কাপের শিরোপাও এনে দেন বেকেনবাওয়ার। কোচিং ক্যারিয়ারের ইতি টেনে বায়ার্নের সভাপতি এবং জার্মান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সহ সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন বেকেনবাওয়ার।