:: মারুফ মল্লিক ::
আরাফাত রহমান কোকো আবাহনীর সমর্থক ছিলেন। আবাহনীর অনুশীলন দেখতে হরহামেশাই ধানমন্ডিতে ছুটে যেতেন। এটা ওই সময়ের প্রতক্ষ্যদর্শীরা আরো ভালে বলতে পারবেন। এই তথ্যটা আমি এক ক্রীড়া সাংবাদিক মোস্তফা মামুন ভাইয়ের লেখা থেকে নিয়েছি। কোকোর আবাহনীর প্রতি সমর্থনের কথাটা শুরুতেই আনলাম। কারন আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে শেখ কামাল। আবাহনীর সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। ফলে বুঝাই যাচ্ছে রাজনীতির উর্ধ্বে উঠেই কোকো আবাহনীকে সমর্থন করেছিলেন। আওয়ামী লীগের ক্লাব বলে পরিচিত আবাহনীকে সমর্থন করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। কারণ খেলাধুলার প্রতি তাঁর অগাধ টান। আজকের এই রাজনৈতিক বিভাজনের যুগে এই রকম সমর্থনের কথা চিন্তা করাও অসম্ভব এক কাজ।
রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হলেও কোকো মূলত খেলার মাঠেরই লোক ছিলেন। প্রথমবার যখন খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রী হলেন তখন কোকো ওল্ডডিওএইচএসের পক্ষে দ্বিতীয় বিভাগে ক্রিকেট খেলেন। তখন আমাদের নারায়নগঞ্জের ওসমানী স্টেডিয়ামে ম্যাটের উইকেটে দ্বিতীয় বিভাগের খেলা হতো। শুনেছি দুই একবার ওখানেও খেলতে গিয়েছেন। অথচ ক্ষমতার প্রয়োগ করে প্রথম বিভাগে খেলতে পারতেন। আরো উচু পর্যায়েও খেলা তার জন্য কঠিন ছিল না। তবে তিনি পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে খুব বেশি সুবিধা নিতে চাইতেন না।
২০০১ সালে ফের বিএনপি ক্ষমতা এলে কোকো বিসিবিতে যুক্ত হন। তিনি চাইলে বিসিবির সভাপতি হতে পারতেন। কিন্তু দায়িত্ব নিলেন ডেভলেপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে। অনেকেই বলতে পারেন তিনি বিসিবিতে এসেছিলেন রাজনৈতিক কারনেই। এটা কেবল উনি না। উনার আগে ও পরে বিসিবিতে যারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বা শীর্ষ পদে আসীন হয়েছিলেন তাদের সবাই কমবেশি রাজনৈতিক পরিচিতির কারণেই এসেছেন। এই যে ফুটবলের সভাপতি সালাউদ্দিন। উনিও কিন্তু এখনো বাফুফেতে আছেন রাজনৈতিক পরিচয়েই। রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে খেলার বিভিন্ন কমিটিতে আসাই আমাদের নিয়তি।
কিন্তু আমাদের এই নিয়তির প্রভাব মানতে কষ্ট হলেও দেখতে হবে, যারা বিভিন প্রভাবে কারণে দায়িত্বে আসলেন তারা শেষ পর্যন্ত কি করে গেলেন। বলে রাখা ভালো, যে কোনো খেলাধুলার বোর্ড বা ক্লাবের ক্ষেত্রে ডেভলমেন্টের পদটি একটি ভয়ংকর পদ। দল সফল হলে এই কমিটির কথা কেউ বলে না। কিন্তু দল ব্যর্থ হলে সবাই সমালোচনা করে ছিড়েখুড়ে ফেলে। কিন্তু যাবতীয় ভয় ও শংকাকে আমলে না নিয়ে তিনি বিসিবির সভাপতির পরিবর্তে ডেভলপমেন্ট কমিটির প্রধানের পদে বসলেন। শঙ্কা ছিল তিনি হয়ত সফল হবেন না। বরং অনেকের ধারণা করেছিল মাঝে মধ্যে মাঠে আসবেন। প্রেসিডেন্ট বক্সে বসে পরিবার নিয়ে খেলা দেখবেন। মাঝে মধ্যে খেলা শেষে পুরস্কার, টুরস্কার খেলোয়ারদের হাতে তুলে দিবেন। এভাবেই এক সময় বোর্ড থেকে বিদায় নিবেন।
কিন্তু তিনি গতানুগতিকতার বাইরে আসলেন। এবং সফল হলেন। তিনি একটাই সফল ছিলেন যে তার তৈরি করা ভিতের উপরই এখানো দেশের ক্রিকেট চলছে। আমি ক্রিকেট নিয়ে কথা বললে এই কথাটা বারবার বলি। আমাদের ক্রিকেট দলকে যারা এখনো টেনে নিয়ে যাচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই তার আমলে তৈরি করা। তিনি দুইটা কাজ করছেন মুলত। এক, ক্রিকেটের স্থায়ী অবকাঠামো তৈরি দিলেন। এর আগে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম নিয়ে ক্রিকেট ও ফুটবলের মধ্যে টানা হেচড়া চলতো । তিনি মিরপুরে হোম অব ক্রিকেট তৈরির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলেন। এর পাশাপাশি বগুড়া ও নারায়নগঞ্জে দুটি স্টেডিয়াম তৈরি করলেন।
আর দ্বিতীয় কাজটি হচ্ছে ভবিষ্যতের খেলোয়ার তৈরির পথটা তিনি তৈরি করেছিলেন হাই পারফরমেন্স ইউনিট গঠন করে। এই ইউনিটের কোচ ছিলের রিচার্ড ম্যাকিন্স। আজকের সাকিব, মুশফিকরা এই হাই পারফরমেন্স ইউনিটের ফসল। সবার অলক্ষে তিনি দেশের ক্রিকেটের ভিতটা তৈরি করে দিলেন। ২০০৭ এর বিশ্বকাপে ভারত ও দক্ষিন আফ্রিকাকে হারানো বা পরবর্তীতে ক্রিকেটর যত সফলতা তার বীজ কিন্তু রোপন করা হয়েছিল কোকোর সময়েই। এই কৃতিত্বটা কোকো দিতেই হবে। ওই এইচপিইউ এর পর এমন কোনো খেলোয়ার আসেনি যারা দীর্ঘ সময় ক্রিকেট দলে খেলে যাচ্ছেন নিয়মিত। বা দলের অপরিহার্য খেলোয়ারে পরিনত হয়েছেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন কিভাবে খেলোায়ার তৈরি করতে হয়। এটা শুধু ক্রিকেট না অন্য কোনো খেলার জন্যও প্রযোজ্য হতে পারে হাই পারফরমেন্স ইউনিট পদ্ধতি। এইরকম ইউনিট গঠন করে প্রতিভাবানদের দীর্ঘ মেয়াদে প্রশিক্ষন দিয়ে গড়ে তোলা দরকার। যদিও কোকোদের বিদায়ের পর বিসিবিও দীর্ঘদিন এইচপিইউ এর কার্যক্রম অব্যাহত রাখেনি।
আবারো আবাহনীর প্রসঙ্গেই ফিরে আসি। আবাহনীর প্রতি কোকো সমর্থন উদারতা ও ক্রীড়ামনষ্কতার পরিচয়। তিনি খেলাধুলার জগতে রাজনৈতিক বিভাজন বা দুরত্বকে অতিক্রম করেছিলেন। যেই রাজনৈতিক বিভেদ বা দুরত্বকে অতিক্রম করে আবাহনীর ভক্ত হয়েছিলেন সেই রাজনৈতিক কলুষতার কারনেই কোকো আজ ক্রিকেট জগতে ব্রাত্য। এমনকি তার মৃত্যুও রাজনৈতিক কারণেই বলে তার পরিবার পরিজন অভিযোগ করেন। রাজনীতিতে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা না থাকার পরও ফখরউদ্দিন সরকারের আমলে আটক ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। আটকবস্থা থেকে বেরিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। এরপর আর দেশে ফিরেননি। তবে ফিরেছিলেন কফিনবন্দী হয়ে হিমশীতল মৃত্যুর স্বাদ নিয়ে।জেল থেকে বেরোনোর কিছুদিন পর মৃত্যু। সম্ভবত কোকোকে দিয়েই শুরু। এরপর বিএনপির অনেক নেতাই জেল থেকে বেরিয়ে মারা গেছেন। অথবা পঙ্গুত্ববরণ করেছেন।
অকাল প্রয়াত এই ক্রিকেট সংগঠকের আজ ৫৩তম জন্মদিন। ক্রিকেটে তার অবদান নিয়ে অনেকেই আজকাল কথা বলতে কুণ্ঠাবোধ করেন। কোকো যেহেতু জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার সন্তান তাই অনেকেই ভয়ে তার নাম উচ্চারন করতে চান না হয়ত। অথচ এদের অনেকেই কোকোর জীবদ্দশায় অনেক সুবিধার জন্য তার চারপাশে ঘুরঘুর করেছেন। আবার বিএনপি ক্ষমতায় আসলে এরা কোকোর কথা বলতে বলতে গলা ফাটিয়ে ফেলবেন। অথচ জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার সন্তানের পরিচয় ছাপিয়ে আমাদের কাছে কোকোর বড় পরিচয় ক্রিকেট সংগঠনক হিসাবেই।
তাই কোকোকে নিয়ে কে কি বললো বা সামলোচনা করলেন, এসবে কোকোর আর কিছু আসে যায় না। তিনি এখন সব আলোচনা, সমালোচনার উর্ধ্বে। কিন্তু ক্রিকেটের উন্নয়নের যে বীজটি তিনি রোপন করেছিলেন তা এখন সবল না হলেও মোটামুটি একটি মাঝারি আকারের বৃক্ষে পরিনত হয়েছে। হয়তাবা আশানুরুপভাবে দেশের ক্রিকেট আগাতে পারেনি। গত বেশ কিছুদিন ধরে বেপথে চলছে ক্রিকেট। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট দল টেস্টে ভালো না করলেও একদিনের ক্রিকেটে বেশ সমীহ জাগানো দল। এখন আর খেলার আগেই হেরে বসে না। দুর্দান্ত প্রতাপশালী দলগুলোও টাইগারদের এখন বেশ সমঝে চলে। সাকিব, মুশফিক, মোস্তাফিজদের নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে মাতামাতি হয়। কোকো কি ওপার থেকে এসব দেখতে পান।