:: মারুফ কামাল খান ::
নয়াদিল্লীতে জি-২০ সামিট-এ যোগ দেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গিয়েছেন ভিয়েতনামে। সেখানে তাঁকে বিপুল উষ্ণ সংবর্ধনায় বরণ করে নেয়া হয়। এ সংবর্ধনার প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভিয়েতনামকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এবং তাঁর এ সফর ঐতিহাসিক হবে বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাঁর এক্স (সাবেক টুইটার) একাউন্টে লিখেছেন : Thank you for the warm welcome, Vietnam. I know this will be a historic visit.
আমরা যখন অল্প অল্প করে রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠছিলাম, সেই কৈশোরে এবং যৌবনের সূচনালগ্নে হো চি মিনের দেশ ভিয়েতনাম নামটি আমাদেরকে প্রবল আবেগে উদ্বেল করে তুলতো।
ফ্রান্সের কবল থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর ভিয়েতনাম উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই আলাদা ভাগে ভাগ হয়েছিল। সমাজতন্ত্রকে উত্তরাংশ গ্রহন করে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে, অপরদিকে দক্ষিণ কমিউনিজম-বিরোধী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অবলম্বন করে। অচিরেই উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে শুরু হয়ে যায় ভিয়েতনাম যুদ্ধ। এ যুদ্ধে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন উত্তর ভিয়েতনামের পক্ষ নেয়। পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে দক্ষিণকে।
একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষ নিয়ে সরাসরি রণাঙ্গনে নেমে যায়। এ যুদ্ধে টন টন বোমা ফেলা হয়েছে। বহু মানুষ জীবন হারিয়েছে। যে ধ্বংসযজ্ঞ সাধিত হয়েছে তার কোনও লেখাজোকা নেই। অবশেষে ১৯৭৫ সালে এ যুদ্ধে উত্তর ভিয়েতনাম জিতে যায়। পরের বছর উভয় ভিয়েতনাম মিলে একক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠিত হয়।
তবে এই যুদ্ধজয় ভিয়েতনামের জন্য শেষ কথা হয়ে ওঠেনি। এর মাধ্যমে দেশটি শান্তির পথে এগুতে পারেনি। পরে চীন ও কম্বোডিয়ার মতন মিত্রদেশের সঙ্গেও তাদেরকে যুদ্ধ করতে হয়। অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক কমান্ড ইকোনমি ভিয়েতনামকে দারিদ্রের চক্রব্যুহে বেঁধে ফেলে। এ অবস্থাকে মেনে নিয়ে চুপ করে বসে থাকেনি তারা। শাসন ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সমাজতান্ত্রিক আদল বজায় রেখে তারা অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে ফ্রি মার্কেট ইকোনমি গ্রহন করে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সহযোগিতা গ্রহন এবং তাদের আরোপ করা অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহার করানো সম্ভব হয়।
প্রায় একঘরে হয়ে পড়া ভিয়েতনাম ডগমেটিক ও অনমনীয় মনোভাব ছেড়ে অতীতের তিক্ততা ও ক্ষতকে পাশ কাটিয়ে বাস্তববাদী হবার কারণেই বৈশ্বিক অর্থনীতি ও রাজনীতির অঙ্গনে তাদের পক্ষে পুনরায় পদার্পণ করা সম্ভব হয়েছে। শাসন পদ্ধতিতে স্বৈরতন্ত্র এবং ব্যাপক দুর্নীতির ছায়া থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারলে পূর্ব এশিয়ায় বিষ্ময়কর সাফল্যের মডেল হতে পারে ভিয়েতনাম।
এটাই বাস্তবতা ও প্রয়োজনের নীরিখে সত্যিক্যারের কূটনীতি। এর মধ্যে আবেগ, স্মৃতিকাতরতা, ইতিহাসের কোটরবাসী হবার মানসিকতার কোনও স্থান নেই। এক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে ব্যক্তি ও আদর্শের উর্ধেও স্থান দিতে হয় অনেক সময়। দক্ষ, অভিজ্ঞ, বড়ো ও সাবলকেরাই কেবল জাতীয় স্বার্থে এতোটা নির্মোহতার পরিচয় দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনাম উভয় দেশই রক্ত ও ধ্বংসের স্মৃতি পেরিয়ে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক পুনর্লিখনে সেই নির্মোহতার পরিচয় দিতে পেরেছে।
এই লেখা যখন লিখছি তখন জি-২০ সামিটে শেখ হাসিনার পারিবারিক বলয়ের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের তোলা সেলফি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম। আওয়ামী শাসক মহল এই সেলফিকে তাদের মস্ত রাজনৈতিক সাফল্য এবং তাদের প্রতিপক্ষের জন্য মস্ত বড়ো হতাশার ঘটনা বলে তারস্বরে প্রচার করে চলেছে। প্রতিপক্ষও নানা রকম বিশ্লেষণ হাজির করছে। এ নিয়ে আমি আমার নিজের পর্যবেক্ষণটুকু সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের হাসিনা রেজিমের সম্পর্ক যে খুব খারাপ যাচ্ছিল তা’ সকলেরই জানা। গণতন্ত্র সন্মেলনে দাওয়াত না দেয়া, র্যাব-এর ওপর স্যাংকশন, নানা প্রক্রিয়ায় প্রভাবশালী মার্কিনীদের ব্যক্ত প্রতিক্রিয়া, ভিসা রেস্ট্রিকশন, আমেরিকা সফরকালে হাসিনাকে উল্লেখযোগ্য কারো সাক্ষাতের সুযোগ না দেয়া এবং দলে দলে আসা মার্কিন কর্মকর্তা ও ঢাকাস্থ দূতাবাসের তৎপতার মধ্য দিয়ে তা’ অনেক দিন ধরেই স্পষ্টই দৃশ্যমান হয়ে আসছে।
এ অবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে হাসিনা রেজিম তাদের আঞ্চলিক মুরুব্বি মোদি সরকারের কাছে সর্বাত্মক সহায়তা প্রার্থনা করে আসছিল। কিন্তু তারাও তেমন সুবিধা করতে পারছিল না। জি-২০ সামিটকে মোদি সরকার এ ব্যাপারে একটি শেষ চেষ্টার উপলক্ষ হিসেবে গ্রহন করে। এ শীর্ষ সন্মেলনে শেখ হাসিনাকে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিমন্ত্রণ করা হয়। সামিটের সমন্বয় ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। ঢাকার পর শ্রিংলা যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। এরপর পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালন করে অবসরে গিয়েছেন। এই সামিটে তার অন্যতম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে শেখ হাসিনার যাতে ইন্টার্যাকশনের সুযোগ সৃষ্টি হয় তার পটভূমি রচনা করা।
এ রকম একটা সুযোগের জন্য মুখিয়ে ছিলেন শেখ হাসিনা। কন্যা-ভগ্নি-ভাগ্নেকে নিয়ে অনেকটা পারিবারিক আবহ ছিল তার এ সফরে। দেশ নয়, পরিবারের স্বার্থ, নিরাপত্তা ও কল্যাণই যে তার কাছে সব কিছুর ওপরে, তা তিনি এ আন্তর্জাতিক ফোরামে আবারো দৃশ্যমান করেছেন।
জি-২০ সামিট চলাকালে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে শেখ হাসিনার একটু কথা বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্টনি ব্লিনকেনের কাছে আরজি পেশ করেন ডক্টর আবদুল মোমেন। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রের কূটনৈতিক টিমের শীর্ষনেতা তাকে নিয়ে যান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে ড. মোমেন তাঁকে বলেন : “আমার প্রধানমন্ত্রী আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চান।” ঝানু রাজনীতিক বাইডেন তাতে সন্মতি দেন এবং হাসিনা পরিবারকে তাঁর সঙ্গে দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিট কথা বলার সুযোগ দেন। বাংলাদেশের কূটনীতিক জিয়াউদ্দীন তার সেলফোন ক্যামেরায় এ দৃশ্য ধারণের উদ্যোগ নেন। এ সময় তার হাতে থেকে সেলফোনটি নিয়ে নেন মি. বাইডেন এবং বলেন, আমিই সেলফি তুলে দিচ্ছি।
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সেলফি তোলার এই হোলো পটভূমি। এটা কি নিছকই একটা সেলফি তোলার ঘটনা? শুধুই সৌজন্য? এর পেছনে কি কোনও কূটনীতি নেই? আমি মনে করি, অবশ্যই আছে। মি. বাইডেনের মতন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিদেশে একটি আন্তর্জাতিক সন্মেলনে এসে উদ্দেশ্যহীন কোনও আনুষ্ঠানিকতা করেন বলে আমার অন্ততঃ মনে হয় না।
ভারত যে জি-২০ সামিটে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে শেখ হাসিনার কথাবার্তার একটা পরিবেশ তৈরিতে সচেষ্ট ছিল তা কি মার্কিন প্রশাসন টের পায়নি? নিশ্চয়ই পেয়েছে। এটা এড়াতে চাইলে অনেক ছুতাই তারা বের করতে পারতেন। ড. মোমেন এ আর্জি নিয়ে প্রথমে ব্লিনকেন ও পরে বাইডেনের কাছে যান। তখনো তারা নানান অজুহাতে মানা করতে পারতেন। কিন্তু তারা তা’ করেননি। এর অর্থ, বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশে হাসিনা রেজিমের দিকে দরোজা পুরোপুরি বন্ধ করতে চায়নি। তাছাড়া হাসিনাকে কথা বলার সুযোগ দেয়ার ব্যাপারে সেক্রেটারি অব স্টেট তার সায় দিয়েছেন প্রেসিডেন্টের কাছে ড. মোমেনকে নিয়ে যাবার মধ্য দিয়ে।
বিশ্বের সব চেয়ে শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন কোনও কিছুই ব্যক্তিগত রাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে করেনা। দক্ষিন এশিয়ার এক দুর্বল রাষ্ট্র বাংলাদেশের হাসিনা রেজিমের সঙ্গে তাদের কোনও ব্যক্তিগত শত্রুতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতাও নেই। বাইডেন প্রশাসনের বাংলাদেশ সংক্রান্ত বর্তমান নীতি তাদের জাতীয় স্বার্থ, বিশ্ব পরিস্থিতির বিশ্লেষণ এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক নির্ণয়ের মূল্যবোধভিত্তিক শর্তের আলোকে গৃহীত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাৎক্ষণিক বা পরিকল্পিত কূটনৈতিক কোনও পদক্ষেপই এর বাইরে হতে পারে না।
গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন, মানবাধিকার, ভিন্নমতের অবাধ প্রকাশ, সিভিল সোসাইটির বিকাশ, মিডিয়ার স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাইডেন প্রশাসন হাসিনা রেজিমের ওপর অব্যাহতভাবে চাপ দিয়ে আসছে। এই পরিবেশের মধ্যেও বাইডেনের সেলফি কূটনীতি শেখ হাসিনাকে কাছাকাছি আসার সুযোগ দেয়ার মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট একটা ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, কেউই যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী শত্রু বা মিত্র নয়। এমনকি হাসিনাও নন।
কমিউনিস্ট ভিয়েতনাম তার অর্থনৈতিক নীতি বদল করে মুক্ত বাজার নীতি গ্রহন করায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের ওপর থেকে অবরোধ তুলে নিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। হাসিনাও যদি মার্কিন শর্তাবলীর কাছে নত হয়ে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকারের নিশ্চয়তা, সুষ্ঠু নির্বাচন, নাগরিক স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের পথে পা বাড়াতে রাজি হন তাহলে স্যাংশনসহ অন্যান্য বিধিনিষেধ উঠে যাবে এবং মার্কিন সহায়তা অব্যাহত থাকবে। এতে আমেরিকার উদ্দেশ্য পূরণ হবে এবং বাংলাদেশের মানুষ জয়যুক্ত হবে।
এটার সম্ভাবনা যে খুব কম তা’ আমেরিকাও জানে। তাদের অজানা নয় এই রেজিমের চরিত্র। এই সেলফিকেই যে আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক বাণিজ্যের পণ্য করতে পারে, সেই সম্ভাবনাও তাদের অজানা থাকার কথা নয়। সব জেনে শুনেই তারা হাসিনা রেজিমকে এই সেলফি অপরচুনিটি ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে বলে আমার মনে হয়।
ভারতকে দিয়েও মার্কিন চাপ লঘু করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হাসিনা রেজিম কিছুদিন ধরেই সবখানে আমেরিকা-বিরোধী একটা জিঙ্গোইজম জারি করেছিল। এমন কোনও অভিযোগ নাই যা তারা উত্থাপন করেনি। যুক্তরাষ্টের অতীত ও বর্তমান ভূমিকার এমন কোনও সমালোচনা ও নিন্দা নাই যা তারা করেনি। এখন এই এক সেলফিতেই বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন এই বলয়কে পুরোপুরি মার্কিন নেকনজর প্রার্থী হিসেবে প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে। আওয়ামী লীগ নিজেরাই প্রচার করছে অন্য কেউ নয়, বাংলাদেশে তারাই সবচেয়ে বেশি মার্কিন-ঘনিষ্ঠ।
এই সেলফি কূটনীতির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বাংলাদেশের আওয়ামী বলয়ের মার্কিন-বিরোধী প্রচারণায় পানি ঢেলে দিতে পেরেছেন। আওয়ামী লীগের মুখ দিয়েই বলাতে পেরেছেন যে, মার্কিন প্রশাসন বিএনপি ও ডক্টর ইউনুসের প্রতি ঝুঁকে নেই; হাসিনা পরিবার ও আওয়ামী লীগেরও ঘনিষ্ঠ মিত্র।
এই চিত্রের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশে তাদের পক্ষপাতহীনতা প্রমাণ করেছে। মার্কিন শর্তানুযায়ী যদি হাসিনা রেজিম স্বৈরাচারের রাস্তা ছেড়ে দেশে দ্রুত গণতান্ত্রিক সমঝোতার পথে পা না বাড়ায় তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের এই নিরপেক্ষ অবস্থান আরও অনেক কঠিন পদক্ষেপ গ্রহনকে যৌক্তিক করবে। একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে আমার মনে হয়, খুব শিগগিরই সেই কঠিন কার্যব্যবস্থাগুলো আসতে শুরু করবে।