বাঙালি কাউকে ঘৃণা করলে তাকে ভালোবাসতে জানে না

:: মহিউদ্দিন মোহাম্মদ ::

সমরেশ মজুমদার, মানিক বন্দোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদ, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, ও এডওয়ার্ড সাঈদ ইস্যুতে যে-জরিপ আমি চালিয়েছি, তার চূড়ান্ত ফলাফল নিচে প্রকাশ করা হলো। জরিপে বাঙালির চিন্তাভাবনা, সহনশীলতা, ও মূর্তিপূজার যে-চিত্র পেয়েছি, তা সুখকর নয়।

বাঙালি একবার কাউকে ঘৃণা করলে, তাকে আর ভালোবাসতে জানে না। সে ভালোবাসাকে ঘৃণায় পরিণত করতে পারে মুহুর্তেই, কিন্তু ঘৃণাকে সে কখনোই ভালোবাসায় পরিণত করতে পারে না। বাঙালির এ এক চিরায়ত অক্ষমতা।

১।

বাংলাদেশে ধর্মান্ধ শব্দটি ভুলভাবে ব্যবহৃত হয়। শব্দটি যারা ব্যবহার করেন, তারা মনে করেন, মানুষ শুধুমাত্র ধর্ম বিষয়েই অন্ধ হয়। এটি সত্য নয়। আমি দেখেছি, মানুষ তার পছন্দের লেখক, রাজনীতিক নেতা, দার্শনিক, গায়ক, অভিনেতা, মতবাদ, পীর, কবি, ফেমিনিস্ট, সেলেব্রিটি, এসব বিষয়েও অন্ধ হয়। কিন্তু এ অন্ধত্ব তারা ধরতে পারে না। ভাবে, ধর্মই একমাত্র অন্ধ হওয়ার মতো বিষয়। অর্থাৎ সাহিত্যান্ধ, মানিকান্ধ, হুমায়ূনান্ধ, লালনান্ধ, মার্ক্সান্ধ, রবীন্দ্রান্ধ, নজরুলান্ধ, ও আরও এক হাজার রকম অন্ধ যে এ দেশে আছে, সে-খবর আমরা একেবারেই রাখছি না। ফলে মনের অন্ধত্বের একটি একরৈখিক ধারণা সমাজে বিস্তার লাভ করেছে।

২।

বই পড়লে অন্ধত্ব ঘোচে, এ ধারণা সঠিক মনে হয় নি। আমি লক্ষ করেছি, বই পড়ুয়া মানুষরাই এ দেশে বেশি অন্ধ। এর পাঁচটি কারণ থাকতে পারে বলে মনে করি। এক— তারা বই পড়ে না, শুধু বই পড়ার অভিনয় করে। দুই— তারা বইয়ের নামে অবই পড়ে। তিন— তারা বই পড়ে, কিন্তু বইয়ের বিষয়বস্তুকে কোনো প্রশ্ন করে না। পাঁচ— ছাপা অক্ষরে লেখা সব বাক্যকেই তারা চোখ বুজে বিশ্বাস করে।

এ ক্ষেত্রে কেইস ইগজাম্পল হিশেবে আমি বন্ধুতালিকার কিছু বই পড়ুয়া মানুষের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করেছি, যারা ধর্মান্ধ নন। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করেছি, কোনো না কোনো বিষয়ে তাদের অন্ধত্ব আছে। কেউই বইয়ের আঘাতে মনের চক্ষু খুলতে পারেন নি।

৩।

অধিকাংশ বাঙালিই মূর্তিপূজারী। হ্যাঁ, তারা প্রতিমাপূজা করে না, কিন্তু ভাবমূর্তিপূজা করে। কারও উপাস্য মূর্তির নাম মানিক, কারও মূর্তি হুমায়ূন, কারও আব্দুর রাজ্জাক, কারও এডওয়ার্ড সাঈদ, কারও বা লালন ফকির। মূর্তির বিরুদ্ধে তারা কোনো কথা বলতে ও শুনতে প্রস্তুত নয়। বাংলাদেশে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ নামে একটি আইন আছে, যার মূল কারণ মূর্তিপূজা। কিছু নির্দিষ্ট মূর্তির বিরুদ্ধে যেন মানুষ কথা বলতে না পারে, এ জন্য এ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রবক্তারা ক্ষমতাবান। কিন্তু মানিক বা আব্দুর রাজ্জাকপূজারীরা ক্ষমতাহীন। উভয় শ্রেণীরই কিছু ‘এভেইলেবল পাওয়ার’ আছে। আমি লক্ষ করেছি, উভয় শ্রেণীর লোকই নিজ নিজ ‘এভেইলেবল পাওয়ার’-এর সর্বোচ্চটুকু প্রয়োগ করার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ পছন্দের মূর্তির ‘ভাবমর্যাদা’ অক্ষুণ্ণ রাখতে কেউ করেন মামলা, কেউ করেন গালাগালি। ফলে বলা যায়, ক্ষমতা চর্চায় উভয় শ্রেণীর মানসিকতাই এক। বিরোধী কন্ঠকে স্তব্ধ করে দাও।

৪।

অধিকাংশ বাঙালি বাংলা পড়তে পারে না (মেট্রিক ফেল বাঙালি নয়, আমি বলছি মাস্টার্স পাশ স্নাতক বাঙালির কথা)। ‘এটাকিং ল্যাঙুয়েজ’-কে ‘র‍্যাশোনাল ল্যাঙুয়েজ’-এ কনভার্ট করতে তারা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ। টেক্সটের অবজেক্টিভ ইন্টারপ্রিটেশনেও তারা ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। ফলে শব্দ ও বাক্যের অর্থ তৈরিতে সহজেই তারা ইমপালসিভ হয়ে ওঠে। ইমপালস ও র‍্যাশোনেল, এ দুটি কোনো মানুষের ভেতর একই সময়ে একসাথে অবস্থান করতে পারে না। এ জন্য কোনো বাক্য ও অনুচ্ছেদ, দীর্ঘ হোক বা সংক্ষিপ্ত, বাঙালি ধীরস্থিরভাবে ইন্টারপ্রিট করতে পারে না। সে শুরুতেই ধরে নেয়, লেখকের বুদ্ধির চেয়ে তার বুদ্ধি বেশি। অভ্যাসের ধাক্কাও সে পাশ কাটাতে পারে না। অনেক কিছুকেই সে ইন্টারপ্রিট করে অভ্যাসগতভাবে, এবং অভ্যাসের দাসত্বকে সে অস্বাভাবিক মনে করে না।

৫।

আমাদের চারপাশে গিজগিজ করে অসংখ্য পরিপাটি ভদ্রলোক। কিন্তু তাদের অনেকের ভেতরই ঘাপটি মেরে আছে লাল কর্কশ অভদ্রলোক। কেউ কেউ বন্ধু সেজে পালন করেন সিসিটিভির ভূমিকা। বুকে পুষে রাখেন তুষের আগুন। এ আগুন কিছুটা বের করে আনতে পেরেছি। ফলে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, বন্ধু হিশেবে ফেসবুক বন্ধুরা নির্ভরযোগ্য নন। পূর্ব পরিচয় না থাকলে, এবং অপরপক্ষ থেকে নির্ভরতা-নির্দেশক কোনো কানসিস্টেন্ট আচরণ প্রকাশিত না হলে, ফেসবুকে কারও সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়া উচিত নয়। কারণ অভিনেতা বন্ধুর চেয়ে ঘোষিত শত্রু উত্তম। আমি লক্ষ করেছি, বাহিরে বাহিরে তীব্র ভদ্রলোক, এমন সব শিক্ষক, অধ্যাপক, পুলিশ, আমলা, সাংবাদিক, লেখক, তাদের অনেকের ভেতরই একটি করে তীব্র অভদ্রলোক লুকিয়ে আছে।

৬।

বাংলাদেশের মানুষ শিল্প-সাহিত্য বিচারে স্বাদ বা সেনসেশনকে অধিক প্রাধান্য দেয়। ভালো লাগা ও ভালো না লাগা, এ দুটি দিয়ে তারা বিচার করতে বসে সাহিত্যকর্মের। মিডিয়ার তৈরি ন্যারেটিভকেও তারা পূজনীয় ভাবে। কারও লেখা ‘ভালো লেগেছে’ মানেই তার লেখা শিল্প হয়ে উঠেছে— এমনই তাদের মনোভাব। যেমন, এখানে কাউকে যদি নবোকভের ললিতা আর কাসেম বিন আবু বকরের ফুটন্ত গোলাপ পড়তে দেওয়া হয়, তাহলে অনেকেই ললিতা ‘অশ্লীল, ভালো লাগে নি’ বলে এটির বদনাম করবে, এবং প্রশংসা করবে ফুটন্ত গোলাপের। কারণ ন্যারেশনের লিটারারি বিউটি অনুধাবন করার ক্ষমতা তার নেই। আছে শুধু স্বাদ অনুধাবন করার ক্ষমতা। ভালো না লাগলেও যে একটি লেখা শিল্পমান বা চিন্তামানের দিক দিয়ে প্রশংসনীয় হতে পারে, এ বোধটুকুই বাঙালি সমাজে নেই। গাজ্জালি, একুইনাস, ও নিটশার লেখা আমার ভালো লাগে না, তাই বলে আমি তাঁদের চিন্তাশক্তি ও লিটারারি মাস্টারির প্রশংসা করতে কার্পণ্য করি না। কারণ আমি সেনসেশন থেকে আর্টকে আলাদা করতে জানি।

৭।

পক্ষের কথাকে এ অঞ্চলে কেউ চ্যালেঞ্জ করে না, কিন্তু বিরোধীমতের কথাকে সহজেই চ্যালেঞ্জ করা হয়। যেমন, কেউ যদি কোনো লেখকের নিন্দা বা সমালোচনা করে, তাহলে অনেকেই ‘নিন্দা ও সমালোচনার’ কারণ জানতে চাইবে। কিন্তু যখন প্রশংসা করা হয়, তখন তারা কোনো কারণ জানতে চাইবে না। অর্থাৎ প্রশংসা কোনো প্রশ্নযোগ্য বিষয় নয়, শুধু সমালোচনা বা নিন্দাই প্রশ্নযোগ্য, এমন একটি ধারণা এ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কে প্রশংসা করলো, কেন প্রশংসা করলো, প্রশংসা করার যোগ্যতা তার আছে কি না, কোনো কিছু প্রশংসনীয় নাকি নিন্দনীয়— তা বুঝার ক্ষমতা তার রয়েছে কি না, এসব প্রশ্ন বাঙালি করে না। শুধু নিন্দা বা সমালোচনা শুনলে বাঙালি বলে, তার সমালোচনা করার যোগ্যতা আপনার আছে? কিন্তু ‘তার প্রশংসা করার যোগ্যতা আপনার আছে?’— এ ধরনের প্রশ্ন বাঙালি করে না।

৮।

বাংলাদেশের মানুষ ভক্তিপ্রবণ। তারা ভুল কারণে ভুল লোককে ভক্তি করতে পছন্দ করে। অতীতে কে কবে রটিয়েছে— অমুক খুব মহান লেখক, এ কথা বাঙালি চিরকাল মেনে চলবে। কেউ প্রশ্ন তুললে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। অর্থাৎ কোনো বিষয়ে ‘স্ট্যাটাস কো’ বা স্থিতাবস্থা বজায় রাখা বাঙালির খুব পছন্দের কাজ। সে নিজে বিচার-বিশ্লেষণ করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। সে চায় নবীকরণ বা প্রফেটাইজেশন। কাল্ট বা প্রশ্নাতীত মূর্তি কীভাবে জন্ম নেয়? ভক্তিবাদ থেকে। শ্রদ্ধা ও ভক্তি এক জিনিস নয়। কাউকে ভক্তি না করা মানে এই নয় যে তাকে অশ্রদ্ধা করা। মানিক, সমরেশ, হুমায়ূন, সাঈদ, আব্দুর রাজ্জাক, তাঁদের প্রত্যেককেই আমি শ্রদ্ধা করি, যেরকম শ্রদ্ধা করি একজন সাধারণ কৃষককে। কিন্তু কাউকেই আমি ভক্তি করি না বলে মানুষ ধরে নেয় কাউকে আমি শ্রদ্ধাও করি না। ফ্যাসিবাদের জন্ম ভক্তিবাদ থেকে। এ জন্য ভক্তিবাদের আমি এতো বিরোধিতা করি।

৯।

বাঙালি শিল্পকর্ম থেকে শিল্পীকে আলাদা করতে জানে না। ধরা যাক আমি মানিকের লেখাকে তাচ্ছিল্য করেছি। বাঙালি ধরে নেবে আমি মানিককে তাচ্ছিল্য করেছি! অর্থাৎ আর্ট ও আর্টিস্টের ইন্ডিপেন্ডেন্ট এক্সিস্টেন্সে সে বিশ্বাস করে না। এ জন্য সে কুতুব আলির সাহিত্যকর্মের সমালোচনায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে কুতুব আলির ব্যক্তিগত চরিত্র ও একাধিক বিয়ের প্রসঙ্গ টেনে আনবে। ফলে যেকোনো তর্কে, বাঙালির আর্গুমেন্ট সহজেই ভরে ওঠে অ্যাড হোমিনেম ফ্যালাসিতে। রিজোনিংয়ের চাইতে এবিউজিভ ল্যাঙুয়েজে, অর্থাৎ গালাগালিতেই তাদের অধিক আস্থা।

১০।

বাঙালি একবার কাউকে ঘৃণা করলে, তাকে আর ভালোবাসতে জানে না। সে ভালোবাসাকে ঘৃণায় পরিণত করতে পারে মুহুর্তেই, কিন্তু ঘৃণাকে সে কখনোই ভালোবাসায় পরিণত করতে পারে না। বাঙালির এ এক চিরায়ত অক্ষমতা।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *