:: সাইদুর রহমান ::
জমিদার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্দশ সন্তান ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ পরে তার আরেকটি সন্তান হয়েছিলো কিন্তু বাঁচেনি, তাই কবি হলেন সর্বকনিষ্ঠ সন্তান৷ বাবার ইচ্ছে ছিলো ছেলে ইংল্যান্ড গিয়ে ব্যরিস্টারি পড়ুক৷ ইংল্যান্ডে গিয়ে চলনে- বলনে, আচার -আচরণে যাতে কোন সমস্যায় পড়তে না হয় সেজন্য তিনি রবীন্দ্রনাথকে মেজোপুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে বোম্বে পাঠান৷
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম বাঙ্গালী আইসিএস (বিসিএস)৷ আচার-আচরণে, চলনে-বলনে তিনি ছিলেন পাক্কা ইউরোপিয়ান৷ তাকে বাঙ্গালী সমাজের প্রথম আধুনিক পুরুষও বলা হয়৷ স্ত্রীকে নিয়ে তিনি এমন কিছু কান্ড করেছেন যা তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজে কল্পনাও করা যেত না৷ তিনি ভাবলেন তার ভাইটিকে এমন একজন শিক্ষকের হাতে তুলে দিবেন, যে তার বাঙালি সুলভ লাজুকতা দূর করে পরে ইউরোপীয়ান হিসেবে গড়ে তুলবে৷
বোম্বেতে কৃষ্ণমোহন নামে এক মারাঠি ব্যক্তির সাথে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধুত্ব ছিলো৷ কৃষ্ণমোহন সংস্কৃত ভাষায় পন্ডিত হয়েও খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন৷ আন্না তড়খড় (অন্ন পূর্ণা) নামে ইংল্যান্ড ফেরত তার এক ভাতিজি ছিলো৷ সত্যেন্দ্রনাথ ১৯ বছর বয়সী আন্নাকে তার ১৭ বছরের ভাইয়ের শিক্ষিকা হিসেবে নিযুক্ত করলেন৷ রবীন্দ্রনাথের সাথে আন্নার বয়সের ব্যবধান, ভাষার ব্যবধান, গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক সবকিছুই প্রেমের রাজত্বে হারিয়ে গেলো৷
আন্নার সাথে পরিচয় নিয়ে কবি বলেছেন- “চাঁদনি রাত, চারদিকে সে যে কী অপরূপ আলো-হাওয়া, কিন্তু আমি তখনও ভাবছি বাড়ির কথা৷ সে এসে একেবারেই আমার নেয়ারের খাটেক উপরই বসল৷ হঠাৎ বলল, আমার হাত ধরে টানো তো, টাগ অব ওয়ারে দেখি কে জিতে?” তারপর কি হলো? কে জিতলো? সে কথা কবি বলেননি, আমরাও জানিনা৷ কিছু গোপন কথা সবাইকে বলাও যায় না৷ রবীন্দ্রনাথ আন্নার নাম দিয়েছিলেন নলিনী৷ আন্নাকে উৎসর্গ করে কবি লিখলেন-
“শোনো নলিনী খোলো গো আঁখি,
ঘুম এখনও ভাঙ্গিল না কি!
দেখো তোমারই দুয়ার ‘পরে
সখি, এসেছে তোমারই রবি৷”
এর এক বছর পর কবি ইংল্যান্ড গেলেন৷ সেখানে স্কট দম্পতির বাসায় উঠেন৷ স্কট দম্পতির ছিলো চার মেয়ে৷ তাদের বড় মেয়ে এবং ছোট মেয়ে দু’জনে এক সাথে কবির প্রেমে পড়ে৷ কবি পড়লেন উভয় সঙ্কটে কোনটা ছেড়ে, কোনটা ধরবেন! যে কোন ভাবে কিছুদিনের মধ্যে এ অসহনীয় অবস্থার অবসান ঘটে৷ ছোট মেয়ে লুসি স্কট হয়ে উঠলেন কবির প্রেমিকা৷ লুসিকে উদ্দেশ্য করে লিখলেন-
“সাহসের উদ্বেলতায় আকুল হয়ে
প্রতি অঙ্গ কাঁদে তব প্রতি অঙ্গ তরে৷”
কবির প্রতি অঙ্গ লুসির প্রতি অঙ্গ স্পর্শ করেছিলো কি না সেকথা কবি বলেন নি! কিন্তু আমরা জানি, ইংল্যান্ডের আবহাওয়া বাংলার মত নয়৷ সেখানে শারীরিক মিলন অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা৷ মা-বাবাও এতে বাধা দেয় না৷ সেখানে আরো তিন-তিনটি বিদেশিনী কন্যা রবীন্দ্রনাথের আকুল আহবানে সাড়া দিয়েছিলো৷ বিলেতি কন্যার প্রতি কবির বিশেষ দূর্বলতা ছিলো৷ আর সেজন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন-
“শ্রীযুক্ত দেশানুরাগ যদি পারেন তো আমাকে ক্ষমা করবেন, আমার বিশ্বাস ইংরাজ মেয়েদের মত সুন্দরী পৃথিবীতে নেই৷ নবনীর মতো সুকোমল শুভ্র রঙ্গের উপর একখানি পাতলা টুকটুকে ঠোঁট, সুগঠিত নাসিকা, এবং দীর্ঘ পল্লব বিশিষ্ট নির্ম্মল নেত্র দেখে পথ কষ্ট দূর হয়ে যায়৷”
চার বছর পর অর্থাৎ একুশ বছর বয়সে কবি ফিরে এলেন আপন গৃহে৷ সদ্য কৈশোর পেরানো এক বর্ণচোরা ছেলেকে বাবা বিলেত পাঠিয়েছিলেন ব্যারিষ্টারি পড়তে; কিন্তু তিনি ফিরে এলেন প্রেম গুরু হয়ে৷ ঠাকুর বাড়িতেই প্রেমের পাঠশালা খুলে বসলেন৷ এই পাঠশালায় কে গুরু, কে শিষ্য বোঝা দায়!
কবির বয়স যখন সাত, তখন নয় বছর বয়সী কাদম্বরী ঊনিশ বছর বয়সী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বৌ হয়ে ঠাকুর বাড়িতে এসেছিলেন৷ প্রায় সমবয়সী হওয়ার কারণে অতি সহজেই রবীন্দ্রনাথকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন কাদম্বরী দেবী৷ মাতৃহীন রবীন্দ্রনাথ নতুন বৌয়ের মাঝে এক নতুন মায়ের সন্ধান পেয়েছিলেন৷ কাদম্বরী পেয়েছিলেন তার বালিকা সুলভ খেলার সাথী৷ ধীরে ধীরে জমে উঠলো মান-অভিমানের পালা৷ কবির ভাষায়-
“স্কুল থেকেই ফিরে এলেই বউঠাকুরণ ভাত যেদিন মেখে দিতেন অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে, সেদিন আর কথা ছিল না৷ মাঝে মাঝে যখন আত্মীয় বাড়িতে যেতেন, ঘরের সামনে তাঁর চটি জুতো জোড়া দেখতে পেতুম না৷ তখন রাগ করে ঘরের থেকে একটা কোনো দামী জিনিস লুকিয়ে রেখে ঝগড়ার পত্তন করতুম৷”
কবির নানান রঙ্গের সেই দিনগুলি গত হয়েছে৷ শৈশবের খেলার সাথীকে যৌবনে নতুন করে আবিষ্কার করলেন৷ যৌবনে বসন্তের উম্মাদ হাওয়ায় নিত্য নতুন কবিতা লিখে চমকে দিতে চাইছেন বৌঠানকে৷ দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাথে বসে গান লিখছেন, সুর করছেন, নাটক লিখছেন৷ কিন্তু যার জন্য এত লেখা এত গান তার মুখ থেকে একের পর এক তিরষ্কারের বাণ ছুটে আসছে৷ এ বিষয়ে কবি বলেন-
“বউ ঠাকুরণের ব্যবহার ছিলো উলটো৷ কোনোকালে আমি যে লিখিয়ে হব, এ তিনি কিছুতেই মানতেন না……৷ যতই লেখো না কেন, বিহারীলালের মতো লেখা তোমার দ্বারা কখনোই সম্ভব নয়৷”
প্রিয় বউ ঠাকুরণকে খুশি করতে বিহারী লালের মতও লিখলেন, কিন্তু সে লেখাকেও কাদম্বরী ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিলেন৷ কবির লেখক সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলার জন্যই কাদম্বরীর এই প্রহসন৷ কাদম্বরীর ফুৎকারের লেখক সত্ত্বার সাথে সাথে কবির মনের অনলও জ্বলে উঠলো৷ সে অনলে ঠাকুর বাড়ির মান সম্মান পুড়তে লাগলো৷ এমনিতেই ঠাকুর বাড়ির অনেক বদনাম৷ সাধারণ জনগণ সামনে কিছু না বললেও, পেছনে মিটিমিটি হাসে৷ পাছে লোকে কিছু বললে কিছু যায় আসে না, কিন্তু বাইরের নষ্টামি ঘরে আসলেতো আর সহ্য করা যায় না৷
এখনকার দিনের অভিভাবকরা ছেলে-মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করলেও সেকালের অভিভাবকরা ঠিকই বুঝতেন, নষ্টামির মুলোৎপাটনের জন্য বিয়ের কোন বিকল্প নেই৷ ১৮৮৩ সালের নয় (৯) ডিসেম্বর খুলনার কুলতলির নয় বছরের বালিকা তেইশ বছরের কবির বধূ হয়ে প্রবেশ করলেন ঠাকুর বাড়িতে৷ বালিকার নাম ছিলো ভবতারিণী, রবীন্দ্রনাথ তার নাম দিলেন মৃণালিনী৷ বাড়ির ছোট বউ বলে তার ডাক নাম দেওয়া হলো ছুটি৷
কাদম্বরী দেবী বুঝতে পারলেন, তার সাধের দেবর বৈধ সঙ্গিনী পেয়েছেন৷ এবার রবীন্দ্রনাথের জীবন থেকে তার সরে যাবার সময় হয়েছে৷ তার সম্পর্ক অনৈতিক, এ প্রেমের কোন ভবিষ্যত নেই, কখনো স্থায়ীত্ব পাবে না৷ পরকীয়া প্রেমের নায়িকা হিসেবে তার গলায় কলঙ্কের মালা ঝুলবে৷ যে পুরুষটিকে তিনি দেহ, মন, প্রাণ সঁপে সত্যিকার অর্থে ভালোবেসেছেন, নিজের চোখের সামনে সে অন্যের শয্যাসঙ্গিনী হবে! রোজ রোজ এমন দৃশ্য দেখার চেয়ে মরনও ভালো৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিবাহের মাত্র চার মাসের মাথায় কাদম্বরীর মৃত্যু হয়৷
কেউ বলেন কাদম্বরী আফিম খেয়েছেন, কেউ বলেন বিষ৷ আবার কেউ কেউ মনে করেন ঠাকুর বাড়ির সম্মান রক্ষার্থে তাকে খাবারে বিষ প্রয়োগ, অথবা গলায় দড়ি ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ এই মৃত্যুকে ঘিরে অনেক রকম জল্পনা-কল্পনা আছে৷ সেই বৃটিশ আমলেও কাদম্বরীর লাশের কোন পোস্টমর্টেম হয়নি, এই হত্যা নিয়ে পত্রিকায় কোন রিপোর্টও প্রকাশিত হয়নি৷ কারণ মীর জাফরের চেয়েও প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন ইংরেজদের অধিক প্রিয়৷ বলতে পারেন ভারতবর্ষের অঘোষিত সরকার৷ তাই ঠাকুর বাড়ির রোষানলে পড়ে কেউ নিজেকে বিপদে জড়াতে চায়নি৷ আত্মহত্যা বা হত্যা কাদম্বরীর ভাগ্যে যাই ঘটুক, এর জন্য যে রবীন্দ্রনাথ দায়ী এ বিষয়ে সকল গবেষকই একমত৷
রবীন্দ্রনাথের বিয়ের চার বছর তখন পেরিয়ে গেছে, সেই সাথে কাদম্বরীরর প্রয়ানেরও৷ কবির পৃথিবীটা শূন্য৷ ঠাকুর বাড়িটা তার কাছে শশ্মান বলে মনে হয়৷ কবি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল কিন্তু কাকে বলবেন! চৈত্রের খরতাপে পোড়া জমিনে এক পশলা বৃষ্টির মত কবির হৃদয়ের কথা শুনতে এগিয়ে এলেন ইন্দিরা দেবী৷ রবীন্দ্রনাথের আপন ভাইঝি৷ কবির সেই বিসিএস দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ইউরোপিয়ান স্টাইলিস্ট বৌদী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর কন্যা৷
রবীন্দ্র অনুরাগীরা অবশ্য এ প্রেমের তীব্র দহন জ্বালাকে অস্বীকার করেন৷ তারা বলেন মেয়ের বয়সী ইন্দ্রিরাকে রবীন্দ্রনাথ বাৎসল্যরসে ভরা চিঠি উপহার দিয়েছিলেন৷ কিন্তু ইন্দ্রিরা ছিলো কবির পত্নী মৃণালিনী দেবীর সম বয়সী৷ ১৮৮৭—১৮৯৫ আট বছরে কবি ভাইঝি ইন্দ্রিরা দেবীকে ২৫২টি চিঠি দিয়েছেন৷ আর মৃণালিনী দেবীকে দিয়েছেন মাত্র ১৫ টি চিঠি৷ এর কারণ কি?
যারা সাইকোলজি বোঝেন, তারা বুঝতে পারবেন৷ বিলেতি জিনিষের প্রতি কবির বরাবরই দূর্বলতা ছিলো৷ বিলেত ফেরত শিক্ষিত সংস্কৃতমনা ইন্দিরা যেভাবে কবির হৃদয়কে আচ্ছন্ন করেছিলো, বাঙ্গালী বধূ বেচারী মৃণালিনী সেভাবে আকৃষ্ট করতে পারেননি৷ ইন্দিরাকে দেওয়া এক চিঠিতে কবি বলেন-
“তখন বোধহয় যশোরে সুন্দরী মেয়ের আকাল পড়েছিল, কারণ এত খোঁজ করেও বউঠাকুরাণীরা মনের মত কনে খুঁজে পেলেন না৷ তাই অবশেষে তাঁরা জোড়াসাঁকোর কাছাড়ির একজন কর্মচারী বেণী রায় মহাশয়ের অপেক্ষাকৃত বসস্থা কন্যাকেই মনোনীত করলেন৷”
শুরু হল এক অসম দাম্পত্য জীবন৷ কবি বুঝতে পারলেন মৃণালিনী কখনো তার হৃদয় রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হতে পারবে না৷ সে আসন তোলা থাক ভাইঝির জন্য৷ ইন্দিরার সাথে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে? কি হয় নি? রবীন্দ্র আলোচক- সমালোচকরা এ ব্যাপারে নীরব৷ হয়তো জনসাধারণ তাদের মনের মাঝে কবির যে দেবতার চিত্র এঁকেছে, তাতে কালিমালেপন করতে চায়নি বলেই লেখকরা তা সযত্নে এড়িয়ে গেছেন৷ ভাইঝির প্রতি যে তিনি কামাসক্ত হয়েছিলেন সেকথা তার চিঠিতেই বোঝা যায়-
“একবার যদি এই রূদ্ধ জীবনকে খুব উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খলভাবে ছাড়া দিতে পারতুম, একেবারে দিগ্ববিদিকে ঢেউ খেলিয়ে ঝড় বইয়ে দিতে পারতুম, একটা বলিষ্ঠ বুনো ঘোড়ার মতো কেবল আপনার লঘুত্বের আনন্দ-আবেগে ছুটে যেতুম৷ যাকগে, যখন রীতিমতো অসভ্য হওয়া অসাধ্য তখন রীতিমতো সভ্য হওয়াই সঙ্গত৷”
কবির মনের বুনো ঘোড়ার লাগাম টেনে কবি কতটুকু সভ্য হতে পেরেছিলেন? ইন্দ্রিরা দেবীই বা কতক্ষণ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পেরেছিলেন? কাকা রবীন্দ্রনাথের প্রতি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে কি তার হৃদয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়নি? কবি যদি বাঙ্গালী না হয়ে ইউরোপিয়ান হতেন, তাহলে হয়ত এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাঠক ইনসেস্ট প্রেমের রগেরগে একটি উপন্যাস পেত৷ কিন্তু কবির দূর্ভাগ্য মগজে-মননে ইউরোপিয়ান হয়েও বাঙ্গালী সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন৷
কবিগুরুর প্রেমের একমাত্র বৈধ দাবীদার মৃণালিনী দেবী, গ্রাম বাংলার এক আদর্শ বধূর সাথে সাথে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন কবির যোগ্য সহধর্মিনী হয়ে উঠতে৷ ঠাকুর বাড়িতে আসার পর বাংলা, ইংরেজী, সংস্কৃত ভাষা শেখার পাশাপাশি পরিচিত হয়েছিলেন বিভিন্ন দেশের সাহিত্যের সাথে৷ ঠাকুর বাড়িতে তখন থিয়েটারের আয়োজন করা হত৷ এতে ঠাকুর বাড়ির নারী-পুরুষরাই অভিনয় করতেন৷ কাদম্বরী এবং রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতা অনেকটা অভিনয়ের সূত্র ধরে৷ ইন্দ্রিরা দেবীর সাথে ঘনিষ্ঠতাও অভিনয়ের মাধ্যমে৷
কবির মনের মত হওয়ার জন্য মৃণালিনী দেবীও অভিনয় করেছেন৷ কবির অনুপস্থিতে জমিদারি নিয়ন্ত্রণ করেছেন৷ একটা নয় দুইটা নয় পাঁচ পাঁচটি সন্তান কবিকে উপহার দিয়েছেন৷ কবির স্বপ্নের শান্তি নিকেতন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে কঠোর পরিশ্রমে মৃণালিনী দেবী অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ অবশেষে সকল লাঞ্চনা, গঞ্জনা, অবহেলাকে পাশ কাটিয়ে ১৯০২ সালের ২৩ নভেম্বর মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন৷
মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ আর বিয়ে করেননি৷ রবীন্দ্রানুরাগীরা মনে করেন মৃণালিনী দেবীর প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা তাকে আর দ্বিতীয় বিয়েতে উৎসাহিত করেনি৷ কিন্তু সত্যি সত্যি কি তিনি শেষ দিন পর্যন্ত তার স্ত্রীকে মনে রেখেছিলেন?
মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর বছর না ঘুরতেই রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় কন্যা রাণী দেবী মাত্র তের বৎসর বয়সে মারা যায়৷ রবীন্দ্রনাথের ছোট কন্যা মীরা দেবীর ভাষ্যমতে, রাণী ছিলো প্রচন্ড জেদী, একরোখা, সাহিত্যানুরাগী৷ গল্প, উপন্যাস পড়তে ভালোবাসত৷ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাকে স্কুলে কিংবা বাসায় শিক্ষক রেখে পড়াননি৷ নিজের চেষ্টাতেই সে বাড়ির কারো কাছ থেকে পড়তে শিখেছিলো৷ দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্র নীতিন্দ্রনাথ রাণীকে ভালোবাসত৷ প্রেমের গুরু নিজের মেয়ের প্রেম মানতে পারেননি!
মাত্র এগার বৎসর বয়সে সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য নামক এক ছেলের সাথে রাণীর বিবাহ দেন৷ মাত্র তিন দিনের সিদ্ধান্তের মাথায় এই বিবাহ কার্যসম্পন্ন হয়৷ বিবাহের পর সত্যেন্দ্রনাথকে হোমিওপ্যাথি ডাক্তারী শেখার জন্য যৌতুক দিয়ে বিলাতে পাঠান৷ কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথের সেখানে মন টিকেনি৷ কবি তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্যও অর্থ ব্যয় করেন৷ পিতার নিষ্ঠুরতা, প্রেমে ব্যর্থতা, স্বামীর অকৃতকার্যতা রাণীকে মানসিকভাবে দূর্বল করে দেয়৷ প্রথমে তার অল্প জ্বর এবং কাশি হয়, কিন্তু কাউকে কিছু বলেনি৷ পরে তা যক্ষ্মায় রূপান্তর হয়৷ ধীরে ধীরে রাণী মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়৷
মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর মাত্র পাঁচ বছর পর ১৯০৭ সালে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে কবির তের বছর বয়সী পুত্র শমীন্দ্রনাথও মারা যায়৷ কবির পরিবেশ এবং পরিস্থিতি পাল্টে গেলো৷ একের পর এক প্রিয়জনের মৃত্যু তাকে করেছে শোকার্ত৷ নোবেল প্রাপ্তি তাকে এনে দিলো আকাশচুম্বী খ্যাতি৷ একাকীত্বের দহনে দগ্ধ হচ্ছে মন৷ এমনি নিঃসঙ্গ সময়ে কবির জীবনে এলো বিশ বছর বয়সী জাপানী কলেজ ছাত্রী তোমি ওয়াদা কোরা৷ বয়সে রবীন্দ্রনাথের পঁয়ত্রিশ বছরের ছোট৷
১৯১৬ সালে কবি জাপানে রাজকীয় সংবর্ধনা নিতে গেলেন৷ সেখানেই পরিচয় তোমির সাথে৷ তোমি খুব ভালো ইংরেজী বলতে পারতেন৷ কবির ইংরেজী বক্তৃতা জাপানী ভাষায় অনুবাদ করার দায়িত্ব ছিলো তোমির উপর৷ বিশ্বখ্যাত কবির হাতে এই তরুণী তুলে দিলো ফুলের গোছা৷ ঠোঁটের কোণে আঁকলেন আমন্ত্রিত হাসির ইশারা৷ সৌন্দর্য্যের পিয়াসী ভ্রমর জাপানী ফুলের মধু নিতে দেরী করেন নি৷ কবি যতদিন জাপানে ছিলেন দিনরাত তোমি হয়ে উঠলেন কবির ছায়া সঙ্গিনী৷
এবার দেশে ফেরার পালা যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে বার বছর বয়সী কিশোরী রানু৷ যার ডাক নাম প্রীতি৷ রানুর সাথে কবির অন্তত পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের ব্যবধান৷ অল্প বয়সেই কবির সব লেখা পড়ে ফেলেছে৷ শুধু পড়েই ক্ষ্যান্ত হয়নি রবীন্দ্র কাব্যের ত্রুটি বিচ্যুতি ধরে বেড়ানোতেই তার আনন্দ৷ সেসব ত্রুটি বিচ্যুতি আবার চিঠি লিখে রিতীমত কবিকে জানিয়েও দিচ্ছে! “প্রিয় রবিবাবু” সম্বোধন করে চিঠি শুরু হয়, মাঝখানে লেখার ত্রুটি-বিচ্যুতি আর শেষে উল্লেখ থাকে, “আমার আপনার জন্য মন কেমন করে৷ আমি আপনাকে চুমু দিচ্ছি…৷” কবি বুঝতে পারলেন অচিরেই এই মেয়েটি তার হৃদয় শাসন করবে৷
আমাদের আজকের তথাকথিত শিক্ষিত অপদার্থ সমাজ সকল মেয়েদের সাবালকত্বের বয়স ১৮ বছর নির্ধারণ করেছে৷ কিন্তু মনোবিজ্ঞান বলে মেয়েরা বিভিন্ন বয়সে সাবালক হতে পারে৷ রানু ছিলো তেমনই একজন যে ১২ বছর বয়সে অনেক পেকে গেছে৷ অবশেষে রানুর জীবনের সেই কাঙ্খিত দিনটি এলো৷ ১৯১৮ সালের ১৫ই মে রানু কলকাতায় এলো৷ পরের দিন ১৬ ই মে কবির বড় মেয়ে মাধবীলতা (ডাকনাম বেলা) মারা গেলো৷
প্রতিদিনের মত সেদিনও কবি ডাঃ সুবোধ বসুকে নিয়ে বেলাকে দেখতে গিয়েছিলেন৷ গিয়ে জানতে পারলেন বেলা কিছুক্ষণ পূর্বে মারা গেছে৷ মেয়ের মৃত্যুদৃশ্য এবং আন্তেষ্ট্যক্রিয়া সহ্য করতে পারবেন না বলে কবি সেখান থেকে সোজা রানুদের বাসায় চলে যান৷ দরজায় গিয়ে “রানু” বলে ডাক দিতেই রানু দরজা খুলে দিলো৷ কবি দেখলেন, মেয়েটি সম্পূর্ণ উলঙ্গ৷ কবির কন্ঠ তাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করেছিলো যে সে স্নান ঘর থেকে পোশাক পরে বের হতে ভুলে গেছে৷
রানুর দিকে তাকিয়ে থাকলেন মুগ্ধ কবি৷ মনে হলো, স্বর্গের কোন কিশোরী কন্যা কবির সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ সেদিন রাতেই রানুকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসলেন৷ মেয়ের মৃত্যু সকালে, পিতা অন্য মেয়ের সাথে ব্যস্ত রাতে, এমন কলঙ্কিত পিতাও দুনিয়াতে আছে! রবীন্দ্রানুরাগীরা কেউ বলেন রানুর মাঝে কবি তার মেয়ে বেলার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছেন৷ কেউ বলেন বৌদি কাদম্বরী দেবীর পূর্নজন্ম ছিলো রানু, তাই কবি তাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন৷
আগুন যেভাবে পতঙ্গকে আকৃষ্ট করে, পুরুষের প্রতিভাও নারীকে সেভাবে মোহাচ্ছন্ন করে তোলে৷ রবীন্দ্রনাথের বেলায়ও তাই হয়েছিলো৷ পাঠকের মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে এত মেয়ের মন হরণ করে কবি কি কখনো অনুশোচনার দহনে দগ্ধ হয়েছিলেন কিনা? তার মনে কোন অনুতাপ সৃষ্টি হয়েছে কিনা? না, এধরনের কিছু আমরা তার লেখায় পাইনি৷ ১৯২৮ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী তার স্নেহধন্য দিলীপ কুমার রায়কে “নারীর ব্যভিচার” নিয়ে এক দীর্ঘ চিঠি লেখেন৷ সেখানে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন-
“সমাজে যদি অশান্তি না ঘটে তাহলে ব্যভিচার ব্যাভিচারই হয় না৷ ব্যভিচারের ফলে যদি সন্তান সমস্যা দেখা দেয় তাহলে আজকাল সেটাও সমস্যা নয়৷ কেননা কন্ট্রাসেপটিভ বেরিয়ে গেছে৷ নিবারনের উপায়গুলোও সহজ৷ সুতরাং গর্ভধারণ করতে হয় বলে দেহকে সাবধানে রাখার দায় আর তেমন নেই৷”
কবি এভাবেই নিজেকে দায় এড়িয়ে গেছেন, কিন্তু রবীন্দ্র প্রেমিকারা দায় এড়াতে পারেননি৷ কাদম্বরীর মত অন্যান্য রবীন্দ্র প্রেমিকাদেরও চড়া মাশুল দিতে হয়েছিলো৷ রবীন্দ্রের প্রথম প্রেমিকা আন্না তড়খড়কে দুই সন্তান সহ স্বামী ডিভোর্স দেয়৷ লুসি স্কট জীবনে আর বিয়ে করেননি৷ স্বামী- সন্তান না থাকায় শেষ বয়সে তাকে বিনা চিকিৎস্যায় মরতে হয়েছে৷
তোমিও ভেবেছিলো জীবনে বিয়ে করবে না৷ শেষে চল্লিশ বছর বয়সে বিয়ে করে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তার কোন খবর পাওয়া যায়নি৷ রানু মুখোপধ্যায়কেও তার স্বামীর ঘর ছেড়ে শান্তি নিকেতনে আশ্রয় নিতে হয়েছে৷ এছাড়া রবীন্দ্র জীবনে আরো এসেছেন আর্জেন্টাইন লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, মৈত্রেয়ী দেবী, হেমন্তবালা দেবী৷ এরা স্বামী পরিত্যক্ত ছিলো৷
আমাদের শিক্ষিত সমাজ কখনোই মেয়েদের কাছে রবীন্দ্র জীবনের এই কালো অধ্যায়ের কথাগুলো বলে না৷ কেননা রবীন্দ্রনাথের মত তারাও মেয়েদের ভোগ্য পণ্য মনে করে৷ তারাও মনে করে, সমাজে অশান্তি সৃষ্টি না হলে ব্যভিচার কোন ব্যভিচারই না৷ সেভাবেই মেয়েদের শিক্ষিত করা হচ্ছে৷ যার ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কোন রাজনৈতিক নেতা দেখলেই তারা সেল্ফী তোলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ছে৷ অভিনেতা, গায়ক, কবি, লেখক দেখলেই তাদের হৃদকম্প বেড়ে যাচ্ছে৷ এই মেয়েরা জানেনা, জীবনে একবার ভুল করলে সারাজীবন রবীন্দ্র প্রেমিকাদের মতই মাশুল দিতে হবে৷