।। ফজলে এলাহী ।।
গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মিডিয়ায় আমরা গান , চলচ্চিত্র, নাটক অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে গেলেও একটি জায়গায় ঠিকই উন্নতি করেছি যা হলো বিজ্ঞাপন নির্মাণ । এই বিজ্ঞাপন নির্মাণে আমরা অমিতাভ রেজা , মোস্তফয় সরোয়ার ফারুকি, পিপলু খান , এর মতো অনেক মেধাবী নির্মাতাদের পেয়েছি যারা আমাদের পণ্যর বিজ্ঞাপনকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন এবং দেশে নতুন নতুন বিজ্ঞাপনী সংস্থা তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন ।
অমিতাভ রেজা’র সেদিনের ‘দিনবদল’ বিজ্ঞাপন চিত্রগুলো যেন ছিল আমাদের বিজ্ঞাপন শিল্পেরই দিনবদলের স্বপ্ন যা আজ সত্যি ও সার্থক হয়েছে । গত ১২ বছরে আমাদের তরুনরা অন্য সব মাধ্যমে এক পা এগোলেও দুই পা পিছিয়েছে কিন্তু বিজ্ঞাপন শিল্পে আমাদের তরুনরা শুধুই এগিয়ে গেছে ।
এই বিজ্ঞাপন নির্মাণে তরুনদের জয়গান রচনায় অমিতাভ রেজার অবদান অনেক । ২০০৬ সালের শেষ দিকে মোবাইল অপারেটর বাংলালিংকের একটি বিজ্ঞাপনকে ‘কাহিনীচিত্র’ সফলভাবে রুপান্তর করেন অমিতাভ রেজা । মোবাইল অপারেটর বাংলালিংকের ‘দিনবদলের’ শ্লোগানের বিজ্ঞাপনগুলো আমাদের বিজ্ঞাপন নির্মাণে আমূল পরিবর্তন ঘটায় যার শুরুটা এই অমিতাভ রেজার হাত ধরে । একজন বিজ্ঞাপন নির্মাতা কি পরিমাণ দূরদর্শী হলে ‘দিনবদল’ এর মতো একটা শব্দকে বিজ্ঞাপনের থিম হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন সেটা অমিতাভ রেজার নির্মিত ‘বাংলালিংক জেলে ‘’ বিজ্ঞাপনটি দেখলে বুঝতে পারবেন। ‘দিনবদল’ শ্লোগানটি পরবর্তীতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার ব্যবহার করে সাফল্য পেয়েছিল যা সম্পূর্ণ কাকতলীয় ব্যাপার। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামারও প্রথম নির্বাচনের শ্লোগান ছিল ‘দিনবদল’ যা আরও বেশী বিস্ময়ের ব্যাপার। অর্থাৎ একজন বিজ্ঞাপন নির্মাতা এমন একটি শব্দকে শ্লোগান হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন যা পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক শ্লোগানে পরিণত হয়েছে । অমিতাভ রেজা সম্ভবত তাঁর অন্তরদৃষ্টি দিয়ে ভবিষ্যতের এমন কিছু সেদিন দেখতে পাচ্ছিলেন যা তাঁর দূরদর্শী চিন্তারই প্রমাণ করে।
সেই সময়ে ‘’ Banglalink Fisherman’’ বিজ্ঞাপনটি দেখে এক জেলের শিশু পুত্রের মেলায় না যাওয়ার দুঃখ ভরা মলিন মুখটা দেখে চোখে জল আসেনি এমন দর্শক পাওয়া যাবে না । যেখানে মোবাইল আসার আগে স্থানীয় মাছের আড়তদারদের কাছে এক সাধারন জেলের অসহায়ত্ব ও এরপর মোবাইল যুগে সেই সাধারন জেলের শিশু পুত্রটি যখন আজ তরুন বয়সে সেই আড়তদাড়দের কাছে আর জিম্মি নয় দুটো চিত্রই মাত্র ১ মিনিট ৩৮ সেকেন্ডে দুর্দান্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সেই সময় বাংলালিংকে কর্মরত হিসেবে থাকায় খুব কাছ থেকে দেখতে পেয়েছি বাজারে গ্রাহকদের মাঝে বিজ্ঞাপনটি কি পরিমাণ সাড়া ফেলেছিল । মজার ব্যাপার হলো এই বিজ্ঞাপনটি প্রচারের পরপরেই আমি আমার বস’কে বলে সিলেট শহরে মৎস্য ব্যবসায়ীদের নিয়ে বাংলালিঙ্কের ‘Enterprise /SME’ প্যাকেজের সিম বিক্রির একটি ক্যাম্পেইন শুরু করেছিলাম যাতে আমরা সেদিন খুবই সফল হয়েছিলাম । শুরুতে আমার বস (তৎকালীন রিজিওনাল এসএমই ম্যানেজার) এই ব্যাপারে খুব সফল হওয়া নিয়ে খুবই সন্দিহান ছিলেন কারণ তখনও সিলেট শহরের সব স্থানে বা সিলেট অঞ্চলের সব জায়গায় নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হয়নি এবং মৎস্য ব্যবসায়ীদের কাছে এর আগে গ্রামীণ ফোন, একটেল কিংবা সিটিসেল কেউই এই শ্রেণীটাকে নিয়ে সরাসরি কাজ করেনি কারণ এদের বুঝানো খুবই কঠিন একটা কাজ । কিন্তু আমি সেদিন হাসিমুখেই চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলাম আর সাথে আমার দুই কলিগকে সহযোগী হিসেবে একটা টিম নিয়ে সিলেটের বন্দর বাজারের লাল বাজারে জেলা মৎস্য ব্যবসায়ীদের কার্যালয়ে হানা দিলাম যার কদিনের মাথায় আমরা সম্পূর্ণ ভাবে সফল হলাম। সেদিন আমরা ৪/৫ বছর ধরে ব্যবহার করা গ্রামীণ ফোনের গ্রাহকদের সিম পাল্টিয়ে বাংলালিংক এন্টারপ্রাইজ প্যাকেজের সিম ধরিয়ে দিলাম যার একেকটি মূল্য ছিল ৫০০ টাকা । প্রথম দিনেই আমরা ৫০০০০ টাকার সিম বিক্রি করলাম যা পরবর্তীতে শুধু এক সমিতিতেই সর্বমোট ২ লক্ষ টাকার সিম বিক্রি করি । সেদিনের সেই ক্যাম্পেইনে আমাদের বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপন, পরিশ্রমের সাথে অমিতাভ রেজার বিজ্ঞাপনটি অনেক বড় এক সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল । সেদিনের সফলতায় পরবর্তীতে আমি ‘সিলেট জেলা মাংস ব্যবসায়ী সমিতি’তেও আরেকটি নতুন ক্যাম্পেইনের আইডিয়া নিয়ে কাজ করে সফল হয়েছিলাম । এত কিছু বলার কারণ হলো যে একটি সফল নান্দনিক বিজ্ঞাপন ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে কি পরিমাণ প্রভাব বিস্তার করে সেটার বাস্তবতা বুঝানোর জন্য । ঐ একটি বিজ্ঞাপন আমাদের প্রতিযোগিতামুলক কঠিন বাজারে নিত্য নতুন আইডিয়া /ধারনা নিয়ে কাজ করার চ্যালেঞ্জ গ্রহনে উৎসাহিত করেছিল । অর্থাৎ একজন প্রকৃত মেধাবী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্যসব মেধাবীদের মাঝেও দারুন ভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। সেই কারনেই অমিতাভ রেজার নামটি আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছি।
বিজ্ঞাপনের কথায় ফিরে আসি । খুব ভালো করে লক্ষ্য করে দেখবেন যে বাংলালিংক মোবাইল অপারেটরের কাহিনীনির্ভর বিজ্ঞাপন চিত্রের পর অন্যসব মোবাইল অপারেটর’রাও কাহিনী নির্ভর বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণ করে যা আমাদের বিজ্ঞাপন শিল্পকে করেছে সমৃদ্ধ। এমনকি খেয়াল করে দেখবেন যে বাংলালিংকের সব দারুন ও সেরা বিজ্ঞাপনগুলো কিন্তু সেই সময়ে নির্মিত যার মদ্ধে ফারুকি’র ‘গুরু তোমাকে সালাম’ , ‘মুক্তিযুদ্ধে ভাই হারা বোন’এর পাশাপাশি অমিতাভ রেজার নির্মিত ব্যয়বহুল ‘দেশ’ প্যাকেজের বিজ্ঞাপনগুলো দারুন জনপ্রিয় হয় । দেশ প্যাকেজের ‘দেশ১’ বিজ্ঞাপনটি মডেল নীরব ও তিন্নিকে লাইমলাইটে নিয়ে আসে ।
এখানে একটা কথা উল্লেখ না করে পারছি না তা হলো বাংলালিংকের সেইসব বিজ্ঞাপনের পেছনে নির্মাতা অমিতাভ রেজার পাশাপাশি বাংলালিংকের সুদক্ষ, মেধাবী মার্কেটিং টিমের অবদান এবং তৎকালীন সিইও রশিদ খানের বিচক্ষণতা, সাহসিকতা, প্রেরণা অনেক বড় ভুমিকা পালন করেছিল । ব্র্যান্ডিং উপর রশিদ খানের নিত্য নতুন আইডিয়া অন্যসব মোবাইল অপারেটরদের ব্র্যান্ডিং এর উপর বিশাল প্রভাব ফেলে । রশিদ খানের ৫৫/৬০ বছরের পাকিস্তানী নাগরিক রশিদ খান বাংলালিংক’কে একটি দামি ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে দ্রুত প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিত্য নতুন সব আইডিয়া নিয়ে যেখানে যেভাবে কাজ করার প্রয়োজন সব করার স্বাধীনতা মার্কেটিং টিম’কে দিয়েছিলেন যার ফলে নিত্য নতুন ধারনা ও ব্যয়বহুল বিজ্ঞাপন নির্মাণে বাংলালিংক অন্য সব কোম্পানিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল । রশিদ খানই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ২১ শে ফেব্রুয়ারি, নারী দিবস, মা দিবস এর মতো বিষয়গুলোকে নিয়ে বাংলালিংকের বিজ্ঞাপন বানানোর জন্য বাংলালিংকের মার্কেটিং টিমকে উৎসাহ দিয়েছিলেন যার ফলে ফারুকির নির্মিত আযম খান ও আইয়ুব বাচ্চুর অভিনয়ে ” বিজয় দিবস” বিজ্ঞাপনের মতো নান্দনিক ও ব্যয়বহুল একটি বিজ্ঞাপন আমরা পেয়েছিলাম। স্বাধীনতা দিবসে ” ভাইহারা বোনের কান্না”বিজ্ঞাপনটি তো সারাদেশের সব শ্রেণীর কাছে দারুন প্রশংসিত হয়েছিলো যে বিজ্ঞাপনটি দেখে অনেকেরই অশ্রু ঝরেছিলো।
আজকে যে ঘরের সামনে বিভিন্ন অপারেটরদের ‘কাস্টমার কেয়ার সার্ভিস’ দেখতে পাচ্ছেন সেটারও প্রবক্তা হলেন ঐ রশিদ খান এবং যিনি মোবাইল অপারেটরদের সেবা এক অফিস কেন্দ্রিক না করে আনাচা কানাচে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন যা পরবর্তীতে সকল অপারেটর’রা অনুসরণ করেন । রশিদ খানের সময়েই সারা বাংলাদেশে ‘BL Point’ নামে ৫০০ টি সেবাকেন্দ্র চালু হয়েছিল যার ‘’ কথা দিলাম ‘’ বিজ্ঞাপন চিত্রে অভিনয় করে লাইমলাইটে আসেন মডেল ফারিয়া । রশিদ খান ২০০৯ সালের শুরুর দিকে ওরাসকম টেলিকমের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ‘মবিলিংক’ এর সিইও হিসেবে পরবর্তীতে পাকিস্তানে ফিরে যান ।
অমিতাভ রেজা’র সেদিনের ‘দিনবদল’ বিজ্ঞাপন চিত্রগুলো যেন ছিল আমাদের বিজ্ঞাপন শিল্পেরই দিনবদলের স্বপ্ন যা আজ সত্যি ও সার্থক হয়েছে । গত ১২ বছরে আমাদের তরুনরা অন্য সব মাধ্যমে এক পা এগোলেও দুই পা পিছিয়েছে কিন্তু বিজ্ঞাপন শিল্পে আমাদের তরুনরা শুধুই এগিয়ে গেছে । অমিতাভ রেজা, ফারুকি’র মতো সকল মেধাবী বিজ্ঞাপন নির্মাতারা আরও এগিয়ে যাক এবং একদিন বিশ্বসেরা বিজ্ঞাপন নির্মাতা হিসেবে বিশ্ব জয় করুক এই কামনা করি । যুগের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে অনেক কিছু হারানোর মাঝেও তরুনদের নির্মিত বিজ্ঞাপনগুলোই আমাদের নতুন কিছু পাওয়া ।