:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::
অর্থনৈতিক মন্দা ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাবার কারণে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সাময়িক হিসাবে ব্যাংক থেকে তুলে গ্রাহকরা নিজেদের হাতে রেখেছেন প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এর পরিমাণ আরও বেড়েছিল। পরে অবশ্য তা কমতে শুরু করেছে। আগে কখনোই গ্রাহকরা এত টাকা তুলে নিজেদের হাতে রাখতেন না। উলটো ব্যাংকেই বেশি টাকা রাখতেন। এতে মুনাফা পাওয়া যেত। এখন হাতে রাখায় একদিকে গ্রাহকরা কোনো মুনাফা পাচ্ছেন না।
অন্যদিকে বাড়ছে নানামুখী ঝুঁকি। গ্রাহকদের হাতে থাকা টাকা অর্থনীতিতেও কোনো অবদান রাখতে পারছে না। এদিকে ব্যাংক থেকে গ্রাহকরা টাকা তুলে নেওয়ায় ব্যাংকের নগদ টাকার সংকট দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০১৯ সালের অক্টোবরের তুলনায় ২০২০ সালে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে গ্রাহকদের হাতে রাখার প্রবণতা বেড়েছিল ২১ দশমিক ২৯ শতাংশ।
২০২০ সালের অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এ প্রবণতা বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ৭৪ শতাংশে নেমে আসে। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে গত নভেম্বর পর্যন্ত টাকা তুলে হাতে রাখার প্রবণতা আবার ২০ দশমিক ১৯ শতাংশ বেড়ে যায়। গত অক্টোবরে ব্যাংক খাত নিয়ে নানা গুজব ছড়ালে গ্রাহকদের টাকা তোলার প্রবণতা আরও বেড়ে যায়।
নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত দেড় মাসে গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে তুলেছেন প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে প্রায় ১৮ শতাংশ বেড়েছে টাকা তোলার হার। এটিই সবচেয়ে বেশি টাকা তোলার প্রবণতা। সাধারণত ৭ থেকে ৮ শতাংশ টাকা তোলার প্রবণতা বৃদ্ধিকেই স্বাভাবিক মনে করা হয়।
সূত্র জানায়, ২০২০ সালে করোনার পর থেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে গ্রাহকদের হাতে রাখার প্রবণতা বাড়ছে। এর আগে এই প্রবণতা স্বাভাবিকই ছিল। করোনার সময় গ্রাহকদের হাতে থাকা টাকার একটি অংশ গত বছর আবার ব্যাংকে ফিরে গিয়েছিল। যে কারণে ওই বছর গ্রাহকদের হাতে থাকা টাকার প্রবাহ কমে গিয়েছিল। ব্যাংকে টাকার প্রবাহ বেড়েছিল। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়।
এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যায়। দেশের বাজারেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। পণ্যের দাম বেড়ে যায়। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের ফলে টাকার মান কমে যায়। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। যুদ্ধের প্রভাবে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থাও খারাপ হওয়ার পাশাপাশি খাদ্য সংকটও দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
এ পরিপ্রেক্ষিতে গত এপ্রিল থেকে আবার গ্রাহকদের ব্যাংক থেকে টাকা তোলার প্রবণতা বেড়ে যায়। এর আগে গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত টাকা তোলার প্রবণতা স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু যুদ্ধের প্রভাবে টাকা তোলার প্রবণতা বেড়ে যায়। গত অক্টোবরে ব্যাংক নিয়ে নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ে।
এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েও অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন। কেউ কেউ টাকা তুলে তা দিয়ে বেআইনিভাবে ডলার কিনে তা নিজেদের হাতে রেখেছেন। আগে এসব টাকা আবার ব্যাংকে ফেরত এলেও এবার আর তা ফিরে আসছে কম। ফলে ব্যাংকে নগদ টাকার প্রবাহ কমে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০১৯ সালের অক্টোবরের তুলনায় ২০২০ সালের একই সময়ে ব্যাংক থেকে গ্রাহকদের টাকা তুলে নিয়ে হাতে রাখার প্রবণতা বেড়েছিল ৩৩ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯ সালের অক্টোবরে গ্রাহকদের হাতে টাকা ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। ২০২০ সালের অক্টোবরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকায়। বৃদ্ধির হার ছিল ২১ দশমিক ২৯ শতাংশ।
আগের বছরে এ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল ৭ থেকে ৮ শতাংশ হারে। এটাকেই স্বাভাবিক প্রবণতা বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এর বেশি হলে তা অস্বাভাবিক হয়ে যায়। যেটি হয়েছে ২০২০ ও ২০২২ সালে। ২০২০ সালে করোনার কারণে এমনটি হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের মতে, কোনো মহামারি বা অনিশ্চয়তা বা দুর্যোগ দেখা দিলে গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিজেদের হাতে রাখার একটি প্রবণতা রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২১ সালে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখার প্রবণতা স্বাভাবিকই ছিল। ওই বছরে টাকা তোলার প্রবণতা বেড়েছিল ৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২০২০ সালের অক্টোবরে গ্রাহকরা টাকা হাতে রেখেছেন ১ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২১ সালের একই মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকায়। ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। ওই সময়ে টাকা তোলার প্রবণতা বেড়েছে ২০ দশমিক ১৯ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনীতির আকার যত বাড়বে, মানুষের চাহিদাও তত বাড়বে। এর সঙ্গে সমন্বয় রেখে জনগণের হাতে থাকা টাকার পরিমাণও বাড়বে। তবে এখন যেটি বাড়ছে তা স্বাভাবিক নয়। টাকার অবমূল্যায়ন ও পণ্যমূল্য বাড়ায় মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সংসারের ব্যয় মেটাচ্ছে। এসব টাকার একটি অংশ আবার চক্রাকারে ঘুরে ব্যাংকে ফেরত আসার কথা।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কম আসছে। এক ধরনের অনিশ্চয়তায় পড়ে গ্রাহকরা টাকা নিজেদের হাতে রেখে দিচ্ছেন। অর্থনীতিতে যে কোনো অনিশ্চয়তা বা অস্থিরতা থাকলে গ্রাহকরা টাকা তুলে সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে নিজেদের হাতে রাখেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নানা গুজব ও সুশাসনের অভাব। ফলে গ্রাহকরা ব্যাংকের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না। যে কারণে তারা গুজবের ওপর ভর করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন টাকা তুলে নিতে।
তিনি আরও বলেন, মূল্যস্ফীতির চেয়ে আমানতের সুদের হার অর্ধেক কম। এর বাইরে নানা ফি ও কর কেটে রাখা হয়। ফলে ব্যাংকে টাকা রাখলে তা নেতিবাচক হয়ে যায়। এ কারণেও অনেকে ব্যাংকে টাকা রাখতে চাচ্ছেন না। এছাড়া নানা ভয়ও কাজ করে। টাকা গ্রাহকের হাতে থাকলে তা অর্থনীতিতে কোনো কাজে আসবে না। ব্যাংককে থাকলে তা অর্থনীতির চাকা ঘুরাতে সহায়ক হবে। ফলে জনগণের হাতে থাকা টাকা ব্যাংকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংক থেকে তুলে জনগণের হাতে রাখা টাকা গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ২ লাখ ১০ হাজার কোটি, এ বছরের জানুয়ারিতে ছিল ২ লাখ ১১ হাজার কোটি ও মার্চে ছিল ২ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এ পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বৈশ্বিক ও দেশীয় পরিস্থিতিতে এপ্রিলে টাকা তোলার প্রবণতা বেড়ে যায়। ওই মাসে গ্রাহকদের হাতে থাকা টাকা ছিল ২ লাখ ৩৭ হাজার কোটি। গত জুনে তা সামান্য কমে ২ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। জুলাইয়ে জনগণের টাকা তোলার পরিমাণ বেড়ে ২ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়।
আগস্টে ২ লাখ ৪২ হাজার কোটিতে অপরিবর্তিত থাকে। সেপ্টেম্বরে তা কিছুটা কমে ২ লাখ ৪০ হাজার কোটিতে দাঁড়ায়। গত অক্টোবরে আবার বেড়ে ২ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। নভেম্বরে তা আরও বেড়ে প্রায় ২ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ডিসেম্বরের শুরু দিকে তা আরও বেড়ে আড়াই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে অবশ্য টাকা তোলার প্রবণতা কিছুটা কমেছে।
সূত্র জানায়, গত অক্টোবরে ব্যাংক খাত নিয়ে বাজারে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া কয়েকটি ব্যাংকে নজিরবিহীন দুর্নীতি ও তারল্য সংকটের তথ্য প্রকাশিত হলে টাকা তোলার প্রবণতা অক্টোবর থেকে আরও বেড়ে যায়। গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সাময়িক হিসাবে টাকা তোলার প্রবণতা ৩৩ শতাংশের বেশি বেড়েছিল। পরে তা কমতে থাকে। গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দুই মাস ৭ দিনে জনগণের হাতে থাকা টাকার প্রবাহ বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ।