:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::
ভারতীয় ঋণের ফাঁদে পড়েছে বাংলাদেশ। ঋণের টাকা ছাড়ের আগেই শুরু হয়ে গেছে পরিশোধের দিন গণনা। সম্মতির ভিত্তিতে দুই দেশের করা ঋণচুক্তি থেকে মোট আটটি প্রকল্প বাদ দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ভারত লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) ১, ২ ও ৩-এর আওতায় বাংলাদেশের সঙ্গে ৮০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি করে। ২০১০ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার প্রথম ঋণচুক্তি হয়েছিল ১০০ কোটি ডলারের, যদিও পরে ঋণের পরিমাণ ৮৬ কোটি ২০ লাখ ডলারে নেমে আসে। বাকি ১৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার পদ্মা সেতু প্রকল্পে অনুদান হিসেবে দেয় ভারত।
ভারতের সঙ্গে ২০১০ সালে ঋণচুক্তিতে ১৫টি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই, কোনোটার ভূমি অধিগ্রহণ, ঠিকাদার নিয়োগসহ প্রকল্প নেওয়ার অন্য যে নিয়মগুলো রয়েছে তা শেষ করে কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়েছে ২০১২ সালে, কোনোটি ২০১৫ বা ২০১৭ সালে। তবে এ ৮৬ কোটি ২০ লাখ ডলার বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে শোধ করতে হবে। অন্য দাতা সংস্থাগুলোর ঋণ পরিশোধ প্রকল্প নেওয়ার বা অর্থনৈতিক চুক্তি করার পর থেকে শুরু হয়। তবে ভারতের ক্ষেত্রে পদ্ধতিটা ভিন্ন। ২০১০ সালের চুক্তির আওতায় ২০১৬ সালে নেওয়া প্রকল্পটি ২০৩৬ সালের বদলে ২০৩০ সালের মধ্যে যেমন পরিশোধ করতে হবে। আবার ২০১০, ২০১২, ২০১৫ বা ২০১৭ সালের নেওয়া প্রকল্পেরও ঋণ পরিশোধ করতে হবে ২০৩০ সালের মধ্যে। এ অনুযায়ী কোনো প্রকল্প যদি ২০২৯ সালে নেওয়া হয়, তবে সেই টাকাও পরিশোধ করতে হবে ২০৩০ সালের মধ্যে।
একইভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ২০১৫ সালে করা ২০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি অনুযায়ী ১৫টি প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়। এ চুক্তির আওতায় নেওয়া ১৫টি প্রকল্প যখনই শুরু করা হোক না কেন, ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ২০০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। আর ২০১৭ সালে করা তৃতীয় ঋণচুক্তিতে মোট ১৬টি প্রকল্পে ৫০০ কোটি ডলারের ঋণ দিতে চায় ভারত। এখানেও প্রকল্প যখনই শুরু হোক না কেন বাংলাদেশকে ২০৩৭ সালের মধ্যে এই ৫০০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। তিনটি চুক্তিতেই ১ শতাংশ সুদে ২০ বছরের মধ্যে পরিশোধের বিধান রাখা হয়েছে। এই ২০ বছরের মধ্যে ৫ বছর রেয়াদকাল বা গ্রেস পিরিয়ড রয়েছে।
ভারতের ঋণে পরিশোধ বা প্রকল্প মেয়াদের দিন গণনা নিয়ে অন্য উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে ভারতের ঋণের পার্থক্য রয়েছে। ২০১০ সালে ভারতের সঙ্গে যে ঋণ চুক্তি বাংলাদেশের হয়েছে, সেই দিন থেকেই ঋণ পরিশোধের দিন গণনা শুরু করেছে ভারত। আর এটিও হয়েছে দুই দেশের চুক্তি অনুযায়ী।
ঋণ চুক্তিগুলো যখন হয়েছিল সে সময়ে ইআরডি তার যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। একটি দেশের সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে চুক্তির ভাষাসহ অন্যান্য যে শর্তগুলো রয়েছে, তা অনুধাবন করার বিষয় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইআরডি কর্মকর্তারা হয়তো ইংরেজি বোঝেননি। এতে করে ভারতের ঋণের ১ শতাংশ সুদের যে সুবিধা তা বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হওয়ার বদলে লোকসানের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন হিসাব করলে দেখা যাবে, ঋণ পরিশোধের সময় সীমাবদ্ধতার কারণে এই ১ শতাংশ সুদ বেড়ে ২-৩ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। এ কারণেই এতদিন বসিয়ে রাখলেও তড়িঘড়ি করে সামরিক খাতের ঋণটি ব্যবহার করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ঋণের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরে এত বিস্তারিত কথাবার্তা না হলেও বিষয়টি আলোচনার টেবিলে আসবে।
ইআরডি সূত্র জানায়, সমস্যাটি আসলে চুক্তির সময়েই হয়েছে। তবে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। ভারতের ঋণ চুক্তির বিষয়টি আমরা আগে বুঝতে পারিনি। ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্রকল্প যেগুলো শুরু করতে বা বাস্তবায়নে বেশি সময়ের প্রয়োজন, তা বাদ দেওয়া হচ্ছে। সেসঙ্গে ভারতের সঙ্গে দরকষাকষিতে বাংলাদেশ আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্ষমতা দেখাচ্ছে। যেমন ভারতের ঋণ চুক্তিতে ৭৫ শতাংশ কাঁচামাল ভারত থেকে সংগ্রহ করার একটি বাধ্যবাধকতা ছিল। সেই বিষয়টি প্রকল্পভেদে ৬৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে ভারতকে রাজি করাতে পেড়েছি। কোনো ক্ষেত্রে সেটি ৫০ শতাংশ নামিয়ে আনার সম্ভাবনাও রয়েছে। আগামী থেকে ভারতের সঙ্গে প্রকল্পভেদে আলাদা আলাদা করে ঋণ নেওয়া হবে বলেও ভারত রাজি রয়েছে।
ভারতের সঙ্গে যেভাবে চুক্তি হয়েছে সে অনুযায়ী সব প্রকল্প এক দিনে নেওয়া সম্ভব নয়। ২০১৫ সালে যেদিন চুক্তি হয়, সেই দিনই প্রকল্প হাতে নেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না। কোনো দেশই তা পারবে না। তাই বেশ কিছু প্রকল্প বাদ দেওয়া হচ্ছে। আগামী ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে যেসব প্রকল্প শুরু করা সম্ভব হবে না, সেগুলো মূলত বাদ দেওয়া হচ্ছে। যেমন সৈয়দপুর বিমানবন্দর নিয়ে ভারতের একটি ঋণ প্রকল্প ছিল। যেহেতু এটি সময়সাপেক্ষ প্রকল্প, তাই এটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৪টি প্রকল্প নিশ্চিতভাবেই বাদ দেওয়া হয়েছে। আরও ৪টি বাদ হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। প্রয়োজনে আরও প্রকল্প বাদ দেওয়া হতে পারে।
ভারতের তিনটি ঋণচুক্তির আওতায় ২০১০ সাল থেকে ৭৩৬ কোটি ২০ লাখ ডলারের মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ১২৩ কোটি ডলার পাওয়া গেছে। প্রথম ঋণচুক্তি থেকে ৭২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার, দ্বিতীয় ঋণচুক্তির ২৩ কোটি ৭৭ লাখ ডলার এবং তৃতীয় ঋণচুক্তি থেকে ২৬ কোটি ৩৬ লাখ ডলার এখন পর্যন্ত নিয়েছে বাংলাদেশ।
দ্বিতীয় ঋণচুক্তির ১৫ প্রকল্পের মধ্যে তিনটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এর ২টি শেষ হয়েছে, তিনটি ডিপিপি পর্যায়ে রয়েছে, বাকি ৭টি বাস্তবায়ন পথে রয়েছে। তৃতীয় ঋণচুক্তির ১৬ প্রকল্পের মধ্যে একটি বাদ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ১৫টি প্রকল্পের মধ্যে ৭টি ডিপিপি পর্যায়ে আছে।