:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::
পাস হওয়ার চার বছর পর লোকসভা নির্বাচনের আগে দিয়ে ভারতে চালু হয়ে গেল বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ)। সোমবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার সিএএ কার্যকরের বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে।
এই আইন কার্যকর করা নিয়ে ভারতজুড়ে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। আসামে রাতে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা আইনের অনুলিপি পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। রাজ্যটিতে মঙ্গলবার ধর্মঘট ডেকেছে বিরোধী দলগুলো। পশ্চিমবঙ্গেও বড় ধরনের বিক্ষোভের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মে মাসে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে ভারত সরকার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) কার্যকর করল।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার ২০১৯ সালে আইনটি পাস করে। বিতর্কিত আইনটি ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আসা অমুসলিম শরণার্থীদের ভারতীয় নাগরিকত্বের অনুমতি দেয়।
এ আইন অনুযায়ী, মুসলমান ছাড়া সব ধর্মের লোকদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। ভারতের প্রতিবেশী আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং গুজরাট, রাজস্থান, ছত্তিসগড়, হরিয়ানা, পাঞ্জাবের মতো রাজ্যে বসবাসকারী অ-মুসলিমদের (হিন্দু, শিখ, জৈন এবং বৌদ্ধ) ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে এমনটাই জানিয়েছে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
একই সঙ্গে মুসলমান ছাড়া অন্য সবাই যাতে অবিলম্বে আবেদন করেন, সেই আমন্ত্রণবার্তাও দেওয়া হয়েছে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।
জিনিউজের খবরে আরও বলা হয়, নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫ এবং ২০০৯ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের (সিএএ) অধীনে এ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। ২০১৯ সালে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী নয়।
আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মুসলিম অধিকার সংগঠনগুলো বলছে, প্রস্তাবিত জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) সম্বলিত আইনটির মাধ্যমে ভারতের ২০ কোটি মুসলমানের সঙ্গে বৈষম্য করা হতে পারে। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যা ভারতে। তাদের আশঙ্কা, সরকার কিছু সীমান্তবর্তী রাজ্যে কোনোরকমের কাগজপত্র ছাড়াই মুসলমানদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দিতে পারে।
বিজেপির সমালোচনা করে মমতা বলেন, লোকসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিন কয়েক আগে সিএএ কার্যকর করায় বোঝা যায়, এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে।
কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে লোকসভার নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার এখন সিএএ কার্যকর করেছে।
তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন বলেছেন, বিজেপি সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরুদ্ধে যাচ্ছে। এই আইন কার্যকর না করার অঙ্গীকার করেছেন ডিএমকে প্রধান।
হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিএএ কার্যকর করায় কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করেছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টির (এএপি) নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল।
এক্সে (সাবেক টুইটার) দেওয়া পোস্টে অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেন, ১০ বছর ধরে দেশ শাসন করার পর মোদি সরকার লোকসভা নির্বাচনের আগে সিএএ কার্যকর করেছে। তারা এমন সময় সিএএ কার্যকর করল, যখন দরিদ্র ও মধ্যবিত্তরা মূল্যস্ফীতির কারণে কাতরাচ্ছে। বেকার যুবকেরা কর্মসংস্থানের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। এই বাস্তবিক সমস্যার সমাধানের পরিবর্তে বিজেপি সিএএ কার্যকর করেছে।
ভারতে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে বলা হয়েছিল, নাগরিকত্ব পেতে টানা এক বছর দেশটিতে থাকতে হবে। এ ছাড়াও গত ১৪ বছরের মধ্যে ১১ বছর ভারতে থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু সংশোধনী আইনে সেই ১১ বছরের সময়কাল কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়।
২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই মোদি সরকার ঘোষণা করে যে, ভারতে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করা হবে। সেই মতোই সংশোধনী বিল আনে কেন্দ্র সরকার। পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভা ও উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় পাস হয়ে যায় সেই বিল। ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বিলে সই করেন।
উত্তর-পূর্ব ভারত থেকেই মূলত আপত্তি উঠেছিল সিএএ নিয়ে। অনেকেরই আশঙ্কা ছিল, সিএএ কার্যকর হলে শরণার্থীদের ভিড় বাড়বে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে। ফলে ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত সমস্যা প্রকট হতে পারে। নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার স্বার্থেই অনেকে সিএএ বিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন।
সিএএর ৬এ ধারার সাংবিধানিক বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। সিএএ বাতিল আন্দোলনে সোচ্চার থেকেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বরাবরই সিএএ নিয়ে বিরোধিতা করে আসছেন। তার কথায়, নাগরিকত্ব দেয়াই যদি কেন্দ্র সরকারের মূল লক্ষ্য হয়, তবে নতুন আইনের কী প্রয়োজন? আইনে মুসলিমদের বাদ দেয়া নিয়েও আপত্তি তার।
বিরোধীদের দাবি, সিএএ ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক নীতি বিরোধী। এ আইনের মাধ্যমে ধর্মের ভিত্তিতে ‘বৈষম্য’ সৃষ্টি করা হচ্ছে। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারের মতো দেশগুলো কেন বাদ পড়েছে সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে মোদি সরকার বিরোধীদের সব অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলছে, এ আইন কার্যকরের ফলে কোনোভাবেই ভারতের কোনও নাগরিকের ওপর এর প্রভাব পড়বে না।
সোমবার রাতেই আসামের বিভিন্ন প্রান্তে সিএএর অনুলিপি পোড়ানো শুরু হয়েছে। বিভিন্ন আদিবাসী সমাজের মানুষ একত্র হয়ে রাজ্যের রাজধানী গৌহাটিতে আইনের অনুলিপি পোড়াতে শুরু করেন। এ পরিস্থিতিতে রাজ্যজুড়ে চূড়ান্ত পর্যায়ের সতর্কতা জারি করা হয়েছে। আসামে প্রাথমিকভাবে বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেয় পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে বিদেশী অনুপ্রবেশবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া সংগঠন অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু)।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ এর নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) পাসের পর থেকেই দেশজুড়ে শুরু হয়েছিল বিক্ষোভ। এমনকি দাঙ্গাও বাঁধে দিল্লিতে৷ ২০২০ সালেও সেই সিএএ বিরোধী ঝড় অব্যাহত থাকে।