:: তাহসিন আহমেদ ::
মাস পাঁচেক আগের শান্তিপূর্ণ এক পৃথিবীতে তছনছ করে দিয়েছে করোনাভাইরাস। শোকের মেঘ যেন অন্ধকার করে দিয়েছে সুন্দর এই পৃথিবীকে। আমি, আপনি, আমরা সকালের সূর্যোদয় আর রাতের অন্ধকার অনুভব করতে ভুলে গেছি অনেকদিন। করোনাকালে শোকের চাঁদরে ঢাকা তমসাচ্ছন্ন সময়ে পূর্ণিমার চাঁদও আমাদের স্নিগ্ধতায় ভাসাতে পারে না। অদ্ভুত এক নিরবতা আমাদের গ্রাস করছে। ১৩ মে পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ১৭ হাজার ৮২২ জন, সুস্থ হয়েছে ৩ হাজার ৩৬১ জন এবং মারা গেছে ২৬৯ জন। যেখানে সারাবিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা ৪৩ লাখ ৫৬ হাজার ৬২৮ জন, সুস্থ হয়েছে ১৬ লাখ ১০ হাজার ৭২৫ জন এবং মারা গেছে ২ লাখ ৯৩ হাজার ১১১ জন। আমরা অদ্ভুত এক নিরবতায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছি। ভয়, শঙ্কা, মৃত্যু ও বেঁচে থাকা নিয়ে আবেগতাড়িত হচ্ছি।
প্রিয়জনের সাথে শেষ দেখা আদৌ হবে নাকি সেই আশঙ্কা আমাদের মনে। করোনার কারণে থেমে গেছে আমাদের প্রিয় নগরীর স্পন্দন। কিন্তু এর মাঝেও আনন্দে মুখরিত প্রাণ-বৈচিত্র্যের জীবন। প্রতিদিন যেভাবে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে তাতে শোকে স্তব্ধ হচ্ছি আমরা। পৃথিবীর কোন না কোন প্রান্তে করোনায় আক্রান্ত মানুষগুলোর স্বজন হারানোর শোক যেন নীল আকাশকে কালো করে ফেলছে। আত্মঘাতী করোনায় অস্বাভাবিক মৃত্যু যেন সবকিছুর টুটি চেপে ধরেছে। মানবিক এই ধরণী যেন লাখো মানুষের মৃত্যুর ভার বইতে বইতে খুব বেশি ক্লান্ত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর করোনা সবচেয়ে বেশি মানুষকে কেড়ে নিয়েছে। সুন্দর এই ধরণী থেকে এমন মহামারিতে মৃত্যু বড্ড বেশি শোকের।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই।
ধরায় প্রাণের খেলা চিরতরঙ্গিত,
বিরহ মিলন কত হাসি- অশ্রু-ময়,
মানবের সুখে দুঃখে গাঁথিয়া সংগীত
যদি গো রচিতে পারি অমর-আলয়।
ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীতে সবাই বাঁচতে চায়। আর সেটা ভালোভাবে বেঁচে থাকার নেশা। অথচ অনিশ্চিত এই জীবনকে আরও বেশি অনিশ্চয়তার পথে নিয়ে গেছে করোনার সংক্রমণ।
করোনার নীল ছোবলে মৃত মানুষের অস্বাভাবিক সংখ্যা যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে ভূমধ্যসাগরের অনেক করুন ইতিহাসের। ধনী-গরিব, শিল্পপতি এমনটি রাষ্ট্রনায়কও বাদ যায়নি করোনার সংক্রমণ থেকে। ১৯৭৬ সালে সর্বশেষ প্রাণঘাতী ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল পৃথিবীর বহু দেশের মানুষ। ৫ বছর আগে এই ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েই আফ্রিকার দক্ষিণ ও পশ্চিমের দেশগুলোর ১১ হাজার ৩৩৩ জন মানুষের মৃত্যু হয়। এর আগে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে গুটিবসন্ত নামক মহামারী দুনিয়াজুড়ে প্রকট আকার ধারণ করে। কেড়ে নেয় ৩০ কোটি মানুষের প্রাণ। তারও আগে ১৯১৮-১৯ সালে স্প্যানিশ ফ্লু নামের আরেক মহামারি দুনিয়া থেকে কেড়ে নেয় ১০ কোটি মানুষের প্রাণ। আরেকটি ভয়ংকর ভাইরাস ছিল রেবিজ, যেটায় আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর মারা যেত ৫৯ হাজার মানুষ। সরকারের করোনা ইস্যুতে দেরিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব, দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা এবং জীবন ও জীবিকার তাগিদে লকডাউন মেনে না চলা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। আমরা ঝুঁকিপূর্ণ সময় পার করে এখন হয়ত অনিশ্চিত কোন বিভীষিকার অপেক্ষায় আছি।
প্রতিদিন করোনায় আমাদের দেশ কিংবা সারা দুনিয়ার কোন না কোন প্রান্তে মানুষের অকালমৃত্যুর সংবাদ আমাদের সুন্দর সকাল বিষাদময় করে তোলে। আমরা আশাবাদী হবার চেষ্টা করি। ভাবি একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আবার নতুন মানবিক পৃথিবী দেখার প্রত্যাশা করি। আমরা স্বপ্ন দেখি প্রিয় মানুষটির হাত ধরে প্রিয় শহরকে ঘুরে দেখার। কল্পনা করি ব্যস্ত নগরীতে রোদেলা বিকেল কিংবা বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যাকে উপভোগের। অথচ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা সাড়া দুনিয়ার লাখো মানুষেরও হয়ত আমাদের মত স্বপ্ন ছিল।
কবি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ত সেই আক্ষেপ থেকেই লিখেছিলেন,
“এই খেদ মোর মনে
ভালবেসে মিটল না আশ- কুলাল না এ জীবনে।
হায়, জীবন এত ছোট কেনে? এ ভুবনে?”
প্রায় ১০০ বছর পর মহামারী করোনা সারা দুনিয়াকে বদলে দিয়েছে। হয়ত এটি মানবজাতির জন্য অনিবার্য নিয়তি ছিল। অথবা বৈশ্বিক পরিবর্তনের অবধারিত নিয়ম। কিংবা এক শতাব্দী পর পর অনুকূল সময়ে এটি বদলে দেয় সভ্যতার ইতিহাসকে। হয়ত এটি মহান সৃষ্টিকর্তার বিচার। প্রকৃতি নিজ ক্ষমতা দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে আর আমরা মানবজাতি এর শিকার হই। যোজন যোজন দূরে থেকে আমরা সারাবিশ্বের যারা করোনায় প্রাণ হারিয়েছে তাঁদের জন্য শোকাচ্ছন্ন হই। নিজ দেশের যারা করোনা আক্রান্ত কিংবা মারা গেছে তাঁদের কষ্ট বুঝতে পারি। করোনার ভয়াবহতা সারা দুনিয়ার শোকাবহ পরিবেশে একাকার হয়ে গণনবিদারী আর্তনাদে পরিণত হয়। শোকের কালো মেঘে আচ্ছন্ন হচ্ছে সারা পৃথিবীর কোন না কোন প্রান্ত। পৃথিবীতে কোন কিছু চিরস্থায়ী নয়। করোনা পরিস্থিতি একদিন স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আমাদের চিরচেনা জীবনে বদলে যাবে। বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর জীবন আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় নিরন্তর ছুটে চলবে।
রবীন্দ্রনাথ মানব জীবনের বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে লিখেছিলেন, আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে। তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ॥ তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,. বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে ॥
একদিন শোকের পৃথিবী করোনাকাল অতিক্রম করে মানবিক পৃথিবীর রুপ পাবে। প্রতিদিন শোকের দীর্ঘশ্বাস কাবু না করে জীবনের সব রঙ ছুয়ে যাক নতুন আগামীর পথে। ভালো থাকুক মানুষ, প্রকৃতি ও ধরনীর প্রতিটি প্রান্ত।