:: ফারহান আরিফ ::
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের আনাচে কানাচে কচুরিপানার মত কিছু ইতিহাসবিদ ভেসে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। ভাসমান এ সকল ঐতিহাসিকরা এখন জাতির আমানত সংরক্ষণের স্থান মহান জাতীয় সংসদেও পৌঁছে গিয়েছে। কিভাবে পৌঁছেছে সেটা অবশ্য প্রতিষ্ঠিত আলাপ। সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না।
সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ১৫০০ রুপিতে সুখে শান্তিতে থাকা এক পরিবারের সদস্যকে সংসদে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বয়ান করতে দেখলাম। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ইতিহাস বর্ণনার লক্ষ্যবস্তু ছিল মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও তার পরিবার। ইতিহাসের নির্লজ্জ বিকৃতির নামে স্বাধীনতাযুদ্ধে জিয়ার ভূমিকাকে অস্বীকার এবং এদেশের মাটি ও মানুষের সাথে মিশে থাকা নাম দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ঘিরে কাল্পনিক গল্পের অবতারণা করেছেন এই ব্যক্তি। এ প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধে দালীলিকভাবে প্রতিষ্ঠিত জিয়া পরিবারের ভূমিকাকে আবারো সামনে নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা থেকে এই লেখার অবতারণা। মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার বীরত্ব ঐতিহাসিকভাবেই প্রতিষ্ঠিত। তাই এ আলোচনায় কেবল মুক্তিযুদ্ধকালে দেশমাতা বেগম খালেদা জিয়ার ত্যাগ ও সংগ্রামের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।
২৫শে মার্চের সেই কালরাত্রিতে যখন তখনকার রাজনীতিবিদরা সমগ্র জাতিকে অভিভাবকশুন্য অবস্থায় অন্ধকারে রেখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন, ঠিক তখনই দেদীপ্যমান সূর্যের ন্যয় জাতির সামনে ভরসা হয়ে উপস্থিত হলেন একজন মেজর জিয়াউর রহমান। দেশমাতৃকার টানে পরিবার-পরিজন রেখে জিয়া যখন স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন, তখন তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। তখন চট্টগ্রামে যে বাড়িতে বেগম জিয়া ও তার দুই ছেলে থাকতেন তার পাশ দিয়ে জিয়া একদিন তার সেনাদল নিয়ে যাওয়ার সময় লেফট্যানেন্ট সমশের মবিন তার কাছে জানতে চান, তিনি পরিবারকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চান কি না। জিয়া উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার অধীনে থাকা ৩০০ সৈনিক যদি তাদের পরিবার ত্যাগ করে আসতে পারে, তাহলে আমি আমার পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি না।’ তখন এই বাড়ির তৃতীয় তলায় সপরিবারে থাকতেন লেফট্যানেন্ট এওআইএম মাহফুজুর রহমান (জিয়া হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত)।
জিয়ার অবর্তমানে যুদ্ধের সময় বড় বোন খুরশিদ জাহান হকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বেগম জিয়া চট্টগ্রাম থেকে লঞ্চে করে ১৬ মে ১৯৭১ নারায়ণগঞ্জে পৌঁছান। সঙ্গে ছিল দুই ছেলে ও লেফট্যানেন্ট মাহফুজের স্ত্রী। নারায়ণগঞ্জ থেকে তাকে ঢাকা নিয়ে আসা হয়। তবে বেশিদিন তিনি পালিয়ে থাকতে পারেন নি। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয়ের চেষ্টাকালে পাক বাহিনী তার সন্ধান পেয়ে যায় এবং ২ জুলাই এসকে আব্দুল্লাহর সিদ্ধেশ্বরীর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি সামরিক হেফাজতে বন্দীজীবন কাটিয়েছেন।
সেই সময় ঢাকায় দায়িত্ব পালনরত পাকিস্তানি সামরিক অফিসার মেজর জেনারেল জামশেদকে ২১ আগস্ট ১৯৭১ একটি চিঠি লিখেন জিয়া। পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কর্মরত থাকাকালে জেনারেল জামশেদ তার অধিনায়ক ছিলেন। জামশেদকে তিনি লিখেন, ‘Dear General Jamshed, My wife Khaleda is under your custody. If you do not treat her with respect, I would kill you someday. Major Zia.’ চিঠিটি তিনি দেশের অভ্যন্তরে কাউকে দিয়ে ডাকবাক্সে ফেলার জন্য মেজর সাফায়াত জামিলকে দেন। দেওয়ানগঞ্জে পোস্ট করা সেই চিঠি পরবর্তীতে সত্যি সত্যিই জেনারেল জামশেদের কাছে পৌঁছেছিল।
২৫শে মার্চের সেই কালরাত্রিতে যখন তখনকার রাজনীতিবিদরা সমগ্র জাতিকে অভিভাবকশুন্য অবস্থায় অন্ধকারে রেখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন, ঠিক তখনই দেদীপ্যমান সূর্যের ন্যয় জাতির সামনে ভরসা হয়ে উপস্থিত হলেন একজন মেজর জিয়াউর রহমান। দেশমাতৃকার টানে পরিবার-পরিজন রেখে জিয়া যখন স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন, তখন তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। তখন চট্টগ্রামে যে বাড়িতে বেগম জিয়া ও তার দুই ছেলে থাকতেন তার পাশ দিয়ে জিয়া একদিন তার সেনাদল নিয়ে যাওয়ার সময় লেফট্যানেন্ট সমশের মবিন তার কাছে জানতে চান, তিনি পরিবারকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চান কি না। জিয়া উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার অধীনে থাকা ৩০০ সৈনিক যদি তাদের পরিবার ত্যাগ করে আসতে পারে, তাহলে আমি আমার পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি না।’ তখন এই বাড়ির তৃতীয় তলায় সপরিবারে থাকতেন লেফট্যানেন্ট এওআইএম মাহফুজুর রহমান (জিয়া হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত)।
পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের দিন জিয়া ছিলেন সিলেটের সমশেরনগরে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নির্দেশে ঢাকা থেকে বেগম জিয়া ও তার ছেলেদেরকে সমশেরনগরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিমানবন্দরে তাকে নিতে আসেন মেজর চৌধুরি খালেকুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন অলি আহমদ। তাদেরকে স্থানীয় একটি রেস্টহাউজে রাখা হয়। মেজর জেনারেল আইনুদ্দিন বীর প্রতীক বলেন, ’১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ তিনি কুমিল্লা সার্কিট হাউজে জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেন।’ এই উক্তি সঠিক বলে ধরে নিলে বোঝা যায় সমশেরনগরে বেগম জিয়ার অবস্থান ছিল সংক্ষিপ্ত।
এ প্রসঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল শাফায়াত জামিলের “একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর” বইয়ের তথ্যটি উল্লেখ্য হবার দাবী রাখে।
এ বইয়ের ৯৪ তম পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, “……..ডিসেম্বরের শেষ দিকে জিয়া একদিন ফোনে আমাকে বললেন, পাকবাহিনীর বন্দিদশা থেকে তাঁর সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সহধর্মিণী সিলেটে মাজার জিয়ারত করতে চেয়েছেন। আমাকে এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বেগম জিয়া তাঁর দুই ছেলেসহ বেশ কয়েক মাস পাকবাহিনীর হাতে অন্তরীণ থাকার পর ১৬ ডিসেম্বর অন্য যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে মুক্তি পান। আমি ও আমার স্ত্রী রাশিদা বেগম জিয়াকে হযরত শাহজালালের মাজারে নিয়ে গেলাম। সেখান থেকে তিনি মাইল পনেরো দূরে রানীপিঙ নামে একটা গ্রামে যেতে চাইলেন। চট্রগ্রামে পাকসেনাদের হাতে বন্দি অবস্থায় নিহত শহীদ লে. ক. এম. আর. চৌধুরীর স্ত্রী তখন রানীপিঙে ছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে কাটাবার পর বেগম জিয়া সেদিনই শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান।’’
আলোচনার শেষে একটা হিসেব লক্ষ্য করুন। ২০১৮ সালের এক হিসেব মতে জাতীয় সংসদের অধিবেশন চলাকালে প্রতি মিনিটে খরচ হয় ১ লাখ ৬৩ হাজার ৬৮৬ টাকা। বর্তমানে সে খরচ আরো বেড়ে যাওয়ার কথা। এ খরচের পুরোটাই কিন্তু আসে এদেশের ২০ কোটি মানুষের ট্যাক্স ও ভ্যাটের টাকা থেকে। সে হিসেবে উক্ত ব্যক্তির অন্তত ১০ মিনিটের সেই কাল্পনিক গল্পের পেছনে জাতির খরচ হয়েছে অন্তত ১৭ কোটি টাকা! অবশ্য এর তোয়াক্কাই বা কে করছে! যারা জনগণের আমানত ছিনতাই করে জনগণের মতামতকে পদদলিত করে ক্ষমতায় আসীন তাদের কাছে এর জবাবদিহিতার কোন প্রয়োজন আছে কি?
তবে ইতিহাসের এই নির্লজ্জ বিকৃতির বিরুদ্ধে আমরা সদাজাগ্রত। প্রকৃত সত্য দিয়েই এই নির্লজ্জ কল্পকাহিনীর মোকাবিলায় প্রস্তুত আছে এদেশের শত সহস্র ইতিহাসের সচেতন পাঠক।