:: ক্রীড়া প্রতিবেদন ::
গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের ক্যারিয়ার সেরা মহাকাব্যিক ২০১ রানের বিধ্বংসী ইনিংসে ভর করে আফগানদের ৩ উইকেটে হারিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছে গেল অস্ট্রেলিয়া।
অস্ট্রেলিয়ার ৯১ রান তুলতেই ৭ উইকেট হারানোর পর পরাজয়ের শঙ্কায় ছিল। ক্রিজের অন্য এক প্রান্তে ব্যাটারদের আসা যাওয়ার ও ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল ম্যাচসেরা গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। অন্য প্রান্ত আগলে রেখে হাঁকিয়ে ফেলেন ডাবল সেঞ্চুরি। ১২৮ বলে খেলেন ২০১ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস। তার ইনিংসটি সাজানো ছিল ২১ বাউন্ডারি ও ১০ ছক্কায়।
২৯২ রানের জয়ের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নামা অস্ট্রেলিয়ার উদ্বোধনী জুটি ভেঙে যায় ৪ রানেই। দ্বিতীয় ওভারের দ্বিতীয় বলে নাভিন উল হকের বলে ২ রান করা ট্রাভিস হেড আউটসাইড এজ হওয়া বল সহজেই তালুবন্দী করেছেন আফগানিস্তান উইকেটরক্ষক ইকরাম আলি খিল। ২ বল খেলেও রানের খাতা খুলতে পারেননি হেড।
ষষ্ঠ ওভারের চতুর্থ বলে মার্শকে এলবিডব্লুর ফাঁদে ফেলেন নাভিন। আম্পায়ার আউট দেওয়ার পর মার্শও রিভিউ করেননি। ১১ বলে ২ চার ও ২ ছক্কায় ২৪ রান করেছেন অস্ট্রেলিয়ার এই অলরাউন্ডার। ভেঙে যায় দ্বিতীয় উইকেটে ডেভিড ওয়ার্নার ও মার্শের ২৬ বলে ৩৯ রানের জুটি।
মার্শের পর দ্রুত ড্রেসিংরুমের পথ ধরেছেন ওয়ার্নার। নবম ওভারের প্রথম বলে আজমতউল্লাহ ওমরজাইকে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান ওয়ার্নার। ২৯ বলে ৩ চারে ১৮ রান করেছেন অস্ট্রেলিয়ার এই বাঁহাতি ব্যাটার। ঠিক তার পরের বলেই ওমরজাই পেয়েছেন আরও এক উইকেট। কাট শট খেলতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ান উইকেটরক্ষক ব্যাটার জস ইংলিশ প্রথম স্লিপে ইব্রাহিম জাদরানের তালুবন্দী হয়েছেন।
দ্রুত দুই উইকেট হারানোর পর চার নম্বরে ব্যাটিংয়ে নামা মারনাস লাবুশেন ধীরে সুস্থে ব্যাটিং করতে থাকেন। ম্যাক্সওয়েলকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের হাল ধরার চেষ্টা করছিলেন লাবুশেন। তবে বেশিক্ষণ টেকেনি ম্যাক্সওয়েল-লাবুশেনের পঞ্চম উইকেট জুটিতে যোগ হয়েছে ৩৫ বলে ২০ রান। যেখানে ১৫তম ওভারের প্রথম বলে রশিদ খানকে মিড উইকেটে ঠেলে সিঙ্গেল নিতে যান ম্যাক্সওয়েল। স্ট্রাইক প্রান্তে লাবুশেন পৌঁছানোর আগেই মিড উইকেট থেকে রহমত শাহর অসাধারণ ডিরেক্ট থ্রোতে স্টাম্প ভেঙে যায়। তাতে অজিদের স্কোর হয়ে যায় ১৪.১ ওভারে ৫ উইকেটে ৬৯ রান।
১৭তম ওভারের চতুর্থ বলে রশিদকে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে এলবিডব্লুর ফাদে পড়েন স্টয়নিস। আম্পায়ার আউট দেওয়ার পর রিভিউ নিয়েও বাঁচতে পারেননি অস্ট্রেলিয়ার এই অলরাউন্ডার। ৭ বলে ১ চারে ৬ রান করেছেন স্টয়নিস। তাতে অজিদের স্কোর হয়ে যায় ১৬.৪ ওভারে ৬ উইকেটে ৮৭ রান।
৯তম ওভারের তৃতীয় বলে স্টার্ককে কট বিহাইন্ড করেন রশিদ। তাতে অস্ট্রেলিয়ার স্কোর দাঁড়ায় ১৮.৩ ওভারে ৭ উইকেটে ৯১ রান। এরপর ২২তম ওভারে গিয়ে জোড়া জীবন পেলেন ম্যাক্সওয়েল। ওভারের দ্বিতীয় বলে অস্ট্রেলিয়ার অলরাউন্ডারের বিপক্ষে নুর আহমাদ এলবিডব্লুর আবেদন করেন। আম্পায়ার আউট দেওয়ার পর রিভিউ নিলে দেখা যায় বল স্টাম্পের অনেক ওপর দিয়ে বেড়িয়ে যায়। তারপর একই ওভারের পঞ্চম বলে সুইপ করেছেন ম্যাক্সওয়েল। শর্ট ফাইন লেগে সহজ ক্যাচ হাতছাড়া করেছেন মুজিব উর রহমান। ব্যক্তিগত ২৭ রান ও ৩৩ রানে ম্যাক্সওয়েল যখন জীবন পেয়েছেন, তখন অস্ট্রেলিয়ার স্কোর ছিল ১০১ ও ১১২ রান।
৫১ বলে ৭ চারে ফিফটি তুলে নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার এই অলরাউন্ডার। এই নুরকেই ২৯তম ওভারের প্রথম ও দ্বিতীয় বলে টানা দুটি ছক্কা মেরেছেন ম্যাক্সওয়েল। অস্ট্রেলিয়ার এই অলরাউন্ডার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিধ্বংসী হয়েছেন। তাঁকে (ম্যাক্সওয়েল) দারুণভাবে সঙ্গ দিয়েছেন ৯ নম্বরে ব্যাটিং করতে নামা প্যাট কামিন্স। কামিন্স এক প্রান্ত আগলে রেখে সিঙ্গেল নিয়েছেন। অন্যপ্রান্তে বেধড়ক পেটাচ্ছিলেন ম্যাক্সওয়েল। ৭৬ বলে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের চতুর্থ সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার এই অলরাউন্ডার।
সেঞ্চুরির পর বেশি বিধ্বংসী হয়ে উঠেছেন ম্যাক্সওয়েল। তাঁর একের পর এক বাউন্ডারিতে মুখরিত হয়ে ওঠে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ের গ্যালারি। বেশি আক্রমণাত্মক হতে গিয়েই যেন অস্ট্রেলিয়াকে শঙ্কায় ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। ৪১তম ওভারের দ্বিতীয় বলে নুরকে লং অফে ঠেলে সিঙ্গেল নিতে গিয়ে ডান পায়ে মারাত্মক চোট পান ম্যাক্সওয়েল। ব্যথায় কাতড়াতে থাকা অস্ট্রেলিয়ার এই অলরাউন্ডারের ইনিংসই তখন শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ১০১ বলে ১৪৭ রান করার পর যখন তিনি যন্ত্রণায় কাতড়াচ্ছিলেন, তখনও অস্ট্রেলিয়ার জয়ের জন্য প্রয়োজন ৫৮ বলে ৫৫ রান। ওদিকে অ্যাডাম জাম্পা ব্যাটিংয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল যেন ম্যাচ জেতানোর প্রতিজ্ঞা নিয়েই আজ মাঠে নেমেছেন। এক পায়ের ওপর ভর করে একের পর এক চার-ছক্কায় আফগানিস্তানের থেকে ম্যাচের লাগাম কেড়ে নিতে থাকেন ম্যাক্সওয়েল। ৪৬ ওভার শেষে অস্ট্রেলিয়ার স্কোর দাঁড়ায় ৭ উইকেটে ২৭১ রান।
অস্ট্রেলিয়ার জিততে যেমন ২১ রান দরকার ছিল, ম্যাক্সওয়েলের রান ছিল তখন ১৭৯। যে মুজিবের হাতে জীবন পেয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার অলরাউন্ডার, সেই মুজিবই করতে এসেছেন ইনিংসের ৪৭তম ওভার। ওভারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বলে টানা দুটি ছক্কা মারেন ম্যাক্সওয়েল। অজি অলরাউন্ডার পরের বলটা কাভার দিয়ে মেরেছেন চার। এরপর ওভারের পঞ্চম বলে ডিপ মিড উইকেট দিয়ে ছক্কা মেরে ১৯ বল হাতে রেখে অস্ট্রেলিয়াকে এনে দিলেন ৩ উইকেটের জয়। একই সঙ্গে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিও তুলে নিলেন ম্যাক্সওয়েল। তাতে নিশ্চিত হলো ২০২৩ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার সেমিফাইনাল। অজিদের এই জয়ে অধিনায়কের দায়িত্ব ব্যাটিংয়ে যথাযথভাবে পালন করেছেন কামিন্স। ৬৮ বলে ১২ রানের অপরাজিত ইনিংসটিই প্রমাণ করে কামিন্স ম্যাক্সওয়েলের সঙ্গীর দায়িত্ব দারুণভাবে পালন করেছেন। ১২৮ বলে ২১ চার ও ১০ ছক্কায় ২০১ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন ম্যাক্সওয়েল। পাশাপাশি বোলিংয়ে ১ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরার পুরস্কারও জিতে নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার এই অলরাউন্ডার।
মঙ্গলবার ভারতের মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড় স্টেডিয়ামে টস জিতে প্রথমে ব্যাট করে আফগানরা। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ৮ ওভারে দলীয় ৩৮ রানে ফেরেন ওপেনার রহমানউল্লাহ গুরবাজ (২১)।
ওয়ান ডাউনে ব্যাটিংয়ে নেমে ওপেনার ইব্রাহিম জাদরানের সঙ্গে ১০০ বলে ৮৩ রানের জুটি গড়ে রহমত শাহ। দলীয় ১২১ রানে ৪৪ বলে এক বাউন্ডারিতে ৩০ রান করে ফেরেন রহমত শাহ।
চার নম্বর পজিশনে ব্যাটিংয়ে নেমে ওপেনার ইব্রাহিম জাদরানের সঙ্গে দলের হাল ধরেন অধিনায়ক হাশমতউল্লাহ শহিদি। তৃতীয় উইকেটে তারা ৭৬ বলে ৫৩ রান করেন। ৪৩ বলে দুই বাউন্ডারিতে ২৬ রান করে ফেরেন হাশমতউল্লাহ।
এরপর আসা-যাওয়ার মিছিলে অংশ নেন আজমতউল্লাহ ওমরজাই। তিনি ১৮ বলে দুই চার আর এক ছক্কায় ২২ রান করেন। ১০ বলে মাত্র ১২ রান করে ফেরেন সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ নবি।
ইনিংসের শেষ দিকে রীতিমতো তাণ্ডব চালান ইব্রাহিম জাদরান ও সাবেক অধিনায়ক রশিদ খান। ষষ্ঠ উইকেটে তারা মাত্র ২৮ বলে ৫৮* রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়েন। তাদের এই জুটিতেই তিনশোর দোরগোড়ায় গিয়ে পৌঁছায় আফগানিস্তান।
ইনিংস ওপেন করতে নেমে শেষ বল পর্যন্ত লড়াই করেন ইব্রাহিম জাদরান। তিনি ১৪৩ বল খেলে দলীয় সর্বোচ্চ ১২৯ রান করে অপরাজিত থাকেন। তিনি প্রথম আফগান যিনি বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি করেছেন। মাত্র ১৮ বলে ৩৫ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলেন রশিদ খান।
আফগানিস্তান: ৫০ ওভারে ২৯১/৫
অস্ট্রেলিয়া: ৪৬.৫ ওভারে ২৯৩/৭
ফল: অস্ট্রেলিয়া ৩ উইকেটে জয়ী