:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে যাচ্ছে বিএনপিসহ ৩৫টি রাজনৈতিক দল। এরমধ্যে সরকারবিরোধী ২২ দলের সঙ্গে দ্বিতীয় দফার সংলাপ করছে বিএনপি। এর বাইরে অনানুষ্ঠানিকভাবে আরও ১৩টি দলের সঙ্গেও আলোচনা করেছে।
সুশৃঙ্খলভাবে কর্মসূচি পালনের জন্য একটি লিয়াজোঁ কমিটি করারও চেষ্টা চলছে। এতে সব দলের একজন করে প্রতিনিধি রাখা হবে। বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘প্রথম দফায় আমরা ২২টি দলের সঙ্গে সংলাপ করেছি। দ্বিতীয় দফার সংলাপ চলছে। ৩৫টি রাজনৈতিক দল যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেবে বলে আশা করছি। আমরা একমত হয়েছি এই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলব এবং পদত্যাগ করতে বাধ্য করব। একক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন শুরু হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দাবিনামার মধ্যে যেটা কমন তা হচ্ছে এ সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। সংসদ বাতিল করতে হবে এবং একটা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তর্র্র্বর্তীকালীন সরকারের হাতে তাদের ক্ষমতা হস্তান্তর করে একটা নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। তার অধীনে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হবে। দেশনেত্রী খালেদা জিয়াসহ রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে। এসব দাবি নিয়েই অন্যান্য দলের সঙ্গে সংলাপ হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে তাদের অন্যান্য দাবি নিয়ে একক দাবিনামা তৈরি করা হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানান, ২২ দলের বাইরে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও বিএনপির অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। এর বাইরে ইসলামী, বাম ও আরও কয়েকটি দলের সঙ্গেও একই আলোচনা হয়েছে। একই দাবিতে গণতন্ত্র মঞ্চসহ আরও একটি জোট ও বিএনপিসহ বাকি রাজনৈতিক দল সবাই পৃথকভাবে যুগপৎ আন্দোলনে রাজি আছে। এখন বিএনপির পক্ষ থেকে একটি রূপরেখা তৈরি করা হচ্ছে।
বিএনপি এককভাবে এখন দশ সাংগঠনিক বিভাগে সমাবেশ শুরু করেছে। ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এ কর্মসূচি। দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, এসব সমাবেশে সরকারের আচরণের ওপর নির্ভর করবে পরবর্তী কর্মসূচি কেমন হবে। সরকার কঠোর হলে বিএনপির কর্মসূচিও কঠোর হবে।
যুগপৎ আন্দোলনে রাজি ২২ দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপ করেছে বিএনপি। দলগুলো হলো-লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, নাগরিক ঐক্য, গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, মুসলিম লীগ, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), জাগপা, ন্যাশনাল পার্টি (ন্যাপ-ভাসানী), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, সাম্যবাদী দল, ডেমোক্রেটিক লীগ, ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামিক পার্টি, এনডিপি, পিপলস লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় দল ও গণফোরাম (মন্টু)।
এদিকে সাতদলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ’র পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে কর্মসূচি শুরু করা হয়েছে। সোমবার রাজধানীর কাওরান বাজারে সমাবেশ করেছে। ২১ অক্টোবর মিরপুরে ও ২৭ অক্টোবরে উত্তরায় সমাবেশ হবে। পর্যায়ক্রমে ঢাকার বিভিন্ন থানা, বিভাগ ও জেলায় সমাবেশ হবে বলে জানিয়েছেন নেতারা।
অপরদিকে, আটটি ইসলামি দল নিয়ে জোট করার চেষ্টা করছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটির আমীর ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করীম যুগান্তরকে বলেন, ‘দেশে সুন্দর ও স্বচ্ছ একটি নির্বাচন চাই। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সম্পূর্ণ প্রশ্নবিদ্ধ হয়-তা ইতোমধ্যে প্রমাণিত। সুতরাং এ দাবিসহ দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতি, বর্তমান শিক্ষানীতির মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা ঐচ্ছিক রাখার প্রতিবাদসহ নানা দাবিতে আমরা রাজপথে আছি, ভবিষ্যতে থাকব।’
ছয় দলীয় বাম জোট ২২ অক্টোবর ঢাকাসহ দেশব্যাপী গণপদযাত্রা এবং নভেম্বরজুড়ে বিভাগীয় শহরসহ বিভিন্ন জেলায় জনসভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভের কর্মসূচিও দিয়েছে।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলনকে এক দফায় পরিণত করতে চায় বিএনপি। এ বিষয়ে আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকার মহাসমাবেশ থেকে সরকারকে কঠোর বার্তাও দিতে চায় দলটি। লক্ষ্য অর্জনে মহাসমাবেশকে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে বিবেচনা করছেন বিএনপি নেতারা। সমাবেশ থেকে সরকারের উদ্দেশে কঠোর বার্তার পাশাপাশি এক দফার আন্দোলনের নতুন কর্মসূচিও ঘোষণা করবেন তাঁরা। একই সঙ্গে সরকারবিরোধী সব দলকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে জাতীয় ঐক্যের ‘রূপরেখা’ও ঘোষণা করা হতে পারে ওই মঞ্চ থেকে।
সমাবেশে অনেক নতুন রাজনৈতিক চমক থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। জনমত নিজেদের পক্ষে প্রমাণ করতে একে স্মরণকালের বৃহৎ সমাবেশে পরিণত করতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। যে কোনো মূল্যে এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে দলটির শীর্ষ নেতারা বদ্ধপরিকর।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, অবাধ নির্বাচনের জন্য সবার আগে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে এবং একটা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে। নতুন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসবে, সেই সরকার একটা নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। আর এ দাবিতেই তাঁরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছেন। পাশাপাশি তাঁরা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলছেন। তাদেরকেও এ কাতারে আনার চেষ্টা করছেন। ঐক্য গড়ার কাজ চলছে। আন্দোলনের মূল দাবিগুলো রূপরেখা আকারে শিগগিরই প্রকাশ করা হবে। এর পর যুগপৎ আন্দোলনে নামবে বিএনপি।
জুলাই থেকে জ্বালানি তেল, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন জনইস্যুতে রাজপথে রয়েছে বিএনপি। আন্দোলনের প্রথম ধাপে জেলা, মহানগর, থানা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এসব কর্মসূচিতে ব্যাপক জনসমাগম ঘটিয়ে ইতোমধ্যে রাজপথের আন্দোলনে আলোচনায় উঠে এসেছে দলটি। পরের ধাপে ঢাকা মহানগরে ১৬টি সমাবেশ সফল করায় আরও উজ্জীবিত হয় তৃণমূল নেতাকর্মীরা। নতুন কর্মসূচিতে ১০টি বিভাগীয় গণসমাবেশ কর্মসূচি পালন করছে তারা। বুধবার চট্টগ্রামে সমাবেশের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ কর্মসূচি। আজ ময়মনসিংহ বিভাগে এ গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী- ২২ অক্টোবর খুলনায়, ২৯ অক্টোবর রংপুর, ৫ নভেম্বর বরিশাল, ১২ নভেম্বর ফরিদপুর, ১৯ নভেম্বর সিলেট, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লা, ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে সমাবেশ হবে। দুই মাসের এ কর্মসূচি ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হবে।
বিএনপির বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা জানান, ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশকে সফল করতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। এ সমাবেশ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে। যুগপৎ আন্দোলনের অনেক দিকনির্দেশনা দেওয়া হতে পারে। দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আরও অনেক কিছু ঘটতে পারে এই সমাবেশ ঘিরে।
অবশ্য এসব কর্মসূচি শেষ পর্যন্ত কতটা শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হবে- তা নিয়েও সংশয়ে আছেন দলটির নেতারা। তাঁরা মনে করছেন, বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে যেভাবে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে, তা সরকারকে বেশ চাপে ফেলেছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের সমাবেশে ব্যাপক উপস্থিতি এবং একই দিন গাইবান্ধা উপনির্বাচন স্থগিত ঘোষণায় সরকার আরও চাপে পড়েছে। এতে সরকারও চেষ্টা করছে, যাতে এসব সমাবেশে কম লোকসমাগম ঘটে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাধা দেওয়া হবে না বলে সরকার মুখে যত কিছুই বলুক- তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না বিএনপি নেতাদের।
রাজপথের প্রধান বিরোধী দলটির নেতারা অভিযোগ করেন, চট্টগ্রামের সমাবেশে পথে পথে বাধা ও বাড়িতে পুলিশি হয়রানি করেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। এর পর চট্টগ্রামে বিগত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে সমাবেশের মাঠ ছাড়িয়ে আশপাশের রাস্তা ভরে যায়। বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম জানান, যতই বাধা দেওয়া হোক; ঢাকার মহাসমাবেশ ঐতিহাসিক সমাবেশে পরিণত হবে। সেই প্রস্তুতি তাঁদের রয়েছে।
দলটির জুলাই থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনে ইতোমধ্যে পাঁচজন নেতা নিহত হয়েছেন। দেশের অনেক স্থানে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীর হামলা, পুলিশের বাধা ও সংঘর্ষে অনেক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। এসব ঘটনার পরও দমে যায়নি দলটির তৃণমূল। বরং আরও বেশি সাহস নিয়ে তারা কর্মসূচিতে ফিরছে। এবারের আন্দোলনকে পুরোপুরি সফল করতে নিত্যনতুন কৌশল নেওয়া হচ্ছে। কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে, অনীহা প্রকাশ পেলে তাৎক্ষণিক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি আগামীতে মূল্যায়ন বিষয়ে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। ফলে এলাকাভিত্তিক কোন্দল, সাংগঠনিক দুর্বলতা থাকলেও কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেতাকর্মীরা একাট্টা।